ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড জিওপার্ক
মালয়েশিয়ার ল্যাংকাউই দ্বীপ ভ্রমণ: দর্শনীয় স্থান, যাওয়ার উপায় এবং যাবতীয় খরচ
গন্তব্য যখন এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জ, তখন অত্যাশ্চর্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে পাওয়া যায় এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। স্বচ্ছ পানি, ঘন জঙ্গল, নিঃসীম শূন্যতার পর্বতচূড়া এ সবকিছু ছাপিয়ে উঠে উপকূলবর্তী সম্প্রদায়গুলোর প্রাণের স্পন্দন। পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা জনপদ থেকে শুরু করে কোলাহলপূর্ণ বাজার জুড়ে স্বতন্ত্র সংস্কৃতির অনুরণন। বিচ্ছিন্ন এই ভূ-খণ্ডগুলো পর্যটকদের সামনে উন্মুক্ত করে এক অফুরন্ত দিগন্ত, যেখানে মেলে নিরন্তর যান্ত্রিক জীবন থেকে পরম মুক্তি। ঠিক এমনি এক গন্তব্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার ল্যাংকাউই দ্বীপগুলো। ২০০৭ সালের ১ জুন অঞ্চলটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড জিওপার্কের মর্যাদা লাভ করে। চলুন, এই দ্বীপরাজ্যের ভ্রমণ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
ল্যাংকাউই দ্বীপের ভৌগলিক অবস্থান
উত্তর-পশ্চিম মালয়েশিয়ার উপকূল থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ৯৯টি দ্বীপের একটি দ্বীপপুঞ্জ ল্যাংকাউই। মালাক্কা প্রণালী মালয়েশিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে এই দ্বীপগুলোকে। প্রশাসনিকভাবে এই অঞ্চলটি উত্তর মালয়েশিয়ার কেদাহ প্রদেশের একটি জেলা হিসেবে রয়েছে। মালয়েশিয়ানদের কাছে এর আরও একটি নাম আছে,আর সেটি হচ্ছে—কেদাহের রত্ন।
সবগুলো দ্বীপ মিলিয়ে মোট আয়তন ৪৭ হাজার ৮৪৮ হেক্টর। মূল ল্যাংকাউই দ্বীপটি উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় ২৫ কিলোমিটার, আর পূর্ব থেকে পশ্চিমে এর কিছুটা বেশি।
আরো পড়ুন:ইন্দোনেশিয়ার বাটাম দ্বীপ ভ্রমণ: যাওয়ার উপায় ও আনুষঙ্গিক খরচ
পর্যটকদের জন্য ল্যাংকাউইয়ের প্রধান আকর্ষণগুলো
.
ল্যাংকাউই কেবল কার এবং স্কাই ব্রিজ
এশীয় দ্বীপটির যাবতীয় পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে এই কেবল কার। এটি মূলত একটি গন্ডোলা লিফ্ট, যা ল্যাংকাউই স্কাইক্যাব নামেও পরিচিত। এটি শুরু হয়েছে তেলুক বুরাউ-এর ওরিয়েন্টাল গ্রামে, আর শেষ প্রান্ত দ্বীপের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ গুনুং মাচিঞ্চ্যাং-এর শিখর। এখানে আছে দ্বীপের আরও একটি ল্যান্ডস্কেপ—ল্যাংকাউই স্কাই ব্রিজ।
কেবল কারে মোট তিনটি স্টেশন: বেস, মিডেল এবং টপ। বেস-এর ওরিয়েন্টাল ভিলেজটি একটি থিম শপিং সেন্টার, যেখানে মালয়েশিয়ান এবং ওরিয়েন্টাল স্থাপত্যশৈলীর ৩০টি ভবন রয়েছে। রাইডের জন্য অপেক্ষমান দর্শনার্থীরা এখানকার স্কাইডোম দিয়ে আশেপাশের ৩৬০-ডিগ্রি প্যানোরামিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। মিডেল স্টেশন বা মাঝে রয়েছে একটি কৌণিক স্টেশন, যেখানে গন্ডোলা লিফ্ট শীর্ষ স্টেশনে পৌঁছানোর জন্য ৪৫-ডিগ্রি বাঁক নেয়। একদম শেষে বা টপ-এ স্কাইগ্লাইড নামে একটি বাঁকানো লিফ্ট দর্শনার্থীদের টপ স্টেশন থেকে স্কাই ব্রিজে নিয়ে যায়।
বেস থেকে শীর্ষে যেতে প্রায় ১৫ মিনিট সময় লাগে। মোট ক্যারিয়ার সংখ্যা ৩৫টি, যার প্রতিটি ৬ জন যাত্রী নিতে পারে। রাইড ফি ৫৫ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১ হাজার ৫০০ টাকা (১ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত = ২৭ দশমিক ২৭ বাংলাদেশি টাকা)।
আরো পড়ুন: থাইল্যান্ডের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের চিয়াং মাই ভ্রমণ: যাওয়ার উপায় ও আনুষঙ্গিক খরচ
কিলিম কার্স্ট জিওফরেস্ট পার্ক
এই ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটটি একদিকে দর্শনীয় স্থান, অপরদিকে মালয়েশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র। পার্কটি ঘুরে দেখার সর্বোত্তম উপায় হলো নৌকা ভ্রমণ। এ সময় খুব কাছ থেকে দেখা যাবে এর ম্যানগ্রোভ বন এবং চুনাপাথরের গুহাগুলো। কিলিম, কিসাপ, ও এয়ার হাঙ্গাত—এই তিন নদীর মোহনা এসে মিলেছে এই বন উদ্যানে। এই বিশাল জলাধারটি পার্শ্ববর্তী কিসাপ গ্রাম থেকে তানজুং রু পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত।
গুনুং রায়া
৮৮১ মিটার উঁচু এই পাহাড়টি ল্যাংকাউইয়ের সর্বোচ্চ চূড়া। পর্বতশৃঙ্গ থেকে গোটা দ্বীপকে এক নজরে দেখে নেওয়া যায়। দীঘল রেইনফরেস্টের মধ্য দিয়ে এই চূড়ায় ওঠার হাইকিং পথটি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই পাহাড়ি বনে দেখা মিলবে পাতার বানর, উড়ন্ত শিয়াল, ম্যাকাক বানর, সাদা পেটের ঈগল, মাউন্টেন-হক ঈগল, এবং গ্রেট হর্নবিলের মতো বিচিত্র সব বন্যপ্রাণীর। সমগ্র প্রদেশের সব থেকে নজরকাড়া উপত্যকাগুলোর অবস্থান এই পাহাড়ে।
পান্তাই চেনাং
দ্বীপের সবচেয়ে ব্যস্ত এবং উন্নত এই সমুদ্র সৈকত ২ কিলোমিটার দীর্ঘ।
সৈকতের শ্বেত-শুভ্র বালি, নীল রঙের পানি এবং সবুজ খেজুর এখানকার পর্যটকদের মূল আকর্ষণ। এখানে প্যারাসেইলিং, ব্যানানা বোট রাইডিং, স্নরকেলিং এবং জেট স্কিইং-এর মতো বিভিন্ন ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। এই জাঁকজমক সৈকতের সবচেয়ে সুবিধাজনক বিষয়টি হচ্ছে একদম হাঁটা দূরত্বে অনেকগুলো হোটেল ও রিসোর্টের অবস্থান। এমনকি বিমানবন্দর থেকে মাত্র ১০ মিনিট দূরত্বের এই সৈকত পরিবারের সঙ্গে বিনামূল্যে ঘুরে বেড়ানোর জন্য একটি উপযুক্ত জায়গা।
আরো পড়ুন: থাইল্যান্ডের ফুকেট ভ্রমণ গাইড: যাওয়ার উপায় ও আনুষঙ্গিক খরচ
ল্যাংকাউই দ্বীপ ভ্রমণের সেরা সময়
নভেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে ল্যাংকাউইয়ে রোদ এবং সামান্য বৃষ্টি মিলে একটি ভারসাম্যপূর্ণ আবহাওয়া বজায় থাকে। দিনের বেলা তাপমাত্রা ৩২ থেকে ৩৫ এবং রাতে ২৫ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। দমকা বাতাস না থাকায় সাগরও থাকে শান্ত। তাই এই সময়টি প্যারাসেইলিং, স্নরকেলিং, এবং স্কুবা ডাইভিং-এর মতো জলবিনোদনগুলোর জন্য উৎকৃষ্ট। তাই ল্যাংকাউইয়ে ভ্রমণের জন্য শীত ও বসন্তের মৌসুমটিই বেছে নেওয়া উচিত।
মালয়েশিয়ার পর্যটন ভিসা আবেদনের পদ্ধতি
ল্যাংকাউইতে ছুটি কাটানোর জন্য বাংলাদেশি পর্যটকদের মালয়েশিয়ার সিঙ্গেল এন্ট্রি ভিজিট ভিসার আবেদন করতে হবে। মালয়েশিয়ায় পৌঁছানো পর দেওয়া হয় এই ভিজিট পাস, যার মেয়াদ থাকে সর্বোচ্চ ৩০ দিন।
এই ভিসার জন্য প্রার্থীকে http://malaysiavisa.imi.gov.my/ লিংকে যেয়ে অনলাই আবেদন সম্পন্ন করতে হবে। এ সময় ভিসা ফিও অনলাইনে জমা করতে হবে, যার পরিমাণ ২০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বা প্রায় ৬০০ টাকা (মালয়েশিয়ান দূতাবাস অনুসারে)।
আরো পড়ুন: হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য ভ্রমণ: যাওয়ার উপায় ও আনুষঙ্গিক খরচ
অনুমোদিত ই-ভিসা এ-ফোর সাইজের কাগজে প্রিন্ট করে পরবর্তী মালয়েশিয়ার প্রবেশ চেকপয়েন্টে প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে।
১ মাস আগে