লোহিত রক্তকণিকা
রক্তের গ্রুপ: কে কাকে রক্ত দিতে পারবে?
নিরাপদ রক্তদানের জন্য দাতা-গ্রহীতাসহ রক্তদানের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে যে বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়, তা হচ্ছে রক্তের শ্রেণীবিভাগ। রক্তের ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপের মধ্যে রক্তের আদান-প্রদানের সামঞ্জস্যতার ওপর নির্ভর করে জরুরি চিকিৎসার অগ্রীম প্রস্তুতি। সঠিক সময়ে সঠিক রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে বেঁচে যেতে পারে একটি জীবন। আর এই মহৎ উদ্দেশ্যকে সাধুবাদ জানিয়েই প্রতিবছর ১৪ জুন পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। এই উপলক্ষটি নিরাপদ রক্তের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ায় এবং উদ্বুদ্ধ করে এই মহান কাজে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। চলুন, বিভিন্ন ধরনের রক্তের গ্রুপের বৈশিষ্ট্য এবং তাদের মধ্যকার সামঞ্জস্যতা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা নেওয়া যাক।
বিভিন্ন ধরনের রক্তের গ্রুপ
রক্তের শ্রেণীবিন্যাসের নেপথ্যে রয়েছে রক্তে বিদ্যমান দুটি উপাদান।
১. লোহিত রক্তকণিকার (আরবিসি) পৃষ্ঠে থাকা প্রোটিন অণু, যার নাম অ্যান্টিজেন। অ্যান্টিজেন মুলত 'এ', 'বি', এবং ‘রেসাস (আরএইচ) ডি’ – এই ৩ ধরনের হয়ে থাকে।
২. প্লাজমাতে অবস্থিত বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন, যেগুলো অ্যান্টিবডি নামে পরিচিত। অ্যান্টিবডি ‘অ্যান্টি-এ’ এবং ‘অ্যান্টি-বি’ – এই ২ শ্রেণীর হয়ে থাকে।
এই উপাদানগুলো মা-বাবার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সন্তানের দেহে আসে। রক্তের শ্রেণীবিন্যাসের মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত দুটি ব্যবস্থা হচ্ছে- ‘এবিও’ এবং ‘রেসাস (আরএইচ) ফ্যাক্টর’।
আরও পড়ুন: মুখের দুর্গন্ধ দূর করার ঘরোয়া উপায়
এবিও সিস্টেমে রক্তের ধরন ৪ প্রকার- 'এ', 'বি', 'এবি', এবং 'ও'। রক্তে অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডির উপস্থিতির উপর নির্ভর করে এগুলোর ভিন্নতা হয়।
আরএইচ সিস্টেমে রক্তে 'আরএইচডি'র উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে এবিওর প্রত্যেকটি গ্রুপ পজিটিভ বা নেগেটিভ হয়ে থাকে। এভাবে আরএইচ সিস্টেম অনুসারে গ্রুপ হয় মোট ৮টি। চলুন, এবার এই গ্রুপগুলোর বিস্তারিত জানা যাক।
এ+
লোহিত রক্তকণিকার পৃষ্ঠে অ্যান্টিজেন 'এ' এবং 'আরএইচডি’র উপস্থিতির মাধ্যমে গ্রুপ 'এ+' চিহ্নিত করা হয়। এই গ্রুপের রক্তের প্লাজমাতে অ্যান্টি-বি অ্যান্টিবডি থাকে। এই অ্যান্টিবডিগুলো 'বি' অ্যান্টিজেনযুক্ত লোহিত রক্ত কোষকে আক্রমণ করে। 'আরএইচডি'র উপস্থিতির অর্থ হলো এই রক্ত 'এ-' রক্তের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। বিশেষ করে গর্ভাবস্থা এবং রক্তদানের সময় এই দুই মেরুর রক্ত শরীরের উপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।
এ-
এই গ্রুপেও লোহিত রক্তকণিকায় অ্যান্টিজেন 'এ' উপস্থিত থাকে। তবে 'আরএইচডি'র অভাবে গ্রুপটি 'আরএইচডি-' হিসেবে প্রতীয়মান হয়। 'এ+' রক্তের মতো 'এ-' রক্তের প্লাজমাতেও অ্যান্টি-বি অ্যান্টিবডি থাকে। ফলে এটি 'বি' গ্রুপের রক্তের বিরুদ্ধে নেতিবাচক অবস্থান নেয়। অন্যদিকে, 'আরএইচডি'র অনুপস্থিতি গর্ভাবস্থায় আরএইচ অসামঞ্জস্যতার মতো জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে একজন ‘আরএইচডি-’ মায়ের রক্ত একটি ‘আরএইচডি+’ ভ্রূণের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এতে করে নবজাতকের হেমোলাইটিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়।
আরও পড়ুন: থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ
বি+
বি অ্যান্টিজেন এবং 'আরএইচডি' সমন্বিত লোহিত রক্তকণিকার পৃষ্ঠ রক্তকে 'বি+' গ্রুপ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। এই ধরনের রক্তের প্লাজমাতে থাকে অ্যান্টি-এ অ্যান্টিবডি, যা অ্যান্টিজেন 'এ' সমৃদ্ধ লোহিত রক্তকণিকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। 'বি+' রক্তের 'আরএইচডি' 'বি-' রক্তের তুলনায় ভিন্ন প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করতে পারে।
বি-
এই গ্রুপটি রক্তের এমন ধরনকে প্রতিনিধিত্ব করে, যার লোহিত রক্ত কণিকায় অ্যান্টিজেন 'বি' থাকে কিন্তু 'আরএইচডি' থাকে না। এই রক্তের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এর প্লাজমায় অ্যান্টি-এ অ্যান্টিবডি বিদ্যমান। আরএইচ ফ্যাক্টর না থাকার ফলে 'বি-' রক্তের অধিকারী ব্যক্তিরা রক্ত সঞ্চালন এবং গর্ভাবস্থায় মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। কেননা ‘আরএইচডি+’ ভ্রূণ বহনকারী একজন 'আরএইচডি-' মায়ের রক্ত আরএইচ ফ্যাক্টরের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে।
ও+
এই গ্রুপের রক্তে লোহিত রক্তকণিকার পৃষ্ঠে 'এ' এবং 'বি' কোনো অ্যান্টিজেনই থাকে না, কিন্তু 'আরএইচডি' থাকে। 'ও+' রক্তের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর প্লাজমায় অ্যান্টি-এ এবং অ্যান্টি-বি দুই অ্যান্টিবডিই থাকে। এতে করে এই রক্ত ‘এ’ এবং 'বি' উভয় অ্যান্টিজেন থাকা লোহিত রক্তকণিকাকে আক্রমণ করে। 'এ' এবং 'বি' অ্যান্টিজেনের অনুপস্থিতির কারণে অন্যান্য রক্তের সঙ্গে এর ব্যাপক সামঞ্জস্যতা রয়েছে।
আরও পড়ুন: সার্কেডিয়ান রিদম বা দেহ ঘড়ি নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
ও-
এটি এমন একটি গ্রুপ যার রক্তের লোহিত রক্তকণিকায় অ্যান্টিজেনে 'এ', 'বি', এবং 'আরএইচডি' কোনোটাই থাকে না। 'ও+' এর মতো এই রক্তেও প্লাজমা অ্যান্টি-এ এবং অ্যান্টি-বি অ্যান্টিবডিতে সমৃদ্ধ। এই সমস্ত অ্যান্টিজেনের অনুপস্থিতির কারণে 'ও-' রক্ত সার্বজনীন দাতার গ্রুপ হিসেবে বিবেচিত। এটি অ্যান্টিজেন সংক্রান্ত কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি ছাড়াই যে কোনো রক্তের রোগীদের দেওয়া যেতে পারে।
এবি+
যে রক্তের লোহিত রক্তকণিকার পৃষ্ঠে অ্যান্টিজেন 'এ' এবং 'বি' এর পাশাপাশি আরএইচ ফ্যাক্টরও থাকে, সে রক্তের গ্রুপের নাম 'এবি+'। এ ধরনের রক্তের প্লাজমায় অ্যান্টি-এ বা অ্যান্টি-বি কোনো অ্যান্টিবডিই থাকে না। এই বৈশিষ্ট্যটি 'এবি+' রক্তকে সার্বজনীন গ্রহীতা গ্রুপ হিসেবে প্রতীয়মান করেছে। 'এ' এবং 'বি' উভয় অ্যান্টিজেন এবং আরএইচ ফ্যাক্টরের উপস্থিতির কারণে রক্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এটি সর্বাঙ্গীনভাবে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ গ্রুপ।
এবি-
লোহিত রক্ত কণিকায় 'আরএইচডি' নেই অথচ 'এ' এবং 'বি' উভয় অ্যান্টিজেনই বিদ্যমান, এমন রক্তকে চিহ্নিত করা হয় 'এবি-' হিসেবে। 'এবি+' এর মতো এই রক্তের প্লাজমাও অ্যান্টি-এ বা অ্যান্টি-বি অ্যান্টিবডি-বিহীন। 'এবি-' রক্তের অধিকারীদের আরএইচ সংবেদনশীলতা রোধ করতে অবশ্যই আরএইচ পজিটিভ রক্ত গ্রহণ থেকে দূরে থাকতে হবে।
আরও পড়ুন: অটিজম কী? অটিজম সচেতনতা ও সহমর্মিতা কেন জরুরি?
রক্তের গ্রুপগুলোর মধ্যে কে কাকে রক্ত দিতে পারবে
যে রক্তগুলো পারস্পরিক সহাবস্থানে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, অনাকাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে সেগুলোর ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরী। চলুন, রক্তের বিভিন্ন গ্রুপগুলোর মধ্যকার রক্ত সঞ্চালনের সামঞ্জস্যতা এক নজরে দেখে নেওয়া যাক।
টেবিল: রক্তের বিভিন্ন গ্রুপের সামঞ্জস্যতা সারণী
রক্তের গ্রুপ
গ্রহীতা গ্রুপ
দাতা গ্রুপ
এ+
এ+, এবি+
এ+, এ-, ও+, ও-
এ-
এ+, এ-, এবি+, এবি-
এ-, ও-
বি+
বি+, এবি+
বি+, বি-, ও+, ও-
বি-
বি+, বি-, এবি+, এবি-
বি-, ও-
ও+
এ+, বি+, এবি+, ও+
ও+, ও-
ও-
সব গ্রুপ
ও-
এবি+
এবি+
সব গ্রুপ
এবি-
এবি+, এবি-
এবি-, এ-, বি-, ও-
আরও পড়ুন: নারীদের চেয়ে পুরুষদের আত্মহত্যার হার বেশি যে কারণে
'এ+' গ্রুপের ব্যক্তিরা 'আরএইচডি' নির্বিশেষে 'এ' বা 'ও' গ্রুপ থেকে রক্ত গ্রহণ করতে পারবে, কিন্তু দিতে পারবে শুধুমাত্র 'এ+' এবং 'এবি+' গ্রুপের ব্যক্তিদের। 'এ-' গ্রুপ শুধু 'এ-' এবং 'ও-' গ্রুপ থেকে রক্ত নিতে পারবে, তবে দান করতে পারবে 'আরএইচডি' নির্বিশেষে 'এ' এবং 'এবি' উভয় গ্রুপকে।
'বি+' এর দাতা হিসেবে করতে পারে 'বি+', 'বি-', 'ও+', এবং 'ও-' গ্রুপ। অন্যদিকে গ্রহীতা হিসেবে কাজ করতে পারবে শুধু 'বি+' এবং 'এবি+' গ্রুপ। 'বি-' গ্রুপ 'বি-' এবং 'ও-' গ্রুপের রক্ত নিতে পারবে, আর রক্ত দিতে পারবে 'বি+', 'বি-', 'এবি+', এবং 'এবি-' গ্রুপগুলোকে।
'ও+' রক্তের গ্রহীতারা হলো যেকোনো আরএইচ+ গ্রুপ, তবে দাতা গ্রুপ হলো শুধু 'ও+' এবং 'ও-'। 'ও-' রক্ত গ্রহীতা হিসেবে শুধু 'ও-' রক্ত নিতে পারে, কিন্তু সার্বজনীন দাতা হিসেবে রক্ত দিতে পারে সমস্ত গ্রুপকে। অপরদিকে, সার্বজনীন গ্রহীতা হিসেবে 'এবি+' গ্রুপ সব ধরনের রক্ত গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু দাতা হিসেবে শুধু 'এবি+' গ্রুপভুক্ত ব্যক্তিদেরকেই রক্ত দিতে পারে। 'এবি-' রক্তের দাতা গ্রুপ হলো 'এবি-', 'এ-', 'বি-', এবং 'ও-' এবং গ্রহীতা গ্রুপ 'এবি+' এবং 'এবি-'।
আরও পড়ুন: সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক: কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ
শেষাংশ
সর্বপরি, লোহিত রক্তকণিকায় অ্যান্টিজেন 'এ' এবং 'বি' থাকা এবং না থাকার ভিত্তিতে রক্তের গ্রুপ যথাক্রমে 'এ' এবং 'বি' হিসেবে চিহ্নিত হয়। দুটো অ্যান্টিজেনই থাকলে 'এবি' গ্রুপ এবং দুটোর কোনটিই না থাকলে নির্ধারিত হয় গ্রুপ 'ও' হিসেবে।
পাশাপাশি আরএইচ ফ্যাক্টরের উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি সংশ্লিষ্ট গ্রুপের সঙ্গে যথাক্রমে পজিটিভ এবং নেগেটিভি মার্ক যুক্ত করে। ৮টি গ্রুপের প্রত্যেকটি নিদেনপক্ষে নিজ গ্রুপের সঙ্গে রক্তের আদান-প্রদান করতে সক্ষম। তন্মধ্যে প্রতিটি ‘আরএইচ+’ গ্রুপকে রক্ত দিতে পারে বিধায় 'ও+' রক্তের চাহিদা থাকে সর্বাধিকা। উপরন্তু, সর্বদাতা গ্রুপ হিসেবে পরিচিত 'ও-' এবং সর্বগ্রহীতা 'এবি+'।
আরও পড়ুন: মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ: কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ
৬ মাস আগে
থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ
থ্যালাসেমিয়া সৃষ্টিকারী জিন মিউটেশনের সর্বপ্রথম উদ্ভব ঘটেছিল ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে আংশিক সুরক্ষা হিসেবে। তাই বিশ্বের যে অঞ্চলগুলোতে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি সেখানে থ্যালাসেমিয়া সক্রিয়। এই অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে আফ্রিকা, দক্ষিণ ইউরোপ এবং পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত প্রতিটি রোগীর বংশানুক্রমিক যোগসূত্র থাকে তাদের পূর্বপুরুষের সঙ্গে। থ্যালাসেমিয়া রোগ দ্রুত শনাক্ত করে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। এতে সম্পূর্ণভাবে রোগমুক্তি না মিললেও জটিলতাগুলো অনেকাংশে কমানো যায়। তাই চলুন, থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণ, লক্ষণ, ও নিয়ন্ত্রণের উপায়গুলো জেনে নেওয়া যাক।
থ্যালাসেমিয়া কী
লোহিত রক্তকণিকার প্রোটিন অণু হিমোগ্লোবিন সারা শরীরে অক্সিজেন বহন করে। থ্যালাসেমিয়া এমন একটি বংশানুক্রমিক ব্যাধি, যার ফলে এই হিমোগ্লোবিনে অসঙ্গতি দেখা দেয়। ফলে লোহিত রক্তকণিকা অত্যধিক মাত্রায় ধ্বংস হয়ে শরীরকে রক্তাল্পতার দিকে ঠেলে দেয়।
থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণ
মা-বাবার মধ্যে যে কোনো একজনের থ্যালাসেমিয়া হলে সন্তানও এই রোগে আক্রান্ত হয়। এটি মূলত জেনেটিক মিউটেশন বা জিনগত পরিবর্তনের কারণে ঘটে। এই পরিবর্তনটি ঘটে কোষের ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিইক এসিড) তে, যা হিমোগ্লোবিনকে প্রভাবিত করে।
হিমোগ্লোবিন অণুগুলো আলফা এবং বিটা নামক চেইন দিয়ে তৈরি। থ্যালাসেমিয়ায় এই আলফা বা বিটা চেইনের উৎপাদন কমে যায়। আর এ কারণে থ্যালাসেমিয়া প্রধানত দুই ধরনের- আলফা-থ্যালাসেমিয়া এবং বিটা-থ্যালাসেমিয়া।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ, নির্ণয়ের প্রক্রিয়া, চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
আলফা-থ্যালাসেমিয়ায় রোগের তীব্রতা নির্ভর করে পিতামাতার কাছ থেকে প্রাপ্ত পরিবর্তিত জিন সংখ্যার উপর। যত বেশি পরিবর্তিত জিন, থ্যালাসেমিয়া তত গুরুতর।
অন্যদিকে, বিটা-থ্যালাসেমিয়ায় হিমোগ্লোবিন অণুর কোন অংশ প্রভাবিত হয়েছে তার উপর নির্ভর করে রোগের মাত্রা কম-বেশি হয়।
আলফা-থ্যালাসেমিয়া
এই রোগে হিমোগ্লোবিনের আলফা চেইনকে প্রভাবিত করতে সর্বোচ্চ চারটি পরিবর্তিত জিন অংশ নেয়। মা ও বাবার প্রত্যেকের কাছ থেকে দুটি করে।
শুধু একটি জিন পেয়ে থাকলে আক্রান্তের দেহে রোগের কোন লক্ষণ থাকে না। কিন্তু এরপরেও আক্রান্তের দেহ থেকে পরবর্তীতে তার সন্তানদের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া ছড়িয়ে পড়তে পারে।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু সম্পর্কে ১০টি প্রচলিত ধারণা: জেনে নিন সঠিক তথ্য
দুটি জিনের ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গ হালকা হয়। আর এই অবস্থাতেই রোগীকে আলফা-থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত বলা হয়।
তিনটি জিন প্রাপ্ত হলে উপসর্গ মাঝারি থেকে গুরুতর হয়। বংশানুক্রমিকভাবে চারটি জিন পাওয়াটা দুর্লভ। এই ক্ষেত্রে শিশুরা প্রায়ই জন্মের পরেই মারা যায় বা আজীবন ট্রান্সফিউশন থেরাপির প্রয়োজন হয়।
বিটা-থ্যালাসেমিয়া
রোগের এই সংস্করণে হিমোগ্লোবিন বিটা চেইনকে প্রভাবিত করতে দুটি পরিবর্তিত জিন অংশ নেয়। সন্তান মা ও বাবার প্রত্যেকের কাছ থেকে একটি করে জিন পায়।
একটি জিন পেলে রোগের হালকা লক্ষণ দৃশ্যমান হয়। এই অবস্থাকে থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা বিটা-থ্যালাসেমিয়া বলা হয়।
আরও পড়ুন: সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক: কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ
দুটি জিন প্রাপ্ত হওয়া মানেই রোগ মাঝারি থেকে গুরুতর পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। এই অবস্থাকে থ্যালাসেমিয়া মেজর বা কুলি অ্যানিমিয়া বলা হয়।
দুটি বিটা হিমোগ্লোবিন জিন নিয়ে জন্মগ্রহণকারী শিশুরা সাধারণত জন্মের সময় সুস্থ থাকে। কিন্তু প্রথম দুই বছরের মধ্যেই লক্ষণগুলো দেখা দিতে শুরু করে।
থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ
উপসর্গহীনতা বা হালকা উপসর্গ
একদম প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো উপসর্গই পরিলক্ষিত হয় না। সর্বোচ্চ হালকা রক্তাল্পতার কারণে মৃদু ক্লান্তি বোধ হতে পারে।
হালকা থেকে মাঝারি উপসর্গ
লক্ষণ হালকা রক্তাল্পতা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে মাঝারি পর্যায়ের দিকে এগোতে থাকে। এ সময়-
- দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে
- বয়ঃসন্ধিকাল আসতে বিলম্ব হয়
- অস্টিওপরোসিস বা হাড়ের অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়
- তলপেটের অভ্যন্তরের প্লীহা নামক অঙ্গটি অস্বাভাবিক ভাবে বড় হয়ে যায়। এই প্লীহা পেটের ভেতরে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভূমিকা পালন করে।
আরও পড়ুন: মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ: কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ
গুরুতর লক্ষণ
রক্তাল্পতা এ ক্ষেত্রে মাঝারি থেকে প্রকোট আকার ধারণ করে। এ সময় যে উপসর্গগুলো দেখা দেয় তা হলো:
- আহারে রুচি কমে যাওয়া
- ত্বক ফ্যাকাশে বা হলুদ হওয়া
- প্রস্রাব গাঢ় রঙের হওয়া
- মুখের হাড়ের গঠন অস্বাভাবিক হওয়া|
আরও পড়ুন: অটিজম কী? অটিজম সচেতনতা ও সহমর্মিতা কেন জরুরি?
থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা
থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়
স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের জন্য জরুরি ভাবে বিভিন্ন রক্ত পরীক্ষা করতে পারেন। এই টেস্টগুলো হলো:
কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট
এর মাধ্যমে হিমোগ্লোবিন এবং লোহিত রক্তকণিকার পরিমাণ এবং আকার সম্বন্ধে জানা যায়। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের সাধারণত স্বাভাবিকের চেয়ে কম স্বাস্থ্যকর লোহিত রক্তকণিকা এবং কম হিমোগ্লোবিন থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের লোহিত রক্তকণিকা স্বাভাবিক মাত্রায় থাকতে পারে।
রেটিকুলোসাইট কাউন্ট
এটি মূলত তরুণ লোহিত রক্ত কোষের একটি পরিমাপ। এর মাধ্যমে জানা যায়, অস্থি মজ্জা যথেষ্ট পরিমাণে লোহিত রক্ত কোষ তৈরি করছে কি না।
এছাড়া আয়রনের টেস্টের মাধ্যমে রক্তশূন্যতার কারণ যাচাই করা হয়। বিটা-থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা হয় হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস। আর আলফা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে জেনেটিক পরীক্ষা করা হয়।
আরও পড়ুন: সার্কেডিয়ান রিদম বা দেহ ঘড়ি নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
চিকিৎসার সম্ভাব্য উপায়
ব্লাড ট্রান্সফিউশান
এই চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য স্বাস্থ্যকর লোহিত রক্তকণিকা এবং হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা পুনরুদ্ধার। এর জন্য শিরাতে লোহিত রক্ত কোষ প্রবেশ করানো হয়। মাঝারি বা গুরুতর থ্যালাসেমিয়াতে প্রতি চার মাসে এবং বিটা-থ্যালাসেমিয়া মেজরে প্রতি দুই থেকে চার সপ্তাহে একবার করে ট্রান্সফিউশন দেয়া হয়। হিমোগ্লোবিন এইচ রোগ বা বিটা থ্যালাসেমিয়া ইন্টারমিডিয়ার জন্য মাঝে মাঝে ট্রান্সফিউশনের প্রয়োজন হতে পারে।
আয়রন চিলেশন
এই চিকিৎসার মাধ্যমে শরীর থেকে অতিরিক্ত আয়রন অপসারণ করা হয়। ব্লাড ট্রান্সফিউশানের একটি ঝামেলা হলো, এর ফলে আয়রন বেড়ে যেতে পারে। আর অত্যধিক আয়রন বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতির কারণ হতে পারে। ঘন ঘন ট্রান্সফিউশন দেয়া হলে তার সাথে আয়রন চিলেশন থেরাপিও দেওয়া হয়।
ফলিক অ্যাসিডের সাপ্লিমেন্ট্স
শরীরে সুস্থ রক্তকণিকা তৈরির জন্য ডাক্তার এই প্রতিষেধকগুলো গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
আরও পড়ুন: নারীদের চেয়ে পুরুষদের আত্মহত্যার হার বেশি যে কারণে
বোন ম্যারো অ্যান্ড স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট
এই জটিল চিকিৎসায় একজন উপযুক্ত দাতার কাছ থেকে অস্থি মজ্জা এবং স্টেম সেল রোগীর দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়। উপযুক্ত মানে গ্রহীতার মত দাতার কোষের পৃষ্ঠে থাকতে হবে একই ধরনের প্রোটিন, যাকে হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন (এইচএলএ) বলা হয়। চিকিৎসা চলাকালীন গ্রহীতার রক্তপ্রবাহে দাতার অস্থি মজ্জা স্টেম সেল প্রবেশ করানো হয়। প্রতিস্থাপিত কোষগুলো এক মাসের মধ্যে নতুন ও সুস্থ রক্তকণিকা তৈরি করতে শুরু করে।
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের উপায়
শুধুমাত্র বংশানুক্রমিকভাবে যোগসূত্র থাকা ব্যক্তিরাই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হন। অর্থাৎ, আক্রান্ত শিশু এই ব্যাধি নিয়েই জন্ম নেয়। ফলশ্রুতিতে, জিনগত এই ব্যাধি থেকে দূরে থাকার কোনো প্রশ্ন থাকে না। তবে এর জটিলতাগুলো প্রতিরোধ করার জন্য নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
স্বামী বা স্ত্রী যে কারো এই ব্যাধি থাকলে সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে জেনেটিক্স কাউন্সিলরের সরণাপন্ন হতে হবে। এখানে খেয়াল রাখতে হবে যে, গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্য ঝুঁকির সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে মা ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ঝুঁকির মাত্রা কমিয়ে নিয়ে আসাটাই এখানে মূল উদ্দেশ্য।
আরও পড়ুন: ব্লু জোন রহস্য: রোগহীন দীর্ঘজীবী সম্প্রদায়ের খোঁজে
একজন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীকে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী স্বাস্থ্যকর জীবন ধারণ পদ্ধতি মেনে চলতে হয়। এখানে প্রথমেই নজর দিতে হয় খাবারের দিকে। এ সময় সহায়ক খাবারের তালিকায় যুক্ত করতে হবে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল ও সবজি। যেমন- কমলা, আঙ্গুর, সবুজ ও লাল মিষ্টি মরিচ, স্ট্রবেরি, কিউই ফল, ফুলকপি, এবং টমেটো।
তবে এড়িয়ে চলতে হবে আয়রন সমৃদ্ধ খাবারগুলো। এই তালিকায় রয়েছে মাছ, মাংস এবং পালং শাক।
খাদ্যাভ্যাস গঠনের পাশাপাশি মনোন্নিবেশ করতে হবে শরীর চর্চার প্রতিও। মূলত এই খাদ্যাভ্যাস ও শরীর চর্চা পরিপূর্ণ ভাবে থ্যালাসেমিয়া নিরাময় করতে পারে না। তবে ঝুঁকির তীব্রতা অনেকটা উপশম করা যায়।
আরও পড়ুন: জিমে অনুশীলনের সময় সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়ানোর উপায়
পরিশিষ্ট
থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণ ও লক্ষণগুলোর ব্যাপারে সম্যক ধারণা নিয়ন্ত্রিত জীবনধারা বজায় রাখার মোক্ষম হাতিয়ার। খাবার ও ওষুধ গ্রহণে ভিটামিনের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। আর এড়িয়ে চলতে হবে আয়রন উপাদান।সর্বপরি, ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে নিত্যদিনের করণীয়গুলো সাজালে মুক্তি মিলতে পারে গুরুতর জটিলতাগুলো থেকে। দীর্ঘমেয়াদে যা সহায়ক হতে পারে আয়ু বৃদ্ধির ক্ষেত্রে।
৭ মাস আগে