ইসলামিক ব্যাংকিং
দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের অবদান প্রশংসনীয়
বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের পথচলা শুরু ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির হাত ধরে। দীর্ঘ ৪১ বছরে ব্যাংকিংয়ের শরিয়াহ ভিত্তিক ধারাটি বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। শরিয়াহ ভিত্তিক সেবামুখী ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কল্যাণ ধারার এ ব্যাংকিং সেবার পরিধি সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে দেশের অর্থনীতি ও উদ্যোক্তা সমাজকে জড়িয়ে রাখতে বিশেষ অবদান রেখে যাচ্ছে ইসলামিক ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থা।
পরিসংখ্যান বিবেচনায় দেশের ব্যাংক খাতের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই এখন ইসলামি ধারার ব্যাংকিংয়ের আওতাধীন। এ জনপ্রিয়তার কারণে বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ ধারার ১০টি ইসলামি ব্যাংকের পাশাপাশি প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোও যুক্ত হচ্ছে শরিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকিং কার্যক্রমে। অনেক ব্যাংক তো বিশেষায়িত শাখা ও উইন্ডোর মাধ্যমে চালাচ্ছে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম।
আরও পড়ুন: ভোটার উপস্থিতি কতটা জরুরি?
ইসলামি আর্থিক খাতকে এখন তার সম্পদের পরিপ্রেক্ষিতে যেমন বিভিন্ন ধরনের ইসলামিক অর্থায়ন, ইসলামিক বন্ড (সুকুক), ইসলামিক মিউচুয়াল ফান্ড এবং ইসলামিক বিমা (তাকাফুল) ইত্যাদির মতো স্থানে অবস্থানের কারণে একটি বৈশ্বিক আর্থিক খাত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ঝুঁকি ভাগাভাগি, অন্তর্ভুক্তি ও প্রকৃত সম্পদভিত্তিক লেনদেনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত হচ্ছে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বিশ্ব পরিসরেও ইসলামি ব্যাংকিং এক অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। শুধু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে নয়; বরং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মনি, আর্জেন্টিনা, ডেনমার্ক, লুক্সেমবার্গ, সুইজারল্যান্ড ও ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কয়েকশ ইসলামি ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান শরিয়াহ সম্মত পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে। দ্যা ব্যাংক অব উইটিয়ার-যুক্তরাষ্ট্র, আল রায়ান ব্যাংক পিএলসি-যুক্তরাজ্য, কেটি ব্যাংক-জার্মানি, দাউদ ইসলামিক ব্যাংক-আর্জেন্টিনা, ও ইসলামিক ব্যাংক ইন্টারন্যশনাল অব ডেনমার্ক উল্ল্যেখযোগ্য।
বিশ্বব্যাপী ইসলামি ব্যাংকগুলোর মোট সম্পদের পরিমাণ তিন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর বিশ্বব্যাপী ইসলামিক ফাইন্যান্সের মোট সম্পদের পরিমাণ চার ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি, যা আগামী ২০২৬ সাল নাগাদ প্রায় ছয় ট্রিলিয়নে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। বৈশ্বিক এ প্রবণতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও এখন দিনে দিনে আরো শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলছে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিগত সহায়তাও খাতটির বিকাশে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিগত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে আমানত ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়ে দেশে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ হয়েছে।
শাখা ও কার্যক্রয় বিবেচনায় ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের সম্প্রসারণ হয়েছে ব্যাপক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য মতে, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক ছিল ১০টি। সারা দেশে ১ হাজার ৬৭১ টি শাখার মাধ্যমে কার্যক্রম চালাচ্ছে ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে একই সময়ে দেশের পুরো ব্যাংক খাতে শাখা ছিল ১১ হাজার ২১৯টি। শাখার শতাংশের বিবেচনায় দেশের পুরো ব্যাংকিং খাতের ১৫ শতাংশ শাখা ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকের পাশাপাশি প্রচলিত ধারার ১৫টি ব্যাংকের ৩০টি ইসলামি ব্যাংকিং শাখা কাজ করছে। এছাড়া ১৫টি প্রচলিত ধারার বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৬১৫টি ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডো এখন বাংলাদেশে ইসলামি আর্থিক সেবা দিচ্ছে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও আমানত সংগ্রহের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে ইসলামিক ব্যাংকিং। ইসলামিক ব্যাংকিং কার্যক্রমের দ্রুত আমানত সংগ্রহ ও সফলতার কারণে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর কাছেও তা ধীরে ধীরে আকর্ষণীয় ও লাভজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ যে ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী তা ইসলামিক ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি দেখেই বুঝা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে মোট আমানত ছিল ৪৩১৯.৮৯ বিলিয়ন টাকা। ২০২২ সালের একই প্রান্তিকের আমানত থেকে প্রায় ৩৯.৮৯ বিলিয়ন টাকা বেড়েছে যার প্রবৃদ্ধি ০.৯৩ শতাংশ। প্রচলিত ব্যাংকের উইন্ডোতে আমানত স্থিতি ১৯৩.৮৩ বিলিয়ন টাকা ও প্রচলিত ব্যাংকের শাখায় আমানত স্থিতি ১৭৪.৬৪ বিলিয়ন টাকা। ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকের মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার ৯১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। সব ইসলামিক ব্যাংকের মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির (আইবিবিপিএলসি) আমানত ছিল ৩৪.৫৪%। তাছাড়া, ইসলামী ব্যাংকের বর্তমানে ৩৯৪ টি শাখা ও ২৪৯টি উপশাখায় মোট ২ কোটি ৩০ লাখ গ্রাহকের আমানত নিয়ে দেশে প্রথম সারির ব্যাংকে অবস্থান করছে।
বিনিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা জাতীয় উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বৃহৎ শিল্প, সিএমএসএমই তথা কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, ও মাঝারি বিনিয়োগে বৃহদাংশ অবদান যেমন রেখেছে তেমনি নির্মাণ খাত, সেবা শিল্প, ভোক্তা বিনিয়োগ, কৃষি খাত, মৎস্য খাতে বিশেষ অবদান রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের সর্বশেষ তথ্য মতে ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ৪২৯০.৭১ বিলিয়ন টাকা দেশে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ বিতরণ করা হয় যা বিগত ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের চেয়ে ৭৫.৯৫ বিলিয়ন টাকা বেশি। দেশের সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের বিনিয়োগের মধ্যে ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিনিয়োগ ২৮ শতাংশ। দেশের ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি এতে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে যেখানে বিনিয়োগ বিতরণ করেছে প্রায় ৩৩.৬৫ শতাংশ।
আরও পড়ুন: স্বাধীন দেশের প্রথম শীতের স্মৃতি
ইসলামী ব্যাংক খাত বৈদেশিক রেমিট্যান্স সংগ্রহ এবং বিতরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০২৩ সালে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মোট রেমিট্যান্স সংগ্রহ হয়েছে ২৮০.৪৭ বিলিয়ন টাকা, যা পূর্ববর্তী প্রান্তিকের চেয়ে ৭৮.২৫ বিলিয়ন বা ২৬.৩৮ শতাংশ বেশি। ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে রেমিট্যান্স সংগ্রহে তৃতীয় প্রান্তিকে শীর্ষস্থান (৪৮.১৪%) ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি।
ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা কৃষি ও গ্রামীণ বিনিয়োগ কর্মসূচির বিভিন্ন উপখাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষি খাতে ১৫.৯০ বিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ করা হয়। দেশের সমগ্র ব্যাংকিং খাতের কৃষি বিনিয়োগ বিতরণের ১৬.৪৭ শতাংশ ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে বিতরণ করা হয়।
ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের লক্ষ্যই হলো ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে সামাজিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক মুক্তি আনা। ব্যবসায় সামাজিক দায়বদ্ধতা পরিপালনে ইসলমিক ব্যাংকগুলো সারা বিশ্বে যেমন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে তেমনি বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। ইসলামিক ব্যাংকগুলো ব্যবসায় সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কার্যক্রমের আওতায় বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ করে যাচ্ছে।
ইসলামি ব্যাংকগুলো যাকাত, খেলাপি বিনিয়োগ ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে শাস্তিমূলক চার্জ হিসেবে নেওয়া ক্ষতিপূরণ চার্জ এবং শরিয়াহ অনুমোদিত উপার্জনের অন্যান্য উৎস থেকে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে সিএসআর কার্যক্রম করে থাকে। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য ও দাতব্য সংস্থা সহ বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজ যেমন বেওয়ারিশ লাশ দাফন, নবজাতককে উপহার, বনায়ন ও ফলবিথীতে ব্যয় করা হয়।
এ দিক দিয়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি বাংলাদেশ ব্যাংকের সিএসআর নীতি পরিপালন করে সর্বোচ্চ পরিমাণ সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ব্যাংকের ২০২২ সালের তথ্যানুসারে ইসলামী ব্যাংক সরকারি ত্রাণ তহবিলসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, কর্মহীন, অসহায় ও দরিদ্র মানুষদের মাঝে সর্বমোট ৩২৭.৩৬ কোটি টাকা বিতরণ করেছে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে সিএসআর বিতরণের হার ব্যাংকিং সেক্টরের মোট সিএসআর ব্যয়ের ২৯ শতাংশ। ২০২৩ সালের তথ্যানুসারে ব্যাংক সর্বমোট ১০০ কোটি টাকারও বেশি সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমে ব্যয় করেছে। এছাড়া, ইসলামী ব্যাংক এ পর্যন্ত সর্বমোট ১,৬৫৮ কোটি টাকা প্রায় ২ কোটি উপকারভোগীদের মাঝে সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমের আওতায় ব্যয় করেছে।
আরও পড়ুন: যুক্তরাজ্যে মামলা এবং ১৯৭১-এর ইতিহাসের ভবিষ্যৎ
৬ মাস আগে