নিরাপত্তা এজেন্ডা
বাংলাদেশের প্রয়োজন 'ব্যাপক ও দূরদর্শী' নিরাপত্তা এজেন্ডা: গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এ এন এম মুনিরুজ্জামান বলেছেন, বাংলাদেশ এখন যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি তা কার্যকরভাবে মোকাবিলায় একটি ‘বিস্তৃত ও দূরদর্শী নিরাপত্তা এজেন্ডা’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সময়ে জাতীয় নিরাপত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অনন্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) 'বাংলাদেশ ২.০: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য একটি নতুন নিরাপত্তা এজেন্ডা' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন।
মুনিরুজ্জামান বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে ফ্যাসিবাদ থেকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তরের সঙ্গে গণতন্ত্রের সহজ ও শান্তিপূর্ণ উত্তরণ নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, প্রথম যে কাজটি হাতে নেওয়া দরকার তার মধ্যে একটি হচ্ছে সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশসহ নিরাপত্তা খাতের ব্যাপক সংস্কার।
মিয়ানমারের সাবেক ডিফেন্স অ্যাটাশে ও লিবিয়ায় সাবেক রাষ্ট্রদূত শহীদুল হক, বিআইপিএসএস সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাফকাত মুনির এবং ডেইলি স্টারের সাবেক সহযোগী সম্পাদক ও ডিফেন্স অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক অ্যাফেয়ার্সের সম্পাদক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) শাহেদুল আনাম খান গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্য দেন।
শহীদুল হক বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকির বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার পাশাপাশি এই ইস্যুতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কী নীতি গ্রহণ করা উচিত সে বিষয়ে তার মতামত ব্যক্ত করেন।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে কাজ করবে দিল্লি
তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, বাংলাদেশকে এমন একটি নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে, যা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ও বাণিজ্য রুট নিয়ন্ত্রণকারী আরাকান আর্মির মতো অরাষ্ট্রীয় শক্তিগুলোর সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করবে তা নির্দেশ করে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়ে পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে ভূ-কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে মিয়ানমার সংকটকে বাংলাদেশের কীভাবে মোকাবিলা করা উচিত সে বিষয়েও কথা বলেন শহীদুল হক।
সব দেশের সঙ্গে আলোচনার সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কীভাবে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রাখবে, সে বিষয়ে আলোচনা করেন তিনি।
শাফকাত মুনির সার্বক্ষণিক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) এবং পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় নিরাপত্তা সমন্বিত সচিবালয়ের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি আরও বলেন, এই জাতীয় সচিবালয়ের ডোমেন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ থাকা দরকার।
মুনির সাইবার নিরাপত্তা, জলবায়ু নিরাপত্তার মতো নতুন ও উদীয়মান হুমকি মোকাবিলা এবং সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস চরমপন্থা মোকাবিলায় অব্যাহতভাবে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকি ও চ্যালেঞ্জ পর্যালোচনা এবং জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়নের এখনই উপযুক্ত সময়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা এজেন্ডা পুনরুজ্জীবিত না হলে 'বর্ষা বিপ্লবের' আকাঙ্ক্ষা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে না। তিনি বাংলাদেশ ২.০ এর বিশ্বব্যাপী সমর্থন আদায়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
বিদেশে বাংলাদেশের ব্যাপক কার্যক্রম বিশেষ করে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক-সামরিক সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন মুনির।
তিনি বাংলাদেশে সামরিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ পুনর্গঠন ও পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়েও কথা বলেন। নিরাপত্তা খাতের সম্পূর্ণ বিরাজনীতিকরণের প্রয়োজনীয়তার কথাও পুনর্ব্যক্ত করেন মুনীর।
শাহেদুল আনাম খান তার নিজের মন্তব্যে সর্বপ্রথম শ্রোতাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন কেন বিপ্লব ঘটানোর প্রয়োজন।
তিনি নিরাপত্তা এজেন্ডা নিয়ে কথা বলার আগে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় ধরনের নিরাপত্তা হুমকি চিহ্নিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, 'দেশের মানুষ সুরক্ষিত না হলে জাতি গঠন হতে পারে না।’
সবকিছুর ঊর্ধ্বে জনগণের নিরাপত্তার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, সুশাসন ছাড়া কোনোভাবে নিরাপত্তা বজায় রাখা যায় না।
তিনি আরও বলেন, হাসিনা সরকারের সুশাসনের কোনো বৈশিষ্ট্যই ছিল না।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আনাম বলেন, আমাদের দেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সেবক, প্রভু নন এবং তাদের পরিচালনা করতে হবে, শাসন নয়।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, নিরাপত্তা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অপব্যবহার ও রাজনীতিকরণ করা হয়েছে এবং সম্পূর্ণ বিরাজনীতিকরণ হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, দোষ এজেন্সিগুলোর নয় বরং হাসিনা সরকারের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের। যারা তাদের নিজের স্বার্থে এগুলোর অপব্যবহার করেছে।
প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতিবিষয়ক বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবদুল হাফিজ (অবসরপ্রাপ্ত) গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত থেকে এ বিষয়ে তার চিন্তাভাবনা তুলে ধরেন।
সঞ্চালক মুনিরুজ্জামান প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়ে সংসদীয় তত্ত্বাবধান পুনরুজ্জীবিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বিশেষ করে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গণতান্ত্রিক তদারকির ওপর জোর দেন, যাতে আর কখনো আয়নাঘরের মতো অতীতের ভয়াবহতার পুনরাবৃত্তি না করতে হয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে অবশ্যই নতুন ও উদীয়মান হুমকি যেমন হাইব্রিড যুদ্ধ এবং 'গ্রে জোনে' লড়াই করার সক্ষমতা থাকতে হবে। তিনি সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকীকরণের প্রয়োজনীয়তার উপরও জোর দেন।
এক আলোচনা পর্বে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ, সীমান্ত নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা কৌশলের গুরুত্ব, জাতি যে বিশাল ঋণের মুখে পড়েছে তা কীভাবে মোকাবিলা করবে ইত্যাদি বিষয় উত্থাপিত ও আলোচনা করা হয়।
অনুষ্ঠানে সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান, রাষ্ট্রদূত, সিনিয়র কূটনীতিক, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি সংস্থার প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের সদস্য, গণমাধ্যমকর্মী ও শিক্ষাবিদ এবং বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বাইডেন-মোদির আলোচনা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় গুরুত্বারোপ
২ মাস আগে