কপ-২৮ সম্মেল
কপ-২৮ সম্মেলন : শুক্রবার শুরু হচ্ছে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক
কপ-২৮ সম্মেলনে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শুরু হচ্ছে আগামীকাল শুক্রবার (৮ ডিসেম্বর)। এই বৈঠক আগামী ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সরকারের প্রতিনিধি/কর্মকর্তা পর্যায়ের বিভিন্ন ধাপে গত ৬ দিনের আলোচনা শেষে এই আলোচনা শুরু হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (৭ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য ও পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক ইউএনবিকে এ তথ্য জানান।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে গত ৩০ নভেম্বর শুরু হওয়া কপ-২৮ সম্মেলনের মন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠকেই মূলত সব বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।
সম্মেলনে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল জানায়, সব দেশকেই কার্বন নির্গমন কমাতে হবে এবং এক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোকে নেতৃত্ব দিতে হবে। তবে প্রথম রাউন্ডের ছয় দিনের আলোচনায় এই ইস্যুটির ব্যাপারে কোন সিদ্বান্ত গ্রহণ করা যায়নি। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার এখন মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকেই এখন এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
অর্থায়ন ও কার্বন নিগর্মন কমানোর বাধা অতিক্রম করতে পারছে না জলবায়ু আলোচনা। এই দুই ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে উন্নত ও দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো। ফলে অর্থায়ন ও কার্বন নির্গমন কমানোর জটিল সমীকরণে প্রবেশ করতে যাচ্ছে জলবায়ু আলোচনা।
এক্ষেত্রে প্রথম সপ্তাহের আলোচনায় উপকূলীয় অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তার লস অ্যান্ড ড্যামেজ বা ক্ষয় ও ক্ষতি তহবিলের অগ্রগতি আশার আলো দেখাচ্ছে জাতিসংঘকে। এই আশা নিয়েই শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে সম্মেলনের দ্বিতীয় ধাপের মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনা।
গত ৩০ নভেম্বর দুবাইয়ের এক্সিবিশন হলে উদ্বেধন হয়েছে জাতিসংঘের ২৮তম জলবায়ু সম্মেলন। পরদিন ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় সপ্তাহব্যাপী প্রথম রাউন্ডের কর্মকর্তা পর্যায়ের আলোচনা।
আরও পড়ুন: পাঁচটি বিপর্যয়কর জলবায়ু টিপিং পয়েন্ট অতিক্রম করার দ্বারপ্রান্তে পৃথিবী: বিজ্ঞানীদের সতর্কতা
এবারের সম্মেলনের শুরুতে সবচেয়ে কঠিন ইস্যু মনে করা হয়েছিল বিগত মিশর জলবায়ু সম্মেলনে অনুমোদন হওয়া লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে অর্থায়ন এবং এই তহবিলকে কার্যকর করা। কিন্তু সম্মেলনের প্রথম দিনেই আয়োজক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত এই তহবিলে ১০০ মিলিয়ন তথা ১০ কোটি ডলার অর্থ সহায়তা দিয়ে এই ফান্ডকে কার্যকর করে দেয়। আয়োজক দেশের পাশাপাশি আরও কয়েকটি দেশও এই তহবিলে অর্থ প্রদান করে। এ পর্যন্ত এই তহবিলে প্রায় ৫৮০ মিলয়ন বা ৫৮ কোটি ডলার জমা পড়েছে। ফলে এটি এখন কার্যকর হয়েছে। এই তহবিলের ট্রানজিশনাল কমিটি এই তহবিলের টাকা ব্যবহারের গাইডলাইন তৈরি করছে।
লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড কার্যকর হওয়ার পর সম্মেলনের সবচেয়ে কঠিন কাজ সহজ হয়ে যায়। ফলে আশা করা হয়েছিল, সম্মেলনের অন্যান্য কাজগুলোও সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু কার্বন নির্গমন কমানো এবং উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুত ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের আলোচনায় এসে এই আলোচনা বাধার সম্মুখীন হয়। বরং কার্বন নির্গমন কমানোর ক্ষেত্রে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধের বিষয়ে সম্মেলনের সভাপতির একটি বক্তব্যকে ঘিরে আলোচনা আরও জটিল আকার ধারণ করে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কার্বন নিগর্মন কমানোর মিটিগেশন বিষয়ক আলোচনায় মূলত উন্নত দেশ এবং দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিরোধ এই আলোচনাকে জটিল করে দেয়। ঐতিহাসিক দায় হিসাবে কার্বন দূষণকারী উন্নত দেশগুলোকেই কার্বন নির্গমন কমানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই আলোকে চীন, ভারত, রাশিয়া ও সৌদি আরবের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো বর্তমান কার্বন নির্গমন ব্যবস্থাকে সাইডলাইনে রাখতে চাইছে।
তারা বলছে, কার্বন নির্গমন কমানোর জন্য উন্নত দেশগুলোর ঐতিহাসিক দায় রয়েছে। তাই এই কাজটি উন্নত দেশগুলোকেই করতে হবে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশগুলো বলছে, কার্বন নির্গমনের এই কাজটি একযোগে ৯০ দশক থেকে যারা কার্বন দূষণ করছে তাদেরও করতে হবে। অন্যথায় বায়ুমন্ডল থেকে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে কার্বন কমানো যাবে না। এক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশ, ক্ষুদ্র দ্বীপ দেশ এবং ল্যাটিন আমেরিকান দেশগুলোর মধ্যস্থায় এগিয়ে এসেছে।
আরও পড়ুন: জলবায়ু সংকট: অন্তর্ভুক্তিমূলক আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ব্যবস্থা প্রণয়নের আহ্বান
তারা বলছে, এই ইস্যু নিয়ে উন্নত দেশ ও দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো যুদ্ধ করলে কার্বন নির্গমন কমানো যাবে না। সব দেশকেই কার্বন নির্গমন কমাতে হবে এবং এক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোকে নেতৃত্ব দিতে হবে। তবে প্রথম রাউন্ডের ছয় দিনের আলোচনায় এই ইস্যুটির ব্যাপারে কোন সিদ্বান্ত গ্রহণ করা যায়টি। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার এখন মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকেই এখন এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
অর্থায়নের ক্ষেত্রেও একইভাবে জটিলতা তৈরি হয়েছে। উন্নত দেশগুলো ২০০৯ সালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর জলবায়ু অভিযোজন ও মিটিগেশনে ১০০ বিলিয়ন করে ডলার দেবে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি তারা গত চার বছর ধরে পূরণ করছে না।
উপরন্তু, ২০২৩ সালে এসে একটি গোঁজামিলের হিসাব দিয়ে বলছে, তারা এবছর ৮৩ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে।
এখানেও সেই একই দাবি উঠেছে যে, যারা কার্বন নির্গমনের জন্য ঐতিহাসিকভাবে দায়ী তারাই অর্থায়ন করবে। কিন্তু উন্নত দেশ না হয়েও এবারের জলবায়ু সম্মেলন নতুন নজীর সৃষ্টি করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। তারা সম্মেলনের প্রথম দিনেই লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে ১০ কোটি ডলার দিয়ে নজির সৃষ্টি করেছে যে, উন্নত দেশ না হয়েও উন্নয়নশীল দেশ অর্থায়ন করতে পারে। এই নজির টেনে উন্নত দেশগুলো বলছে, আমিরাতের মতো যে সকল দেশগুলোর সামর্থ আছে তাদেরও উচিত জলবায়ু তহবিলে অর্থায়ন করা।
তবে জলবায়ু অর্থায়নের চাহিদা এখন ট্রিলিয়ন ডলারেও পৌঁছে গেছে। তাই অর্থায়নের পরিমাণও বাড়াতে হবে। সেই আলেচনা গত বছর (২০২২) থেকে শুরু হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো দাবি জানিয়েছে, ২০২৫ সাল থেকে এই অর্থায়ন প্রতি বছর ৫০০ বিলিয়ন ডলার করতে হবে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো সুস্পষ্ট করে এ বিষয়ে কিছু বলছে না। এই আলোচনা আগামী বছর শেষ হবে। সেখানেই ঠিক হবে, ২০২৫ সাল থেকে কত বিলিয়ন ডলার দিয়ে অর্থায়ন শুরু হবে এবং অর্থ প্রদানের প্রক্রিয়া কেমন হবে।
প্রথম সপ্তাহের আলোচনার মুল্যায়ন প্রসঙ্গে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংস্থার নির্বাহী সচিব সাইমন স্টিয়েল বলেন, ‘এই পৃথিবীর মানবজাতিকে বাঁচাতে এখন আমাদের উচিত এই সম্মেলনে সর্বোচ্চ কার্বন নির্গমন কমানোর অঙ্গীকার করা। এখানে রাজনীতির কোন সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে সরকারগুলোর উচিত তাদের কর্মকর্তাদের সক্রিয় হওয়ার নির্দেশনা দেয়া।’আরও পড়ুন: কপ-২৮: ৫ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে অন্য দেশের সঙ্গে কাজ করবে বাংলাদেশ
তিনি বলেন, ‘আমাদের শুধু ভাল সদিচ্ছা থাকলেই কার্বন নির্গমন কমাতে পারব না। কেবলমাত্র অর্থায়নের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতিই এক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল এনে দিতে পারে। অর্থায়নই হচ্ছে এখন জলবায়ু প্রতিরোধের বড় চালিকাশক্তি। আলোচকদের এখন শেষ সপ্তাহে এসে এই দিকে পূর্ণ মনোযোগ দেয়া উচিত।’
বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য ও পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক ইউএনবিকে বলেন, ‘কার্বন নির্গমন হ্রাস এবং অর্থায়ন বিষয়ে আলোচনা থমকে আছে। এই দুই বিষয় এখন সিদ্ধান্তের জন্য মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তবে লস অ্যান্ড ড্যামেজ, কার্বন দূষণ পরিস্থিতির বৈশ্বিক মূল্যায়ন, গ্লোবাল গোল অন অ্যাডাপটেশন, প্রযুক্তি প্রভৃতি বিষয়ে একমত হওয়া গেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ডের অর্থ ব্যবহারে নতুন করে গাইডলাইন দেয়া হচ্ছে। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো সহজে এবং বেশি পরিমাণে অর্থ পায়। অর্থের প্রবাহ বাড়াতে না পারলে জলবায়ু পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি করা যাবে না। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যেতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক মূল্যায়ন নিয়ে ২৪ পৃষ্টার একটি দলিল (টেক্সট) প্রণয়ন করা হয়েছে। এখন এই ২৪ পৃষ্ঠার দলিলকে চার দিনের মধ্যে একটি জায়গায় এনে অনুমোদন করা কঠিন কাজ।’
আরও পড়ুন: কপ-২৮ সম্মেলনে স্থানীয় জলবায়ু নেতৃত্বে গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে বাংলাদেশ
১ বছর আগে