বৈষম্যের শিকার
জলাশয় ভরাটের দায়ে এখন কাউকে কারাগারে যেতে হয় না: আদিল মুহাম্মদ খান
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর খাল ও জলাশয় ভরাটের জন্য কাউকে কারাগারে যেতে হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান। মঙ্গলবার (৩ জুন) ‘আগাম বর্ষায় নগর এলাকায় জলাবদ্ধতা: আইপিডির পর্যবেক্ষণ’ শিরোনামের আইপিডির একটি অনলাইন আলোচনায় তিনি এমন মন্তব্য করেছেন।
সেই পুরো আদলেই নগর ব্যবস্থা চলছে জানিয়ে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘জলাবদ্ধতার ক্ষেত্রেও নিম্ন আয়ের লোকেরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, আছে এলাকাভিত্তিক বৈষম্যও। পরিকল্পনা ও আইন-কানুনকে তোয়াক্কা না করে নিচু এলাকা ও জলাভূমিতে পরিকল্পনাহীন ও স্বেচ্ছাচারী আবাসনের কারণে লও নগর এলাকার পানি নামতে পারছে না।’
‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর খাল-জলাশয় দখলের কারণে কাউকে কারাগারে যেতে হয়নি। পরিবেশগত হত্যার মতো বিষয়কে যেন দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ফলে খাল দখলদাররা এখন আরও প্রবল প্রতাপে অনেক জায়গায় ভিন্ন চরিত্রে ফেরত এসেছে,’ যোগ করেন তিনি।
এই নগর-পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘নগর এলাকায় বিগত বছরগুলোতে খাল সংস্কার, পুনরুদ্ধার, ড্রেনেজ প্রকল্পসহ বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প নেওয়া হলেও অল্প বৃষ্টিতেই ঢাকা, কুমিল্লা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, খুলনা, ময়মনসিংহসহ অনেক নগরেরই বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। আবার সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ায় চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে ছিল।’
আরও পড়ুন: জলাবদ্ধতা নিরসনে রাজধানীতে কন্ট্রোল রুম চালু
‘ঢাকা শহরেও খাল উদ্ধারে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, বিপরীতে আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল আবার ভরাট শুরু হয়ে যাওয়ায় প্রকল্পের ৩০ কোটি টাকা পানিতে পড়েছে। কালুনগর, জিরানি, মান্ডা, শ্যামপুর খাল নিয়ে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার পরিকল্পনার অগ্রগতি খুবই সামান্য।’
তিনি বলেন, ‘স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়া, মেয়র-কাউন্সিলরের অনুপস্থিতির কারণেও অনেক নগর এলাকায় বর্ষার সঠিক প্রস্তুতির অভাব ছিল। অনেক নগরীতেই নিম্নবিত্ত, প্রান্তিক ও নগরের প্রান্তসীমায় বাস করা নাগরিকেরা জলাবদ্ধতায় পর্যুদস্ত হয়েছেন।’
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালযয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহজালাল মিশুক বলেন, ‘সাম্প্রতিক বিভিন্ন নগর সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগের ফলে এবং চলমান ড্রেনেজের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে টেকসই সমাধান নিশ্চিত করতে হলে চট্টগ্রামের ৫৭ টি খালকেই পুনরুদ্ধার করে সচল করতে হবে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানকে অনুসরণ করে নগরায়ন নিশ্চিত না করবার পরিণতি হচ্ছে শহরের জলাবদ্ধতা।’
জুলাইয়ের পরেও সেই পুরোনো বন্দোবস্ত
জুলাই অভ্যুত্থানের পরেও সেই পুরো বন্দোবস্ত রয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন রাজধানীর জুরাইনের পরিবেশ ও সামাজিক আন্দোলনের নেতা মিজানুর রহমান মিজান।
তিনি বলেন, ‘জুরাইন-শ্যামপুর এলাকার জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ অবর্ণনীয়। ডিএনডি এলাকায় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হলেও জলাবদ্ধতা কমেনি। এখনো সবাই প্রকল্প আর টাকার ভাগ নিয়ে আগ্রহী। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়েও সেই পুরাতন বন্দোবস্ত দেখা যাচ্ছে। খালের আবর্জনা দূর করবার কার্যকর কোন উদ্যোগ নেই, যার মাধ্যমে অনেক এলাকার জলাবদ্ধতা দূর করা যেত।’
খুলনার পরিকল্পনাবিদ শেখ আদনান ইসলাম বলেন, ‘খাল জলাশয় দখলের পেছনে অনেক সরকারী কর্মকর্তাদের সংযোগ আছে। তাদের দায়মুক্তির বিধান বাতিল করে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। ময়ূর ও ভৈরব নদীতে নাব্য ফিরিয়ে আনা দরকার, নদী খনন প্রকল্পের নামে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।’
জলাবদ্ধতা দূর করতে প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান কৌশল কাজে লাগাতে হবে। নগর এলাকায় কনক্রিট আচ্ছাদন কমাতে হবে বলে মন্তব্য করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফরহাদুর রেজা।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আসিফ ইকবাল বলেন, নগরায়ন এখন আবাসন মাফিয়াদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যারা খাল বিল উজাড় করে প্রকল্প করেছে। জলাভূমিতে বালু ফেলা হচ্ছে, ফলে বাড়ছে জলাবদ্ধতা। বিভিন্ন প্রকল্পের তথ্যাদি সাধারণ মানুষের কাছে জানানো হয় না। অথচ প্রকল্পের নামে লোপাট হয়ে যাচ্ছে হাজার কোটি টাকা। আমাদের এখন প্রয়োজন জনবান্ধব নীতি।
আরও পড়ুন: চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা প্রধান উপদেষ্টার
ময়মনসিংহ থেকে পরিকল্পনাবিদ ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল বলেন, ‘আবাসন প্রকল্পের কারণে ময়মনসিংহে অনেক খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ৭ ফুট রাস্তার পাশে নির্মিত হচ্ছে ১৬ তলা ভবন, অথচ কর্তৃপক্ষ নির্বিকার।
কুমিল্লা থেকে পরিকল্পনাবিদ ইবতেছাম রাশেদিন নাজলা বলেন, ‘কুমিল্লার পুকুরগুলো হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। জলাবদ্ধতার সময় ড্রেনগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছে মরণফাঁদ।’
পরিকল্পনাবিদ আব্দুল আহাদ নাফিস বলেন, খাল-বিলের শহর বরিশালে খালকে বক্স কালভার্টে পরিণত করা হচ্ছে।
১৮৫ দিন আগে