পলিথিনের ব্যাগ
প্লাস্টিক পণ্য বর্জনের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক পদ্ধতি অনুসরণের আহ্বান সংশ্লিষ্টদের
রাজধানীর নিউ ইস্কাটনের বাসিন্দা গোলাম রাব্বি তার এলাকায় স্বপ্ন সুপার শপের আউটলেটে কেনাকাটা করতে যান। প্রয়োজনীয় পণ্য নেওয়ার পর সেগুলোর মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে পণ্য বহনের পাটের ব্যাগের জন্য বাড়তি ১১ টাকা দেওয়া নিয়ে ক্যাশ কাউন্টারে দায়িত্বরত কর্মীর সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে যান তিনি।
গত ১ অক্টোবর থেকে সরকার সুপার শপে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পর থেকে এ ধরনের বিবাদ প্রায়ই দেখা যাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত ১১ টাকা দিয়ে পাটের ব্যাগ কেনা নিয়ে বিরক্ত হয়ে প্রায় ১৩০০ টাকা মূল্যের সামগ্রী না কিনেই আউটলেট ছেড়ে চলে যান রাব্বি।
বিক্রয়কর্মীরা সুপার শপগুলোতে সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী পলিথিনের ব্যাগ নিষিদ্ধ করার বিষয়টি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলেও তিনি এ ব্যাখ্যা মানতে রাজি হননি।
সরকারি নিষেধাজ্ঞার পর থেকে সুপার শপগুলোয় পলিব্যাগের পরিবর্তে কাগজের ব্যাগে মাছ, মাংস ও অন্যান্য হিমায়িত পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। যা নিয়ে ক্রেতা-বিক্রয়কর্মীদের মধ্যে এমন ভুল বুঝাবুঝির ঘটনা অহরহ ঘটছে।
আরও পড়ুন: মাইক্রো প্লাস্টিক কী? কীভাবে এটি মানবদেহে প্রবেশ করে? কী কী প্রভাব ফেলে?
বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৮৭ হাজার টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়, যার বেশিরভাগই বর্জ্যে পরিণত হয়। এ কারণে সরকার মুদি ব্যাগ থেকে শুরু করে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার কমানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিক দূষণ বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ সমস্যায় পরিণত হচ্ছে। দেশের দ্রুত শিল্পায়ন ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে প্লাস্টিক পণ্যের চাহিদা বেড়েছে।
এছাড়াও অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অবকাঠামোও এর জন্য দায়ী। বিশেষ করে শহরাঞ্চল ও নৌপথে ব্যাপক প্লাস্টিক দূষণের কারণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঠিকমতো না হওয়া।
এই সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক আদেশ অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৭টি খাতে 'সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক' (এসইউপি) অর্থাৎ এক বার ব্যবহার ব্যবহারের প্লাস্টিক পণ্য পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার জন্য গত ২৭ আগস্ট একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে।
প্রজ্ঞাপনে পরিবেশ সুরক্ষা ও দূষণ কমাতে অবিলম্বে এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
যা ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা
বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি শামীম আহমেদ ইউএনবিকে বলেন, ১৭টি খাতে এসইউপি নিষিদ্ধ করার আদেশ জারির আগে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা প্রয়োজন। না হলে প্রায় ৬ হাজার শিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে।
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, 'সরকারি কর্মকর্তারা এর আগেও এ ধরনের বৈঠকে অংশ নিয়েছেন কিন্তু কোনো মাঠ পর্যায়ের গবেষণা ছাড়াই। ফলে তারা (কর্মকর্তারা) বুঝতে পারছেন না এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তটি ফলপ্রসূ হবে এবং প্লাস্টিক পণ্যের বিকল্প হিসেবে কি ব্যবহার করা যায়।’
সম্প্রতি জাপানে প্লাস্টিক পণ্যের একটি কর্মশালায় যোগ দিয়ে সিঙ্গাপুর সফর করেন শামীম আহমেদ।
তিনি বলেন, এশিয়ার উন্নত দেশগুলোও বাংলাদেশের মতো প্রতিটি ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ব্যবহার করছে। কিন্তু তারা (জাপান ও সিঙ্গাপুর) শতভাগ প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে তা পুনর্ব্যবহার করে।
শামীম আহমেদ বলেন, অপর্যাপ্ত সরবরাহ, উচ্চমূল্য এবং প্লাস্টিকের বিকল্প উৎস পাওয়ার সক্ষমতার অভাবে জাপান ও সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশগুলোও এখন পর্যন্ত প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহারে সফল হতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার দিকে মনোনিবেশ করছে, যা এখন পর্যন্ত একটি ভালো বিকল্প।
আরও পড়ুন: সরকারি অফিসে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহারের নির্দেশনা
রপ্তানিমুখী ও দেশীয় ভোগ্যপণ্যে প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের উদাহরণ দিয়ে শামীম আহমেদ বলেন, আয়োডিনযুক্ত লবণ, ভোজ্যতেল ও তরল দুধের প্যাকেজিং প্লাস্টিক ছাড়া করা অসম্ভব।
২০২২ সালের ২ মার্চ জাতিসংঘের পরিবেশ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবে বিশ্বব্যাপী সার্কুলার ইকোনমিতে প্লাস্টিকের অনুপাত বিবেচনায় কার্যকর পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা তৈরির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ
প্লাস্টিক পণ্যের উপযুক্ত বিকল্প উদ্ভাবনের আগে পরিবেশ ও শিল্পকারখানা রক্ষায় প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ)। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
এছাড়াও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করা, বাস-রেল স্টেশন, পার্ক, ওয়াকওয়েসহ বিভিন্ন স্থানে প্লাস্টিক বর্জ্যের জন্য পর্যাপ্ত 'বিন' স্থাপনসহ একটি নির্দিষ্ট স্থানে প্লাস্টিক ফেলার বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দিয়েছে বিপিজিএমইএ।
শহরাঞ্চলে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট স্থাপনের বিষয়ে জানতে এবং ভর্তুকি হারে সরঞ্জাম পেতে স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউটে (এলজিআই) যোগাযোগের কথা বলা হয়েছে।
টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্লাস্টিক সার্কুলারিটি চালু করা হবে যার মাধ্যমে অন্যান্য উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হবে। এর জন্য সরকারকে প্রযুক্তি সরবরাহ এবং কম হারে সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয় এমন শিল্পখাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্লাস্টিক উৎপাদন নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয়। তাই বাংলাদেশকে এই পদ্ধতিই অনুসরণ করতে হবে, নাহলে শিল্প ব্যবস্থা পরিচালনা করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়বে। যেমন- খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, ফার্মাসিউটিক্যালস প্যাকেজ, হাসপাতালের সরঞ্জাম, কৃষি আধুনিকায়ন ও রপ্তানি প্যাকেজিং খাতগুলো প্লাস্টিক পণ্য ছাড়া চলবে না। প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করলে এসব শিল্পে ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
প্লাস্টিকসংশ্লিষ্ট শিল্পের পরিসংখ্যান
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী,
সিরিয়াল নং
শিল্পের ধরন
শিল্পের সংখ্যা
উৎপাদন মূল্য (টাকা)
১
খাদ্যপণ্য
৯৩৯৭
১২৬৩৭৪৭ মিলিয়ন টাকা
২
পানীয়
৩৭
১২৩৩৩০ মিলিয়ন টাকা
৩
তামাকজাত দ্রব্য
১৮১
২৮৬১৭১ মিলিয়ন টাকা
৪
রাসায়নিক ও রাসায়নিক পণ্য
২৫১
১২১৫২৬ মিলিয়ন টাকা
৫
ফার্মাসিউটিক্যালস, ঔষধি রাসায়নিক ও বোটানিক্যাল পণ্য
১৪৯
২৬৮৬২৪ মিলিয়ন টাকা
৬
রাবার ও প্লাস্টিক পণ্য
৯৪৩
৬৬১৪৬৯ মিলিয়ন টাকা
যা বলছেন পলিথিন বা প্লাস্টিক পণ্যের গ্রাহকরা
শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার বাংলাদেশ এসইউপি পণ্যের বড় ক্রেতা। কোম্পানিটি বাংলাদেশে ও বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমেই পণ্য বাজারজাত করে থাকে।
ইউনিলিভার প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি না হলেও তাদের পণ্যগুলো একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের প্যাকেট বা বোতলে বাজারজাতকরণ করে থাকে তারা।
ইউনিলিভারের ডিরেক্টর অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স শামীমা আক্তার ইউএনবিকে বলেন, প্লাস্টিক পণ্য বর্জনের প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
আরও পড়ুন: পলিথিন নিষিদ্ধের পক্ষে ক্রেতারা, বিকল্প নিয়ে শঙ্কা
এই ফেজ-আউট পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পণ্যের সচেতনতা ও অগ্রাধিকারের জন্য এ খাতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপের ওপর জোর দেন তিনি।
শামীমা আক্তার বলেন, ইউনিলিভার বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ দোকান মালিকের কাছে পণ্য বিক্রয় করে থাকে। পণ্যের গুণমান নিশ্চিত করার কথা বিবেচনা করে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করে তাদের বিপুল সংখ্যক পণ্য বাজারজাত করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ‘যদি প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে সাশ্রয়ী ভালো মানের কোনো প্যাকেজিং সিস্টেম তৈরি করা হয় তাহলে ইউনিলিভার সেটি ব্যবহার করতে আগ্রহী। সে পর্যন্ত প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে গবেষণার ওপর জোর দিয়ে শামীমা আক্তার বলেন, এর কোনো বিকল্প বিবেচনা করার বদলে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলার ওপর মনোনিবেশ করা উচিত।
আরও পড়ুন: পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন ও এসইউপির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সরে আসা সময়ের দাবি: উপদেষ্টা
১ মাস আগে