রাজনৈতিক কারণ
ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ককে পরবর্তী পর্যায়ে নেওয়ার চাবিকাঠি সদিচ্ছা, কৌশলগত বিবেচনা ও ভূ-রাজনৈতিক কারণ
বাংলাদেশের নির্বাচনের পর দুই দেশের সম্পর্ক পর্যবেক্ষণ করে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন, প্রাক-নির্বাচনি রাজনৈতিক মতপার্থক্য পেছনে ফেলে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বিবেচনা, ভূ-রাজনৈতিক কারণ এবং নতুন ক্ষেত্রে সম্পর্ক সম্প্রসারণের অকৃত্রিম ইচ্ছা দুই দেশের সম্পর্ককে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যাবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান চলতি সপ্তাহে ইউএনবিকে বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ ও পুরোনো সম্পর্ক রয়েছে। সম্পর্কের নতুন অধ্যায় দেখে মনে হচ্ছে, দেশ দুটির ব্যাপক রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাদের সম্পর্ক আরও গভীর হবে।’
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার এবং অভিন্ন স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একটি ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে।
প্রতিনিধি দলে ছিলেন প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের (এনএসসি) দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক এইলিন লুবাখার, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) এশিয়া অঞ্চলের সহকারী প্রশাসক মাইকেল শিফার এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আখতার।
আরও পড়ুন: সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঢাকার জিরো টলারেন্স নীতিকে স্বাগত জানিয়েছে ওয়াশিংটন
তাদের আলোচনায় জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্য, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট ও শ্রম অধিকার নিয়েও আলোকপাত করা হয়। প্রতিনিধি দলটি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী নির্বাহী, নাগরিক সমাজের সংগঠন এবং শীর্ষ বিরোধী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের নির্বাহী পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অধ্যাপক শাহাব মনে করেন, বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও ইন্দো-প্যাসিফিক এজেন্ডার বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তাই প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, অপ্রথাগত নিরাপত্তা ও মানব নিরাপত্তা ইস্যুতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন গতি পাবে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারকেও জেগে ওঠার আহ্বান এটি। এ থেকে বোজা যায়, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তৃতীয় কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবে না।’
বরং তিনি মনে করেন, আগামী দিনগুলোতে উভয় দেশই তাদের পারস্পরিক স্বার্থের সমন্বয় ঘটাতে পারে। ‘সর্বোপরি বাংলাদেশ পরাশক্তিগুলোর কাছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দেশ, কারণ আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কোনো ফাটল ধরেনি বা কোনো রাজনৈতিক বা নিরাপত্তার বিষয়ও নেই।’
অধ্যাপক শাহাব বলেন, এই দুটি বিষয় বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজনীয় আঞ্চলিক নিরাপত্তার গ্যারান্টার করে তোলে।
নতুন অধ্যায় ও অগ্রাধিকার
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনার বিষয়ে অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র হেইনেস মাহনি বলেন, বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের অংশীদার এবং বাংলাদেশের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের বৃহত্তম উৎস যুক্তরাষ্ট্র।
তিনি বলেন, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল যাতে অবাধ, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ থাকে তা নিশ্চিত করতে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা বিস্তৃত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি।’
হেইনেস বলেন, 'প্রেসিডেন্ট বাইডেন যেমন বলেছেন, আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমিত করতে এবং জনগণের জন্য বিনিয়োগে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার উপায়গুলো নিয়ে কাজ করব; যাতে তারা স্বাস্থ্যকর ও আরও সমৃদ্ধ জীবনযাপনের সুযোগ পায়।’
বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখে সন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র। তিনি মনে করেন, অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করা এবং দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তারা যা করার চেষ্টা করছে তার 'সত্যিকারের প্রতিফলন'।
হেইনেস বলেন, বাংলাদেশ অবশ্যই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশগুলোর অন্যতম এবং এই প্রচেষ্টায় সহায়তা করতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত।
অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বেসরকারি খাতের মাধ্যমে উন্নয়নে তাদের বিনিয়োগকে কাজে লাগাতে এবং যুবকদের সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে তারা ক্রমবর্ধমানভাবে মনোনিবেশ করছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী নেতা ও যুবকদের একত্রিত করছি যাতে বাজারে চাহিদা আছে এমন বিষয়ে তরুণদের আরও দক্ষ করে গড়ে তোলা যায়। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৃহত্তর সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে এবং বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশকে আরও প্রতিযোগিতামূলক হতে সহায়তা করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতাসম্পন্ন মেধাবী কর্মী বাহিনী তৈরি করতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র বলেন, তারা দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার উপায় নিয়ে গবেষণা করছেন। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে আমাদের একসঙ্গে কাজ করার সময় যাতে দেশের প্রতিটি এলাকার জনগণ স্বাস্থ্যকর এবং সমৃদ্ধ জীবনযাপনের ন্যায়সঙ্গত সুযোগ পায়।
তিনি বলেন, 'আমরা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে সহযোগিতা করার বিষয়েও কাজ করছি। একই সঙ্গে উপকূলীয় সীমান্তে কী ঘটছে এবং আকাশ, স্থল ও সমুদ্রপথে কী আসছে তা বোঝার জন্য সামুদ্রিক ডোমেন সচেতনতায় বিনিয়োগ করতে সক্ষম।’
আরও পড়ুন: ইউনূসকে নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে, বিবৃতি নয়: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
জিএসওএমআইএ ও এসিএসএ সম্পর্কিত সমস্যাগুলো
জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট (জিএসওএমআইএ) এবং অ্যাকুইজিশন ক্রস-সার্ভিসিং এগ্রিমেন্টের (এসিএসএ) অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে হেইনেস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে জিএসওএমআইএ বিবেচনা করা হচ্ছে। কারণ উভয় পক্ষ 'আরও বাস্তব ও গভীর' সম্পর্কের সুযোগ খুঁজছে।
তিনি বলেন, চুক্তিটি কার্যকরভাবে একটি প্রতিশ্রুতি, যা প্রতিটি পক্ষ কার্যকরভাবে অন্য পক্ষের কাছ থেকে প্রাপ্ত যেকোনো তথ্য বা সংবেদনশীল সামগ্রী সুরক্ষিত রাখবে।
অন্যদিকে, তিনি বলেন, এসিএসএ অংশীদার সামরিক বাহিনীর মধ্যে লজিস্টিক সহায়তা বিনিময়কে সহজতর করে এবং অর্থবহ সম্পৃক্ততার সুযোগ বাড়ায়।
হেইনেস বলেন, যদিও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে এসিএসএ নিয়ে কোনো আলোচনা নেই, তবে দুই পক্ষ যদি মনে করে যে এটি যথেষ্ট সুবিধা দেবে তবে ভবিষ্যতে এটি পরিবর্তন হতে পারে।
মিয়ানমার পরিস্থিতি ও তার প্রভাব
মুখপাত্র বলেন, 'অবশ্যই আমরা খুবই উদ্বিগ্ন এবং বার্মার (মিয়ানমার) ঘটনাবলী নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। বার্মায় (মিয়ানমার) চলমান সংঘর্ষ খুবই উদ্বেগজনক। এটি কেবল এই অঞ্চলের জন্যই নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়।’
তিনি বলেন, মিয়ানমারে চলমান সংকট উদ্বেগজনক বিষয় এবং মিয়ানমারে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারসহ বর্তমান সংকটে মানবিক সহায়তা হিসেবে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
তিনি বলেন, সংকটের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করা, স্থিতিশীলতা জোরদার করা এবং টেকসই ও মানবিক সমাধান খুঁজে বের করা অপরিহার্য।
ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর কল্যাণ এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ‘বিস্তৃত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক’ পদ্ধতির উপর জোর দেন তারা। একই সঙ্গে মায়ানমারের পরিস্থিতির ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি কমিয়ে আনতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন তারা।
মুখপাত্র বলেন, 'বার্মায় সংঘর্ষের কারণে বার্মায় অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত এবং বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থী উভয়ের জন্য সমর্থন অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তাও আমরা স্বীকার করি।’
এ বছরের শুরুর দিকে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্য ও পুষ্টি সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখতে অতিরিক্ত ৮৭ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যা শরণার্থীদের জন্য মাসিক খাদ্য রেশন প্রতি মাসে ১০ ডলারে উন্নীত করতে সহায়তা করেছে।
মুখপাত্র বলেন, ‘তাদের সুস্থ থাকার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। আমরা বাংলাদেশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে চাকরি-দক্ষতা ও ব্যবসায় প্রশিক্ষণসহ বহুপক্ষীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সহায়তা প্রদান অব্যাহত রেখেছি যাতে জনগণকে তাদের জীবনযাত্রার উন্নয়নে সহায়তা করতে পারে।’
উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক এবং ফরেন পলিসির সাপ্তাহিক দক্ষিণ এশিয়া ব্রিফের লেখক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও ইতিবাচক দিকে গেছে; যেই নির্বাচনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও সুষ্ঠু নয় বলে বর্ণনা করেছিল।
তিনি এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এই পরিবর্তন আসলে যতটা মনে হয় ততটা তীক্ষ্ণ নয়। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের স্পষ্ট পরিবর্তনের মধ্যে এই সফর হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পাঠানো বার্তা ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ইঙ্গিতের কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা, ভিসা নিষেধাজ্ঞা ও সমালোচনাসহ মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের উন্নয়নে জোরালো পদক্ষেপ নেয়।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এই ভোটকে অবাধ ও সুষ্ঠু নয় বলে উল্লেখ করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন, যাতে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের 'পরবর্তী অধ্যায়কে' স্বাগত জানানো হয়েছে; সেখানে অধিকার বা গণতন্ত্রের কথা বলা হয়নি।
চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদসহ বাংলাদেশি কর্মকর্তারা নতুন অধ্যায় শুরুর ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, 'নির্বাচন এখন অতীতের বিষয়।’ নানা ক্ষেত্রে অংশীদারিত্বের উল্লেখসহ উভয় পক্ষের বার্তা উষ্ণ ও কার্যকরী ছিল।
ঘুরে দাঁড়ানোর কারণ কী- এ প্রসঙ্গে মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, একটি সম্ভাব্য কারণ হচ্ছে, ওয়াশিংটন ঢাকার উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিতে চায়।
৮ মাস আগে