করছাড়
ভারতে বানান, ভারত থেকেই কিনুন: মার্কিন শুল্কের বিরুদ্ধে মোদির আহ্বান
আজ থেকে ভারতের ওপর কার্যকর হচ্ছে নতুন মার্কিন শুল্ক। ভারত থেকে যেসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশ করবে, সেসব পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক গুনতে হবে। এর ফলে দেশটির অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নিষেধ সত্ত্বেও রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা অব্যাহত রাখায় গত ৬ আগস্ট ভারতের ওপর নেমে আসে যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্কশাস্তি। দিল্লির ওপর প্রথমে ২৫ শতাংশ, পরে আরও ২৫ শতাংশসহ মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
তবে শুল্ক নিয়ে ট্রাম্পের এই চোখ রাঙানির বিপরীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘ভারতে বানান, ভারত থেকেই কিনুন’। অর্থাৎ মার্কিন শুল্ক মোকাবিলায় দেশের অভ্যন্তরেই পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রি করে রপ্তানি নির্ভরতা কমানোর ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি মাসের শুরুর দিকে নিজ দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘বিশাল কর ছাড়ের’ ঘোষণা দেন মোদি।
দেশটির স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় দিল্লির লাল কেল্লা থেকে সাধারণ মানুষ এবং সমর্থকদের সামনে তিনি এ ঘোষণা দেন। সে সময় ছোট দোকান মালিক এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের দোকানের বাইরে ‘স্বদেশি’ বা ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ বোর্ড লাগানোরও আহ্বান জানিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
মোদি বলেছিলেন, ‘হতাশা থেকে নয়, বরং গর্ব থেকে আমাদের আত্মনির্ভরশীল হওয়া উচিত।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক স্বার্থপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আমাদের অসুবিধাগুলো নিয়ে বসে থাকলে চলবে না, অবশ্যই সামনে এগোতে হবে। কেউ যেন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে।’
আরও পড়ুন: ভারতকে ট্রাম্পের শাস্তি, শুল্ক বেড়ে দাঁড়াল ৫০ শতাংশ
এরপর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেছেন মোদি।
মোদির এই অবস্থানকে অনেকেই ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের কঠোর পদক্ষেপের বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবেই দেখছেন। মার্কিন শুল্কের কারণে ভারতের রপ্তানিনির্ভর শিল্পের সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ মানুষের জীবিকা ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ আমেরিকান গ্রাহকদের পোশাক থেকে শুরু করে হীরা ও চিংড়ি পর্যন্ত সবকিছু সরবরাহ করে ভারত।
তবে মোদির বার্তাও স্পষ্ট, দেশে পণ্য বানিয়ে দেশেই বিক্রি করতে হবে।
ভারতে বানিয়ে ভারতেই বিক্রি কতটুকু সম্ভব
মোদি নির্দেশ দিলেও এই বিষয়ের বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দিহান অনেকেই। যদি উৎপাদনের কথা আলোচনা করা হয়, সেক্ষেত্রে ভারতের ব্যর্থতার ছাপ ইতোমধ্যে স্পষ্ট। কারণ ভারতে বছরের পর বছর সরকারি ভর্তুকি এবং উৎপাদন প্রণোদনা চালু করার পরও দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১৫ শতাংশের আশপাশেই স্থবির হয়ে আছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সরকার যদি দীর্ঘমেয়াদী কর সংস্কারকে উৎসাহিত করে এবং অবিলম্বে জনগণের হাতে আরও বেশি অর্থ পৌঁছানো সম্ভব হয়, তাহলে এই ধাক্কা সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে জন্য কিছুটা সহায়ক হতে পারে।
এ কারণে চলতি বছরের শুরুতে বাজেটে ১২ বিলিয়ন ডলারের আয়কর ছাড়ের ঘোষণার পর এখন পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) হ্রাস এবং সরলীকরণের মাধ্যমে ভারতের পরোক্ষ কর ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ করছে মোদি সরকার।
মূলত কর ছাড়ের ফলে ভোক্তানির্ভর খাতগুলোর সবচেয়ে বেশি উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে স্কুটার, ছোট গাড়ি, পোশাক এবং সিমেন্টের মতো পণ্য।
সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও বেশিরভাগ বিশ্লেষকের ধারণা, কম জিএসটির কারণে যে রাজস্ব ঘাটতি তৈরি হবে, তা বাড়তি শুল্ক আদায় এবং ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাজেটের তুলনায় বেশি লভ্যাংশের মাধ্যমে পূরণ হয়ে যাবে।
অন্যদিকে, বিনিয়োগ ব্যাংক মর্গান স্ট্যানলির মতে, মোদির এই রাজস্ব প্রণোদনা বা কর ছাড় ভোগব্যয়ের পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। এতে দেশটির জিডিপি বাড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতি কমবে।
সুইস বিনিয়োগ ব্যাংক ইউবিএস বিবিসিকে বলেছে, জিএসটি কমানোর এই সিদ্ধান্ত মোদির আগের নেওয়া করপোরেট ও আয়কর কমানোর তুলনায় বড় প্রভাব ফেলবে, কারণ এগুলো ক্রয়ের সময় সরাসরি ভোগব্যয়কে প্রভাবিত করবে।
আরও পড়ুন: ভারতকে কি চীনের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন ট্রাম্প?
মোদির এই করছাড়ের ঘোষণা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার আরও কমানোর সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। গত কয়েক মাসে এই হার এক শতাংশ হারে কমানো হয়েছে। তাছাড়া ঋণ দেওয়াকেও উৎসাহিত করা হতে পারে বলে মনে করেন তারা।
এর ফলে আগামী বছরের শুরুতে প্রায় পাঁচ লাখ সরকারি কর্মচারীর বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভারতের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রাখতে সহায়ক বলে আশা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।
ভারতের শেয়ার বাজারগুলো এই ঘোষণায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। তাছাড়া, বাণিজ্য অনিশ্চয়তার কারণে সৃষ্ট আতঙ্ক থাকা সত্ত্বেও, এই মাসের শুরুতে আঠারো বছর পর এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল থেকে একটি বিরল সার্বভৌম রেটিং আপগ্রেড পেয়েছে ভারত।
কোনো সরকারকে ঋণ দেওয়া বা কোন দেশে বিনিয়োগ করা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ— তা পরিমাপ করে এই সার্বভৌম রেটিং। এতে সরকারের ঋণ গ্রহণের খরচ কমতে পারে এবং বিদেশি বিনিয়োগের পরিস্থিতি উন্নত করতে পারে।
অবশ্য অনেকদিন ধরে আটকে থাকা সংস্কারগুলো নিয়ে তাড়াহুড়া করলেও ভারতের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা কয়েক বছর আগে দেখা ৮ শতাংশ স্তর থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এমনকি এ সংশ্লিষ্ট বহিরাগত সংকট কমার কোনো লক্ষণও নেই।
এদিকে, রাশিয়ার তেল কেনা নিয়ে দিল্লি-ওয়াশিংটন বাকযুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করেছে। এর জেরে এই সপ্তাহের শুরুতে অনুষ্ঠিতব্য বাণিজ্য আলোচনাও বাতিল করা হয়েছে। অথচ মাত্র কয়েক মাস আগেও এমন একটি পরিস্থিতি কল্পনাও করা যেত না বলে মন্তব্য করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
৯৯ দিন আগে