৩. জ্বালানি ও বিদ্যুৎ
দুর্নীতি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে ধ্বংস করেছে: শ্বেতপত্র
বাংলাদেশের অর্থনীতির শ্বেতপত্রে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ব্যাপক দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। এসব দুর্নীতির কারণে প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করেছে এবং বার্ষিক অবৈধ অর্থ ব্যয় হয়েছে গড়ে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বৈদেশিক সাহায্য ও বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগের (এফডিআই) পরিমাণের দ্বিগুণেরও বেশি।
রবিবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে সংবাদ সম্মেলনে অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন কমিটি শ্বেতপত্র উপস্থাপন করে। এই তদন্ত প্রতিবেদনে বিভিন্ন খাতে পদ্ধতিগত জালিয়াতি, অব্যবস্থাপনা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
খাতভিত্তিক দুর্নীতি
১. ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত
ব্যাংকিং খাতকে সবেচেয়ে দুর্নীতিবিধ্বস্ত খাত হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। ঋণ কেলেঙ্কারি, অবৈধ অধিগ্রহণ এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঋণদানে জর্জরিত এ খাত।
প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের কারণে ১৪টি ঢাকা মেট্রো সিস্টেম বা ২৪টি পদ্মা সেতুর মতো একাধিক বড় আকারের অবকাঠামো নির্মাণের ব্যয়ের সমান সম্পদ নষ্ট হয়েছে।
রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ঋণ এবং হাইপ্রোফাইল খেলাপি আস্থা কমিয়ে দিয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ তহবিলগুলোকে উৎপাদনশীল বিনিয়োগ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
২. ভৌত অবকাঠামো
সরকারি পরিকাঠামো প্রকল্পগুলো অতিরিক্ত ব্যয়, তহবিলের অপব্যবহার ও স্বজনপ্রীতিমূলক নিয়োগে জর্জরিত।
প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়, সরকারি প্রকল্পগুলোতে গড়ে ৭০ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে দুর্নীতির কারণে। পাঁচ বছরেরও বেশি দেরি করেছে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে। গত ১৫ বছরে ঘুষ ও সম্প্রসারিত বাজেটের মাধ্যমে ১৪ বিলিয়ন থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলার পাচার করা হয়েছে। এর ফলে অবকাঠামোগত বিনিয়োগের রূপান্তরমূলক সম্ভাবনা কমে গেছে।
৩. জ্বালানি ও বিদ্যুৎ
রাজনৈতিক ও আর্থিক লাভের জন্য জ্বালানি চুক্তি ও বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে কারসাজি করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রতিযোগিতাহীন দরপত্র প্রক্রিয়া এবং প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো, সম্পদ পাচার এবং পদ্ধতিগত অদক্ষতা সৃষ্টি জ্বালানি সরবরাহে বাধা দেয়।
৪. শ্রম অভিবাসন
গত এক দশকে অনিয়ন্ত্রিত নিয়োগ ও অবৈধ হুন্ডি লেনদেনের মাধ্যমে অভিবাসী শ্রমিকদের ১৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার অপচয় হয়েছে। এটি ঢাকা এমআরটি-৬ প্রকল্প নির্মাণের ব্যয়ের চেয়ে চারগুণ বেশি। এ কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো সম্ভ হয়নি।
৫. সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী
প্রতিবেদনে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে পদ্ধতিগত অদক্ষতার বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এ খাতে ৭৩ শতাংশ সুবিধাভোগীকে দরিদ্র নয় বলে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। এভাবে আর্থিকভাবে দুর্বল লাখ লাখ ব্যক্তিকে সহায়তা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
৬. আইসিটি খাত
আইসিটি খাতের প্রযুক্তিগত নতুনত্ব এটিকে অপারেশনাল অদক্ষতা এবং দুর্নীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। জোটবদ্ধ হয়ে দুর্নীতি এবং অতিরিক্ত ক্রয় খরচের ঘটনা এই খাতের প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ
কমিটি চমকপ্রদ পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে:
অবৈধ আর্থিক বহিঃপ্রবাহ: ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বার্ষিক গড়ে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বৈদেশিক সাহায্য ও এফডিআইয়ের পরিমাণের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি।
সরকারি বিনিয়োগ: উন্নয়ন প্রকল্পের ৩০ শতাংশ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। যার ফলে ক্ষতি হয়েছে ১.৬১-২.৮ লাখ কোটি টাকা।
বিকৃত সরবরাহ শৃঙ্খল: উৎপাদন ও ক্রয়ের ক্ষেত্রে কারসাজির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারগুলো অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। সেখানে কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী লাভবান হচ্ছে, অথচ ভোক্তারা এর ভার বহন করতে বাধ্য হচ্ছে।
দুর্নীতির বহিঃপ্রকাশ
এগুলোর মধ্যে রয়েছে:
ব্যাংকিং ঋণ কেলেঙ্কারি: অপব্যবহার ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত খেলাপি।
বর্ধিত ও অতিরিক্ত প্রকল্প ব্যয়: তহবিল পাচার করতে পদ্ধতিগত খরচ বাড়ানো।
জমির অপব্যবহার: রাজনৈতিকভাবে দুর্বল জমির মালিকদের লক্ষ্য করে জোরপূর্বক অধিগ্রহণ চর্চা।
ঘুষ ও স্বজনপ্রীতি: প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও জনসেবায় বিস্তৃত।
জরুরি সংস্কার প্রয়োজন
শ্বেতপত্রে সুশাসন ও অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা পুনরুদ্ধারের জন্য পদ্ধতিগত সংস্কারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি মোকাবিলার জন্য জবাবদিহি ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং শক্তিশালী আইনি কাঠামো প্রয়োগ করা গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারের প্রতিক্রিয়া
রবিবার প্রতিবেদনটি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থনৈতিক স্বচ্ছতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে চিহ্নিত দুর্নীতির মাত্রা নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২ সপ্তাহ আগে