পথচারীর মৃত্যূ
ঢাকার সড়কে নিহতদের বেশিরভাগ পথচারী: গবেষণা
রবিবার, ভরদুপুর। রাজধানীর ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার্স থেকে রমজান পরিবহনের একটি বাস বেপরোয়া গতিতে এসে থামে মৌচাক মার্কেটের বিপরীত পাশে। পেছনে এসে থামে একই কোম্পানির আরও একটি বাস। কে বেশি যাত্রী তুলতে পারে, সেই প্রতিযোগিতায় সারা পথ পারাপারি করে এসেছে বাহনদুটি।
এ সময়ে মূল সড়কের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা সিনথিয়া ইসলাম (৪৫) নামের এক নারী ভয়ে ছিটকে পড়েন পাশের ফুটপাতের ওপর। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন তিনি, অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন চাপাপড়া থেকে। আতঙ্কে কথা বলতে পারছিলেন না ওই নারী।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলছিলেন, ‘ঢাকার বেশিরভাগ ফুটপাতই বেহাল, পথচারীদের চলাচলের জন্য সুগম নয়। এরপর রাস্তায় গাড়ি চলে বেপরোয়া গতিতে। এতে সব ঝক্কি যায় পথচারীদের ওপর দিয়ে।’
এই ঘটনার সময় শাহবাগ যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষায়ই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। সিনথিয়া বলেন, ‘বাসচালকেরা পারাপারি করে গাড়ি চালান। এতে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন পথচারীরা। কেউ প্রাণ হারাচ্ছেন, কেউ-বা চিরকালের জন্য পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে পরিবারগুলো।’
কোনো নিয়মনীতি না থাকার কারণে তারা এই প্রাণঘাতী প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বলে মন্তব্য করেন এই গৃহিণী। তার ভাষ্য, ‘রাস্তায় নেমে বেশি করে ট্রিপ ও যাত্রী তুলতে গিয়ে অসম প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন চালকেরা। যে কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।’
সিনথিয়া ইসলামের কথারই প্রতিফলন ঘটেছে সম্প্রতি হওয়া একটি গবেষণায়। এতে দেখা যায়, ২০২৩ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ১২৩ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৮৭ শতাংশই ছিল গাড়িচাপা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা। নিহতদের মধ্যে ৬১ শতাংশ ছিলেন পথচারী।
এরপরই রয়েছেন মোটরসাইকেলের আরোহীরা, নিহতদের ২৪ শতাংশ মোটরসাইলের যাত্রী ছিলেন। নিহতদের ৮৩ শতাংশই পুরুষ। নিহত নারীদের মধ্যে সবাই ছিলেন পথচারী।
গবেষণাটি করেছে মার্কিন দাতব্য সংস্থা দ্য ব্লুমবার্গ ফিল্যানথ্রপিস ইনিশিয়েটিভ ফর গ্লোবাল রোড সেফটি (বিআইজিআরএস)। ঢাকায় সড়কে প্রাণহানি কমাতে ডিএনসিসির সঙ্গে যৌথভাবে তারা এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তর থেকে সড়ক দুর্ঘটনার উপাত্ত সংগ্রহ করে ডিএনসিসি। এরপর ২০২৩ সালে ডিএনসিসির ২৫টি থানার সড়কে হতাহতের মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণী (এফআইআর) ও লিখিত অভিযোগ (এজাহার) নিয়ে তা বিশ্লেষণ করেছে বিআইজিআরএস।
গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন সংস্থাটির ঢাকা উত্তরের নজরদারি সমন্বয়ক (সার্ভিলেন্স কো-অর্ডিনেটর) ডা. তানভীর ইবনে আলী। তিনি বলেন, ‘প্রাণঘাতি সড়ক দুর্ঘটনায় মামলার আইনি প্রক্রিয়ার জন্য অনুসন্ধানের সময় পুলিশ দুর্ঘটনা সম্পর্কিত তথ্যাদি নথিভুক্ত করে থাকে। ঢাকা উত্তরে সড়ক দুর্ঘটনার সামগ্রিক অবস্থা নিরূপণের জন্য ডিএনসিসি এই তথ্য চেয়ে ডিএমপির কাছে ডেটা রিকোয়েস্ট পাঠায়। প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন শেষে সেই ডেটাগুলো আমরা নিয়েছি।’
দুর্ঘটনা বেশি বিমানবন্দর থানায়
২০২৩ সালে ডিএনসিসির ২৫টি থানা থেকে ১১৭টি প্রাণঘাতী সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন পেয়েছেন গবেষকরা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে বিমানবন্দর থানায়, ১৩টি।
আরও পড়ুন: তথ্যনির্ভর পদক্ষেপের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হবে: সেমিনারে বক্তারা
এরপর খিলখেতে ১১টি, উত্তরা পশ্চিম থানায় ১০টি, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর থানায় ৯টি করে, তুরাগ ও বনানীতে আটটি করে, হাতিরঝিল ও দারুস সালাম থানায় সাতটি করে, রূপনগর ও ভাটারা থানায় পাঁচটি করে, শাহ আলী, পল্লবী, ক্যান্টনমেন্ট ও বাড্ডা থানায় চারটি করে, উত্তরা পূর্ব, কাফরুল ও আদাবরে তিনটি করে এবং তেজগাঁও শিল্প এলাকা ও তেজগাঁওয়ে দুটি করে দুর্ঘটনা ঘটেছে।
তবে ভাষানটেক, দক্ষিণখান, গুলশান ও উত্তরখানা থানা থেকে কোনো প্রাণঘাতী সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। প্রাণহানির ৫৫ শতাংশ হয়েছে মাত্র সাতটি থানায়। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বিমানবন্দর ফ্লাইওভারের পূর্ব পাশে ও মিরপুর ১ মোড়ে।
চাপা দিয়ে পালিয়ে যায় বাস-ট্রাক
গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরের বেশিরভাগ পথচারীই নিহত হচ্ছেন বাস ও ট্রাকচাপায়। দিনের চেয়ে রাতের বেলায় সড়কে নিহতের সংখ্যা বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে ২৫টি থানায় যে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে, তার মধ্যে ৮৭ শতাংশই গাড়ি চাপা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা।
ঢাকা শহরে প্রধানত তিন ধরনের সংঘর্ষের ফলে প্রাণঘাতী সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে: পথচারীদের চাপা দেওয়া (৬৫ শতাংশ), সামনের দিকে ছুটে চলা গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা (৩৭ শতাংশ) এবং মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা (৬ শতাংশ)। এ ছাড়াও রাস্তার পাশের বস্তুতে ধাক্কা, পারাপারি ও দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িকে ধাক্কা দেওয়ার ঘটনায়ও এক শতাংশ করে প্রাণহানি ঘটছে।
যানবাহনের এসব সংঘর্ষে ৫৮ শতাংশ আঘাত করা হয় পথচারীদের। আর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি ঘটছে, তার ৬৫ শতাংশই ছিল পেছন থেকে ধাক্কায়।
ঢাকার সড়কে পথচারীদের প্রাণহানি বেশি
ঢাকা উত্তরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৬১ শতাংশই পথচারী বলে জানানো হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ২০২৩ সালে ১১৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১২৩টি প্রাণহানি ঘটেছে, যাদের মধ্যে পথচারী ৭৫ জন, মোটরসাইকেলচালক ২৯ জন, রিকশাচালক ৮ জন, সিএনজিচালিত অটোরিকশাযাত্রী ৬ জন, গাড়ির যাত্রী ৩ জন এবং বাইসাইকেলচালক ছিলেন দুজন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঢাকায় সড়কে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন পথচারীরা। সড়কে নিহত প্রতি পাঁচজনের মধ্যে তিনজনই পথচারী, আর প্রতি চার প্রাণহানির মধ্যে একজন মোটরসাইকেল-আরোহী।
ডিএনসিসিতে ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৮৩ শতাংশই পুরুষ। নিহত ১১৮ জনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে পুরুষ ৯৮ জন, নারী ২০ জন। আর নিহতদের মধ্যে পুরুষ পথচারী ছিলেন ৫০ জন এবং নিহত নারীদের সবাই পথচারী।
ঢাকার সড়কে প্রতি পাঁচ প্রাণহানির মধ্যে চারজন পুরুষ। আর নিহত প্রতি পাঁচজন পথচারীর মধ্যে নারী দুজন।
২০২৩ সালের ঢাকা উত্তরে সড়কে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে ২০ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের। ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৬ জন, ৪০ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৪ জন, ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সী ২১ জন, ৫০ থেকে ৫৯ বছর বয়সী ১৪ জন নিহত হয়েছেন। তবে এ সময়ে সাতটি শিশুরও প্রাণহানি ঘটেছে।
এ ছাড়াও একজন ৭০ থেকে ৭৯ বছর বয়সী ও একজন অশীতিপর রয়েছেন এই পরিসংখ্যানে। সব বয়সীদের মধ্যেই পথচারী নিহতের সংখ্যাটি বেশি। এ ছাড়া ৪০ থেকে ৪৯ বছর বয়সীরাই ঢাকা শহরের সড়কে বেশি নিহত হয়েছেন।
২১৯ দিন আগে