গুরুতর নির্যাতন
গুরুতর নির্যাতনের বিষয়ে জাতিসংঘের তদন্তে বাংলাদেশের সহযোগিতা চায় এইচআরডব্লিউ
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলেছে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক গুরুতর নির্যাতনের তদন্ত ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে একটি স্বাধীন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের আসন্ন অধিবেশনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে একটি প্রস্তাব চাওয়া উচিত।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যান্য কর্মকর্তাদের কাছে লেখা এক চিঠিতে এ কথা বলেছে সংস্থাটি।
এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) থেকে পর্যবেক্ষণ করা উচিত এবং কাউন্সিলে প্রতিবেদন প্রকাশ করা উচিত। ২০২৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৫৭তম অধিবেশন শুরু হবে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে গুম, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে একটি স্বাধীন অভ্যন্তরীণ তদন্ত কার্যক্রম শুরুর জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত ওএইচসিএইচআর এবং জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করা।
এই অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াটিকে জাতিসংঘের সহায়তা এবং পর্যবেক্ষণের সঙ্গে কাজ করা উচিৎ, যাতে এর স্বাধীনতা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ড মেনে চলা নিশ্চিত করা যায়।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বাইডেন-মোদির আলোচনা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় গুরুত্বারোপ
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জেনেভায় জাতিসংঘের উপপরিচালক লুসি ম্যাককার্নান বলেন, ‘গণবিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর অতীতের হিসাব-নিকাশের গুরু দায়িত্ব দেশকে অধিকার-সম্মানজনক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাওয়া।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত সাম্প্রতিক নির্যাতনের বিষয়ে মানবাধিকার কাউন্সিল সমর্থিত তদন্তকে সহযোগিতা করা এবং সাবেক সরকারের ১৫ বছরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে স্বাধীন অভ্যন্তরীণ তদন্তের জন্য জাতিসংঘের সমর্থন চাওয়া।’
এতে আরও বলা হয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বেসামরিক তদারকি আনা, কুখ্যাত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ভেঙে দেওয়া, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার এবং অবমাননাকর আইন সংশোধন করার পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা।
শেখ হাসিনার পতনের আগে বিক্ষোভ দমন-পীড়ন ছিল বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী। ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে কমপক্ষে ৪৪০ জন নিহত এবং হাজার হাজার আহত হয়েছে। যার বেশিরভাগই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অতিরিক্ত বল প্রয়োগ এবং শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র ও যুব সংগঠনের সহিংসতার কারণে নিহত ও আহত হয়েছে।
এইচআরডব্লিউ বলছে, ৫ আগস্টের পর আনুমানিক আরও ২৫০ জন মারা গেছে, যাদের বেশিরভাগই শেখ হাসিনার সমর্থকদের সহিংস প্রতিশোধের শিকার।
এতে বলা হয়েছে, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এমন কর্মকর্তাদের বদলি করেছে, যারা রাজনৈতিক পক্ষপাতের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। পদত্যাগের দাবিতে করা বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। হাসিনা সরকারের পতনের পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ভেঙে পড়েছিল। হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সহিংসতার ঝুঁকিতে ফেলেছিল। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলেছে বেশিরভাগ পুলিশ স্টেশন এখন কাজ করছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, তবে মানবাধিকার কর্মীরা আশঙ্কা করছেন, কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকসহ আওয়ামী লীগের কর্মকর্তা ও সমর্থকদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং যথাযথ প্রক্রিয়া ও আইনি পরামর্শের যথাযথ সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে পূর্ববর্তী সরকারের ন্যায় অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি করছে।
ইউনূস প্রশাসন প্রকাশ্যে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে, সহিংসতা দমনের জন্য কাজ করেছে এবং বিক্ষোভ দমনে অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের জন্য দায়ীদের তদন্ত ও বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিক্ষোভের সময় আটক রাজনৈতিক বন্দিদেরও দ্রুত মুক্তি দিয়েছে, কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করেছে, গুম থেকে সকল ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কনভেনশনে সই করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত জোরপূর্বক গুমের ৭০০টিরও বেশি ঘটনা তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গাদের ন্যায় বিচারের দ্বার উন্মোক্ত হয়েছে: এইচআরডব্লিউ
এইচআরডব্লিউ জানিয়েছে, অত্যন্ত বিভক্ত রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার প্রতি তার প্রতিশ্রুতি কার্যকরভাবে অনুসরণ করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত মানবাধিকার কাউন্সিলকে একটি স্বাধীন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে বলা। যা ঘটনার তদন্ত,তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ করবে এবং প্রমাণ বিশ্লেষণ করবে। একই সঙ্গে জুলাই ও আগস্টের সহিংসতা এবং এর মূল কারণগুলোর বিষয়ে জবাবদিহিতার জন্য বিশ্বাসযোগ্য এবং স্বাধীন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিচার বিভাগকে সহযোগিতা করার একটি বিস্তৃত ম্যান্ডেট সহ একটি স্বাধীন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে বলা উচিত।
মানবাধিকার কাউন্সিলের নির্দেশিত তদন্ত বাংলাদেশিদের কাছে সর্বাধিক স্বাধীনতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে। যারা দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবিশ্বাস করে এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এড়াতে পারে। এটি সম্পূর্ণরূপে অভ্যন্তরীণ পদক্ষেপকে দুর্বল করতে পারে।
এতে বলা আরও হয়, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে এবং নিয়মিত প্রতিবেদন দিতে ওএইচসিএইচআরকে বাধ্যমূলক করা উচিত কাউন্সিলের প্রস্তাবটিতে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি যে অসমভাবে বণ্টন করা হয়েছে, সাম্প্রতিক এই বিক্ষোভ তারই প্রতিফলন। সবার জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সামাজিক সুরক্ষার সংস্কার করা উচিত। ঘুষ দিতে অক্ষমতার কারণে বা সামাজিক বা রাজনৈতিক সংযোগের অভাবের কারণে কেউ যাতে নাগরিক সুবিধা থেকে বাদ না পড়ে তা নিশ্চিত করা উচিত।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, দীর্ঘস্থায়ী মানবাধিকার পরিবর্তন আনতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রতিষ্ঠান, সুরক্ষা খাত এবং এর বিচার ও আইনি ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। যা পূর্ববর্তী সরকার এবং পূর্ববর্তী প্রশাসনের অধীনে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এতে বলা হয়, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত সব নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর শক্তিশালী মানবাধিকার প্রশিক্ষণ প্রটোকল বাস্তবায়ন করা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর অপব্যবহারের দায়মুক্তি দেয় এমন আইন বাতিল করা।
ম্যাককার্নান বলেন, 'স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতে গভীর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং জাতিসংঘের সহায়তা ছাড়া বাংলাদেশের কষ্টার্জিত অগ্রগতি সহজেই হারিয়ে যেতে পারে। জাতিসংঘ ও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উচিত সত্যানুসন্ধান ও জবাবদিহিতার পদক্ষেপগুলোকে সমর্থন এবং অধিকারভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক ও নিরাপত্তা খাতের সংস্কারে বিনিয়োগ করে সব বাংলাদেশির প্রতি তাদের সমর্থন প্রদর্শন করা।’
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গাদের ওপর ২০১৭ সালের নৃশংসতার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধানের
৩ মাস আগে