সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধন
সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধনের আহ্বান: টিআরএনবির সেমিনারে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
সাইবার নিরাপত্তা আইনটিতে কিছু বিতর্কিত বিষয় থাকলেও, এটি দেশের ডিজিটাল অবকাঠামো রক্ষা, অনলাইন লেনদেনের নিরাপত্তা এবং সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় অপরিহার্য বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এছাড়াও জাতীয় নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন তারা।
রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (টিআরএনবি) ও আনোয়ার টেকনোলজিসের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন: নিরাপত্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ভারসাম্য’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এই বিষয়গুলো আলোচনায় উঠে আসে।
এ গোলটেবিল আলোচনায় নাগরিকদের বাকস্বাধীনতা রক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তার গুরুত্ব তুলে ধরে বাংলাদেশ সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩-এ জরুরি সংশোধনের আহ্বান জানান আইন বিশেষজ্ঞ, আইসিটি প্রতিনিধি ও মিডিয়া পেশাজীবীরা।
বক্তারা বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন বর্তমান ডিজিটাল যুগে অপরিহার্য, যা হ্যাকিং, পরিচয় চুরি ও সাইবার প্রতারণার মতো ক্রমবর্ধমান হুমকি থেকে সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামো প্রদান করে। এটি আর্থিক ও জ্বালানি খাতসহ গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করে, নিরাপদ ডিজিটাল লেনদেনের সুযোগ বাড়ে এবং অনলাইন সেবার প্রতি জনগণের আস্থা আরও সুদৃঢ় করে।
বক্তারা আরও বলেন, সাইবার কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ ও ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে সাইবার আইন একটি নিরাপদ ডিজিটাল পরিবেশ তৈরি করে এবং ই-কমার্স ও প্রযুক্তির উন্নয়নে উৎসাহ দেয়। এটি নিরাপত্তা ও উদ্ভাবনের মধ্যে ভারসাম্য রেখে নাগরিক, ব্যবসা ও দেশের ডিজিটাল অবকাঠামোর সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
তারা বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারা যেমন ডিজিটাল বিষয়বস্তু ব্লক করা এবং ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তার উদ্বেগ তৈরি করছে। এই আইনটি ভিন্নমত দমন এবং বাক স্বাধীনতা সীমিত করার জন্য ব্যবহার হতে পারে। 'অপপ্রচার ছড়ানো' বা 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা' এর মতো অস্পষ্ট শব্দগুলো সাংবাদিক ও সরকারের সমালোচকদের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। এতে আইনটি নাগরিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করতে পারে এবং বৈধ অনলাইন অভিব্যক্তিকে দমন করতে পারে। এ কারণে তারা বিতর্কিত ধারা সংশোধনের আহ্বান জানিয়েছেন।
এসময় সাইবার সুরক্ষা আইন হালনাগাদ করা হচ্ছে জানিয়ে গোলটেবিল আলোচনায় মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে ‘সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না নীতি গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তথ্যপ্রযুক্তি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী।
আরও পড়ুন: সাইবার নিরাপত্তা আইন অবশ্যই বাতিল করা উচিত: আসিফ নজরুল
তিনি বলেন, সুরক্ষার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বড় ইস্যু। আইনের ভাষায় নেতিবাচক কিছু আছে কি না সেটা দেখতে হবে। আইন নিবর্তনমূলক হওয়া যাবে না।
সাইবার সুরক্ষায় করণীয় বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি সচিব বলেন, ৩৬ আগস্টের বিপ্লবের মাধ্যমে আমরা বাক-স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছি। একে অর্থবহ করতে আমাদের সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। আমার দপ্তর থেকে মাত্র তিন-চার জন ব্যক্তি দিয়ে জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ (এনসিএসএ) চলছে। অথচ একে আরও শক্তিশালী করা দরকার। একইসঙ্গে নাগরিকদের নিয়ে বেশি বেশি নাগরিক সংলাপ করতে চাই। সব পক্ষের মত নিয়েই এই আইন সংশোধন করা হবে।
অপর মুখ্য আলোচক বিটিআরসি চেয়ারম্যান এমদাদ উল বারী বলেন, ডেটা সুরক্ষা ও তথ্য শেয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা সহজ নয়। এর মধ্যে রয়েছে ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ভেদের দ্বন্দ্ব। এর মধ্যে সবচেয় বড় চ্যালেঞ্জ বাক-স্বাধীনতায় ভারসাম্য রক্ষা। সংস্কৃতি, জাতীয়তার সীমার মধ্যে যদি আমরা দূরত্ব কমাতে পারি তাহলে সমাধান সহজ হবে। এই সমাধানটা নিজেদের মতো করে ‘সেলাই’ করতে হবে। ডিজিটাল অপরাধ সনাক্তের জন্য আইন করতে হবে। কোন প্রযুক্তি আমরা কীভাবে ব্যবহার করব সে জন্য আগাম চিন্তা করে আগামীতে কোন মূল্যবোধ নিয়ে চলব, কতটুকু যন্ত্রের ওপর নির্ভর করব তা নির্ধারণ করতে পারব।
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, অপরাধকে অপরাধের গুরুত্ব ও প্রভাবের মাত্রা অনুযায়ী বিচার হওয়া দরকার। আসলে নতুন মাধ্যমে অপরাধ প্রমাণের সক্ষমতা আমাদের দরকার। রাষ্ট্রীয়ভাবে তথ্যের নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আইন করে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। প্রযুক্তি উন্নয়নের সঙ্গে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
রবির কোম্পানি সচিব ব্যারিস্টার সাহেদ আলম বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৬০টি ধারারর মধ্যে ৩৭টি ধারাই ছিল অপরাধ চিহ্নিত করার জন্য। এতে ১৮টি অপরাধ গণ্য করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ বৈশ্বিক সাইবার অপরাধের দিক দিয়ে ভালো অবস্থানে আছে। তবে ই-গভর্নেন্সে আমরা পিছিয়ে আছি। তাই আমাদের কিসের জন্য কোন আইন দরকার তা আগে নির্ধারণ করতে হবে। আমার মনে হয়, বিদ্যমান আইনটি সংশোধন করার কিছু নেই। তাই এটি পুরোপুরি বাতিল করে নতুন করে করা উচিত। ডিজিটাল ইকোনমি যুক্ত করে টেলিকম আইনটিও হালনাগাদ বা নতুন করে করা দরকার।
বেসিস সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, বাকস্বাধীনতায় ভারসাম্য রক্ষায় সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এজন্য স্কুল থেকেই গঠনমূলক সমালোচনা করার সচেতনতা খুবই প্রয়োজন। এভাবেই সেলফ সেন্সরশিপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর পাশাপাশি ডিজিটাল ফরেনসিক কীভাবে ও কতটুকু পর্যন্ত আদালতে গ্রহণযোগ্য সেদিকে নজর দিতে হবে। আমাদের দেশে ডেটা প্রাইভেসি না থাকায় আমাদের ব্যবসাও হুমকির মুখে পড়বে। তাই সবার আগে সেন্সেটিভিটির ওপর ভিত্তি করে ডেটা ক্যাটাগারাইজেশন করা দরকার। একইসঙ্গে আমরা নাগরিককে কতটা সার্ভিলেন্সে আনতে পারি, লিগ্যাল ইন্টারসেপশন করতে পারি সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েই আইন করতে হবে। তা না হলে মানুষ আইন ভাঙতে চেষ্টা করবে। তাই আইন তৈরির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
এমটব মহাসচিব মোহাম্মদ জুলফিকার নতুন আইন করার ক্ষেত্রে অপরাধকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে উপধারাগুলোকে সুনির্দিষ্ট করতে হবে। আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সংশোধনের সুযোগ রাখতে হবে। অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এগিয়ে যেতে হবে। অপরাধ শনাক্তকরণে বিচারকদের প্রশিক্ষিত করতে হবে।
বিডি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কায়সার হামিদ বলেন, দেশের আর্থিক খাত খুবই ঝুঁকিপ্রবণ। প্রতিদিন দেশের আর্থিক খাতে ৬৩০টি সাইবার আক্রমণ হয়। তাই সাইবার অপরাধ কীভাবে ঘটে তা নির্ধারণ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ঠিক করতে হবে। ডেটাসুরক্ষা আইন করতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কার্যকরভাবে সিকিউরিটি অপারেশন সেন্টার তথা ছক বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি ম্যানেজড ছক গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে দেশে কোন তথ্য রাখা বাধ্য করতে হবে তা নির্ধারণ করা দরকার।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই নাবিল বি আরিফ বলেন, সাইবার নিরাপত্তার আইনে শাস্তি নয় সুরক্ষাকেই গুরুত্ব দেওয়া দরকার। সাম্প্রতিক সময়ের দুর্ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় সামালোচনার জন্য যে ধরনের কাণ্ড ঘটেছে তা দুঃখজনক। এটা আইনের কাজ নয়। তাই আমাদের আইনের ভাষা পরিচ্ছন্ন ও বোধগম্য হতে হবে। মানুষের নিরাপত্তাকেই সবার ওপরে গুরুত্ব দিতে হবে যেন তারা ভীত না হন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, অপরাধের ধরন অনুযায়ী অপরাধের ক্ষত তৈরি হয়। এজন্য বিচার বিভাগীয় তদারকি থাকা দরকার। ফেসবুক পোস্ট কন্টেন্ট সংশ্লিষ্ট অপরাধ। এটাই সব নয়। তাই বাকস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ সাইবার সুরক্ষা আইনে প্রাধান্য পাওয়া উচিত নয়। এজন্য আমাদের ছাত্র-শিক্ষক-ব্যাবসায়ী-জনতার অংশগ্রহণে এই আইন করা দরকার। তা না হলে বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।
আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রযুক্তি বিভাগ আনোয়ার টেকনোলজিসের সহপ্রতিষ্ঠাতা ওয়ায়েজ আর হোসেন বলেন, সাইবার ক্রাইমের মধ্যে বাক-স্বাধীনতা, অনলাইন হ্যারাজমেন্ট, সাইবার বুলিং ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। তরুণদের পাশাপাশি, নাগরিক ও ব্যবসাকেও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
আরও পড়ুন: সাইবার আইনের মামলা প্রত্যাহার হচ্ছে, গ্রেপ্তাররা মুক্তি পাচ্ছেন
২ মাস আগে