মান্দালয়
সোনার শহর মান্দালয় এখন ধ্বংসস্তূপ, দুর্ভোগ বাড়াচ্ছে গৃহযুদ্ধ
সোনার শহর হিসেবে খ্যাত মিয়ানমারের মান্দালয় শহর যেন এখন এক মৃত্যুপুরী। সোনালী কারুকার্যে সুস্বজ্জিত মঠ ও বৌদ্ধ সমাধির সৌন্দর্যে ঝলমলে এই শহরটি ভয়াবহ ভূমিকম্পে পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।
তবে এত বড় দুর্যোগও মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে টলাতে পারছে না বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে অবিচল সেনাবাহিনী। বিদ্রোহীরা কোনো হামলা চালালে পাল্টা জবাবের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জান্তা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইং।
গত বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) মিয়ানমারে আঘাত হানে ৭.৭ মাত্রার শক্তিশালী এক ভূমিকম্প। এতে গৃহযুদ্ধকবলিত দেশটিতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে এরইমধ্যে প্রায় তিন হাজারে দাঁড়িয়েছে। আহত সাড়ে চার হাজারের বেশি।
এর মধ্যে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিয়ানমারের সাবেক রাজধানী মান্দালয়। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ এই শহরটিতে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হওয়ায়, শহরের বাতাসে ভাসছে লাশের গন্ধ। ঝলমল শহরটির বিভিন্ন স্থাপনা ভেঙে পড়েছে, যার নিচ থেকে বেরিয়ে আসছে একের পর এক লাশ।
শহরটির জে নামের এক বাসিন্দা জানান, মৃতের সংখ্যা এত বেশি যে, তারা স্তূপ করে লাশগুলো দাহ করতে বাধ্য হয়েছেন।
বাসিন্দারা জানান, তাদের কাছে না আছে কোনো খাবার, না পানি। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও নেই, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন তারা।
দুর্বল অবকাঠামো ও গৃহযুদ্ধের জটিল পরিস্থিতি ত্রাণ কার্যক্রমকে মারাত্বকভাবে ব্যাহত করছে বলে মনে করছেন অনেকে। এ ছাড়াও দেশটির সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজস্বার্থে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র গোপন করার ইতিহাস রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
যখনই ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন ও এলাকাগুলোতে উদ্ধারকারীদের প্রবেশ বাড়তে থাকবে, তখনই লাশের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
২৩ বছর বয়সী জে মান্দালয়ের মহাউংমেয়ে এলাকার বাসিন্দা। তিনি বলেন, ধ্বংসস্তূপ থেকে দুইদিন পর তার খালার লাশ বের করা হয়েছে। ঘুম, খাবার ও পানির সংকটে নাজেহাল দশার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ঘুম না হওয়ায় আমার মাথা প্রচণ্ড ঘুরছে।’
জে’র মতো পরিস্থিতি অনেকেরই। নিজেদের বাড়ির আশেপাশের রাস্তায় অনেকেই তাঁবু টানিয়ে বা খোলা আকাশের নিচেই অবস্থান করছেন। আরেকটি আফটারশক (পরাঘাত) যেকোনো মুহূর্তে তাদের বাড়িঘরের অবশিষ্টাংশও ধ্বংস করে দিতে পারে এই আশঙ্কায় তারা রাস্তায় দিন কাটাচ্ছেন।
জে বলেন, ‘আমি অনেককেই রাস্তায় উবু হয়ে বসে চিৎকার করে কান্না করতে দেখেছি।’
তবে ভাঙা স্থাপনার নিচ থেকে লাশের পাশাপাশি জীবিতও অনেককে উদ্ধার করা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী জানান, গত চারদিনে মান্দালয় শহর থেকে ৪০৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, এ সময় ২৫৯টি লাশও বের করা হয়েছে।
তবে প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা সরকারি তথ্যের থেকে অনেক বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার (১ তারিখ) এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে মিয়ানমার জান্তা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইং বলেন, ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের (ইউজিএস) তথ্যমতে, মৃতের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি হতে পারে।
শক্তিশালী ভূমিকম্পের আঘাতে মান্দালয়ের মানুষজন শারীরিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক—সব দিক দিয়ে বিপাকে পড়েছেন। এলাকাটির শিশুরা মানসিকভাবে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
দক্ষিণ মান্দালয়ের পাইগ্যিটাগন এলাকার এক পাদ্রি যিনি রুয়াতে নামে নিজের পরিচয় দেন, তিনি বিবিসিকে তার অভিজ্ঞতার কথা জানান।
তিনি বলেন, তার আট বছরের ছেলে গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকবার চিৎকার করে কান্না করে উঠেছেন।
চোখের সামনে মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকা ধ্বংস হতে দেখে ছেলেটি অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়েছে, এ কারণেই তার মানসিক অবস্থার অবনতি হয়েছে বলে মত দেন শিশুটির বাবা।
রুয়াতে বলেন, ‘ভূমিকম্পের সময় আমার ছেলে উপরে তার শোবার ঘরে ছিল। আমার স্ত্রী তার বোনের দেখাশোনা করছিল। বেরিয়ে আসার সময় তার (ছেলে) ওপর কিছু ধ্বংসাবশেষও পড়েছিল।’
তিনি বলেন, গতকাল নিজ এলাকা থেকে তিনি অনেককে লাশ হয়ে বের হতে দেখেছেন। বুধবার (২ এপ্রিল) ভূমিকম্পের পাঁচদিন পরে রাজধানীর নেপিদোর একটি ভবন থেকে জীবিত একজনকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে।
এই ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি। ভারাক্রান্ত মনে বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক। মিয়ানমার একের পর এক দুর্যোগের মুখে পড়ছে, এরমধ্যে কিছু প্রাকৃতিক, কিছু মানবসৃষ্ট। দেশের প্রতিটি মানুষ এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমরা হতাশ ও অসহায় বোধ করছি।’
গত বৃহস্পতিবারের ভূমিকম্পে মান্দালয়ের ১২ তলাবিশিষ্ট ‘স্কাই ভিলা’ ভবনটির ছয়তলা ধ্বসে পড়েছে। ওই ভবনের নিকটস্থ এক বাসিন্দা জানান, যদিও কয়েকজনকে সেখান থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, তবে গত ২৪ ঘণ্টায় কেবল লাশই বের হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এই দুর্যোগ শিগগিরই শেষ হবে আশা করছি। এখনো অনেক লাশ ভিতরে চাপা পড়ে আছে মনে হচ্ছে, সংখ্যাটা শতাধিক হতে পারে।’ মান্দালয়ের আশপাশের কবরস্থানগুলোতে আর জায়গা অবশিষ্ট নেই। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, লাশের ব্যাগসহ খাবার ও পানি সরবরাহের ব্যাপক অভাব দেখা দিয়েছে।
শহরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মঠ ও সোনালী চূড়ার ভাঙা অংশগুলো। এক সময় মান্দালয় সোনার পাত উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র ও পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ ছিল। তবে গত কয়েক বছরে মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানেও দারিদ্র্য বেড়েছে, ফলে শহরটি অনেকাংশে তার জৌলুস হারিয়েছিল।
আরও পড়ুন: ভূমিকম্পে মিয়ানমারে নিহত প্রায় ৩ হাজার, জীবিতদেরও উদ্ধার করা হচ্ছে
ভূমিকম্পের পরে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি
গত সপ্তাহে মিয়ানমার ছাড়াও থাইল্যান্ড ও চীনেও আঘাত হেনেছে ভূমিকম্প। তবে গৃহযুদ্ধ, খাদ্যসংকট ও অর্থনৈতিক অবনতির মধ্যে মিয়ানমারে নতুন বিপর্যয় ডেকে এনেছে সাত দশমিক সাত মাত্রার ভয়াবহ এক ভূমিকম্প। ২০২১ সালের পর থেকে দেশটির ক্ষমতায় আছে জান্তা সরকার।
গতকাল নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করে জান্তা সরকার, পাশাপাশি পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। এছাড়াও গণমাধ্যমের সম্প্রচার বন্ধ রাখা হয়।
তবে দারিদ্র্যপীড়িত দেশটি থেকে ভূমিকম্পের আগেই প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। জোরপূর্বক সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ থেকে বাঁচতে অনেক তরুণ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এতে এই দুর্যোগের মুহূর্তে প্রয়োজনীয় লোকবল মিলছে না বলে দেশটির বাসিন্দাদের অভিযোগ।
রাশিয়া ও চীন সহায়তা করলেও উদ্ধারকাজ ধীরগতিতে এগোচ্ছে বলে মন্তব্য করেন জে। তিনি বলেন, ‘উদ্ধারকর্মীরা চারদিন ধরে একটানা কাজ করে যাচ্ছে। তারাও এখন ক্লান্ত, তাদেরও কিছুটা বিশ্রাম প্রয়োজন।’
আরও পড়ুন: জুমার নামাজের সময় ভূমিকম্প, মিয়ানমারে নিহত অন্তত ৭০০ মুসল্লি
৮ দিন আগে
মিয়ানমারে নিহত বেড়ে ২ হাজার, ধীর গতির উদ্ধার অভিযান
মিয়ানমারে ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দুই হাজারে পৌঁছেছে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে উদ্ধার অভিযান ধীর গতিতে চলছে। গেল শুক্রবার দিনের মাঝামাঝিতে এশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পটি আঘাত হেনেছে দেশটিতে। এরপর থেকে নিহতের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে।
সোমবার (৩১ মার্চ) দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, একটি মঠ ভেঙে ২০০ বৌদ্ধ ভিক্ষু নিহত হয়েছেন। একটি প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় ধসে পড়লে ৫০টি শিশুর প্রাণহাটি ঘটেছে। আর জুমাতুল বিদার নামাজ আদায়ের সময়ে সাত শতাধিক মুসল্লি নিহত হয়েছেন।
সাত দশমিক সাত মাত্রার ভূমিকম্পটি উৎপত্তি স্থল দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ শহর মান্দালয়ে। এতে শহরের বিমানবন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সড়কগুলো ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে। আর ভেঙে মাটিতে মিশে গেছে শত শত ভবন।
জাতিসংঘের সহায়তা সংস্থাগুলো হুঁশিয়ারি করে জানিয়েছে, ভূমিকম্পের কারণে মিয়ানমারে খাদ্যসংকট ও রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। গৃহযুদ্ধে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় আগে থেকেই প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে সেখানে। এই দুর্যোগ সেই পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলেছে।আরও পড়ুন: জুমার নামাজের সময় ভূমিকম্প, মিয়ানমারে নিহত অন্তত ৭০০ মুসল্লি
বিদ্যুৎ বিভ্রাট, জ্বালানি সংকট ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য ভারী যন্ত্রপাতিরও ঘাটতি রয়েছে। এতে চল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যেও হাত দিয়ে জীবিতদের উদ্ধার করতে হচ্ছে অনেককে।
ভেঙেপড়া মান্দালয়ের ইউ হ্লা থেন মঠের উদ্ধারকারীরা বলছেন, ‘তারা এখনো ১৫০ ভিক্ষুকের মরদেহ খুঁজে বেড়াচ্ছেন।’
মিয়ানমার ফর দ্য ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির প্রোগ্রাম উপ-পরিচালক লরেন ইলারি বলেন, ‘কী মাত্রায় ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, তা বর্তমান পর্যায়ে এসে আমরা পরিষ্কার হতে পারছি না। মান্দালয়ের আশি শতাংশ ভবন ভঙে পড়েছে।’
দেশটির তিনটি হাসপাতাল পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে ও ২২টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তারা বলছে, ‘আঘাত ও অস্ত্রোপচারের চিকিৎসার জন্য জরুরি সহায়তা দরকার। রক্ত সরবরাহ, চেতনানাশক, অপরিহার্য চিকিৎসা ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সহায়তা প্রয়োজন।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সংস্থা জানিয়েছে, মিয়ানমারের উত্তরপশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে ১০ হাজারের বেশি ভবন ধসে পড়েছে।
১০ দিন আগে