সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা
বাংলাদেশে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় পুঁজিবাজারে তেজিভাব
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় গত কয়েক সপ্তাহে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় পুঁজিবাজারের লেনদেন হতে দেখা গেছে।
সম্প্রতি বন্ধ হওয়া প্রান্তিকে অনুকূল আয়সহ শেয়ারগুলোতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কারণে পুঁজিবাজারের বেঞ্চমার্ক সূচক টানা তিন সপ্তাহ ধরে তার লাভের ধারা বাড়িয়েছে।
স্থিতিশীলতায় সামষ্টিক পুনরুদ্ধারের লক্ষণ দেখিয়ে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এই সপ্তাহে ৮৯.৪৮ পয়েন্ট বেড়ে ৫ হাজার ৩৫৫ স্তরে পৌঁছেছে।
বিস্তৃত সূচকে শতকরা পরিবর্তন ছিল ১.৭০ শতাংশ। বাজারের অংশগ্রহণ ছিল ৮.৫৫ শতাংশ। বাজারটিতে দৈনিক গড় লেনদেন হয়েছে ৫৫৪ কোটি টাকা।
ক্রমবর্ধমান খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রতিক্রিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক পণ্য আমদানি সহজীকরণ এবং প্রধান খাদ্য বরাদ্দ জোরদার করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ভোজ্য তেল, চিনি এবং ছোলার মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে অস্থায়ীভাবে ঋণপত্র (এলসি) মার্জিন সরিয়েছে। দাম স্থিতিশীল রাখতে রমজান পর্যন্ত পণ্য আমদানিকারকদের ২৫ শতাংশ একক ঋণগ্রহীতার আবেদনের সীমা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ব্যয়বহুল ও পরিবেশগতভাবে ক্ষতিকর এলএনজি বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আর ৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের এই প্রকল্পটি জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকিও তৈরি করছে।
আরও পড়ুন: পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে চায় সরকার: অর্থ উপদেষ্টা
এদিকে, নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর ওপর চাপ কমাতে জানুয়ারি মাস থেকে স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে এক কোটি পরিবারের কাছে ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য বিক্রির পরিকল্পনা করছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।
উল্লেখযোগ্য রেমিট্যান্স প্রবাহের কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংক্ষিপ্তভাবে ২০ বিলিয়ন ডলারের সীমা অতিক্রম করেছিল। তবে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে ১.৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধের পরে এই প্রান্তিকে রিজার্ভ কমে গেছে।
চলমান শ্রমিক অসন্তোষ সত্ত্বেও তৈরি পোশাক খাতের অক্টোবরের রপ্তানি আয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ২০ দশমিক ৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ইতোমধ্যে সৌদি আরব বাংলাদেশি নার্স নিয়োগ শুরু করেছে। যা আরও দক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তানির দিকে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
তবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উচ্চাভিলাষী প্রকল্পটি ছোট করেছে। পরিবর্তে কাজ শেষ করার জন্য সুস্পষ্ট সময়সীমাসহ কয়েকটি অগ্রাধিকারযুক্ত অঞ্চলের উপর মনোনিবেশ করেছে।
মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার কঠোর মুদ্রানীতির প্রতিরক্ষা সত্ত্বেও ব্যবসাগুলো উচ্চ সুদের হারের সঙ্গে লড়ছে।
উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জন্য বৈদেশিক সহায়তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সরকারি সংস্থাগুলো সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণে সরকার কাটছাঁটের কথা বিবেচনা করছে।
ব্যাংকিং খাতে একীভূতকরণ, অধিগ্রহণ ও পুনঃমূলধন সহজতর করতে 'ব্যাংক রেজুলেশন অ্যাক্ট' নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের ব্যাংকিং, রাজস্ব আয় ও পুঁজিবাজার সংস্কারে সহায়তা দেবে যুক্তরাজ্য
কৃষি উৎপাদনে সহায়তার জন্য সার আমদানিতে নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম রাখতে ব্যাংকগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এছাড়া, অর্থপ্রদানের ভারসাম্যে সাম্প্রতিক ব্যাঘাতের কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের কাছ থেকে বাজেট-সহায়ক ঋণ চাইছে। যাতে অর্থনীতির জন্য স্বাচ্ছন্দের সুযোগ তৈরি করা যায়।
গত তিন মাসে বাংলাদেশ প্রবাসীদের কাছ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পেয়েছে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির কথা জানিয়েছে। যার ফলে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া বেড়েছে।
অনলাইন কর পরিশোধেল জন্য নতুন ফি প্রবর্তন করা হয়েছে। যা কর প্রদাদের প্রক্রিয়াকে সহজ করবে।
জাপানের সঙ্গে একটি অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধি করবে এবং বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগের দ্বার উন্মুক্ত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই ইতিবাচক অগ্রগতি সত্ত্বেও পোশাক খাতে দেরিতে মজুরি দেওয়ার কারণে শ্রমিক অসন্তোষ একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হিসাবে রয়ে গেছে।
রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে ৯০ দিনের ঋণে ১১টি পণ্য আমদানির অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) উল্লেখ করেছে যে, বাজেট-সহায়ক ঋণে সুইচ করা, রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং বহিরাগত অর্থায়ন বাধাগুলোর মধ্যে অর্থনীতির জন্য কিছুটা স্বস্থির জায়গা দেবে।
কৃষি উৎপাদন কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে সার আমদানিতে নগদ অর্থের মার্জিন কম রাখতেও ব্যাংকগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
একদিকে রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের ঘাটতি আর্থিক স্থিতিশীলতার উপর প্রভাব ফেলছে। অন্যদিকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের হার বেড়েছে।
তাছাড়া এসিইউ’র পাওনা পরিশোধের পর সম্প্রতি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাওয়ায় অর্থনৈতিক ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে ভঙ্গুরতাকে তুলে ধরেছে। শ্রমিক অসন্তোষ সত্ত্বেও শক্তিশালী তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি আয় এবং সৌদি আরবে বাংলাদেশি নার্স নিয়োগ উচ্চ-দক্ষ শ্রম রপ্তানির দিকে একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রটি বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে কৌশলগত পদক্ষেপের মিশ্রণে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জাপানের সঙ্গে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধি করবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের জন্য নতুন সুযোগ দেবে।
এদিকে, পূর্ববর্তী উচ্চাভিলাষী ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্পের পরিবর্তে নির্বাচিত অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গুরুত্বারোপ, উন্নয়নের জন্য আরও লক্ষ্যযুক্ত পদ্ধতিকে তুলে ধরে।
পরিশেষে, বাংলাদেশ স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে কৌশলগত পদক্ষেপের মিশ্রণসহ একটি জটিল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করছে। এই যাত্রায় বাংলাদেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখীন।
আরও পড়ুন: সোম-মঙ্গল-বুধবার বন্ধ থাকবে ব্যাংক ও পুঁজিবাজার
১ মাস আগে