ট্রাম্পের শান্তি আলোচনা
ট্রাম্পের শান্তি আলোচনা এগোলেও ভূখণ্ড ও নিরাপত্তা জটিলতাই প্রধান অন্তরায়
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শান্তি উদ্যোগ জোরালো হওয়ার মাঝেই কূটনীতিকরা এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত প্রাথমিক শান্তি প্রস্তাবে দুটি মুখ্য বিষয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে—ইউক্রেনের ভূখণ্ড ছাড় দেওয়া এবং কিয়েভের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা।
গত সপ্তাহান্তে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় মার্কিন আলোচকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে ইউক্রেনের প্রতিনিধি দল। এবার রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করতে এ সপ্তাহেই ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা মস্কো সফর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
গত মাসে ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশের পর তা রাশিয়ার স্বার্থের অনুকূলে বলে কিয়েভ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মাঝে উদ্বেগ দেখা দেয়। পরে গত সপ্তাহে জেনেভায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের এক দফা আলোচনার পর পরিকল্পনায় সংশোধন আনা হয়।
এরপর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, সংশোধিত পরিকল্পনাটি ‘কার্যকর করার মতো’। অন্যদিকে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একে ভবিষ্যৎ শান্তি চুক্তির ‘সম্ভাব্য ভিত্তি’ বলে উল্লেখ করেন। আর গেল রবিবার ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘চুক্তিতে পৌঁছানোর ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।’
তবে চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছাতে এখনও অনেক পথ বাকি বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। কারণ ইউক্রেন নিজেদের ভূমি ছাড়বে কিনা এবং ভবিষ্যতে তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে কতটা নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে—এমন মূখ্য কিছু বিষয় নিয়ে এখনও কোনো মীমাংসা হয়নি।
কিয়েভের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, এবার মস্কো
ট্রাম্পের প্রতিনিধিরা ইতোমধ্যে ইউক্রেনের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক সম্পন্ন করেছেন। ফ্লোরিডার হ্যাল্যারেন্ড বিচের শেল বে ক্লাবে স্থানীয় সময় রবিবার (৩০ নভেম্বর) ৪ ঘণ্টাব্যাপী চলে ওই আলোচনা।
বৈঠকে ইউক্রেনের পক্ষে আলোচনায় অংশ নেন দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান রুস্তেম উমেরভ, সেনাপ্রধান অ্যান্ড্রি নাটভ এবং প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ওলেক্সান্দার বেভজসহ আরও বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা। আর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার।
বৈঠকের পর রুবিও জানান, ইউক্রেনের প্রতিনিধি দলের বৈঠক ফলপ্রসু হয়েছে, তবে যুদ্ধের অবসানে একটি চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য আরও অনেক কাজ বাকি। অপরদিকে, উমেরভ যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার প্রশংসা করলেও আলোচনার বিষয়ে বিস্তারিত কিছু প্রকাশ করেননি।
এবার মস্কোর আলোচকদের সঙ্গে মার্কিন আলোচকরা বৈঠকে বসবেন।
গত সপ্তাহে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি তার বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফকে রাশিয়ায় পাঠাবেন। এব বিষয়ে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সোমবার নিশ্চিত করেছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট পুতিন স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) বিকেলে উইটকফের সঙ্গে দেখা করবেন।
এমনকি, এই চুক্তির আশানুরূপ অগ্রগতি হলে ট্রাম্প ভবিষ্যতে পুতিন ও জেলেনস্কির সঙ্গে বসতে পারেন বলেও ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন।
দুই পক্ষের কার কী অবস্থান
ট্রাম্পকে খুশি করতে কিয়েভ ও মস্কো উভয় পক্ষ থেকেই শান্তি পরিকল্পনার বিষয়টিকে স্বাগত জানানো হয়েছে। কিন্তু ইউক্রেনে হামলা বন্ধ করেনি রাশিয়া। ফলে চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছানো যে এখনো অনেক দূরের বিষয়, তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
গত সপ্তাহে পুতিন বলেন, তিনি তার লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন। ২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের যে চারটি অঞ্চল দখল করেছে, ইউক্রেন যদি সেখান থেকে তাদের সেনাবাহিনী পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেয়, কেবল তখনই তিনি হামলা বন্ধ করবেন।
যদিও ওই অঞ্চলগুলোতে এখনও পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি রাশিয়া, তারপরও পুতিনের দাবি, ‘যদি তারা (ইউক্রেনীয় বাহিনী) না সরে, আমরা জোর করে তা আদায় করব, ব্যাস।’
এর মধ্যে ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেছেন, এটি ‘ভবিষ্যৎ আলোচনার ভিত্তি’ হতে পারে। কিন্তু চূড়ান্ত করতে হলে এ বিষয়ে ‘গুরুতর আলোচনা’ প্রয়োজন।
অন্যদিকে, জেলেনস্কি নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে কথা না বলে কেবল ট্রাম্পকে তার (শান্তি স্থাপন) প্রচেষ্টার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি চান, এই প্রক্রিয়ায় ইউরোপের যুক্ত থাকুক, কারণ এতে ইউরোপের স্বার্থও সম্পৃক্ত। এ ছাড়া ইউক্রেনের স্থায়ী নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।
ট্রাম্পের উপস্থাপিত পরিকল্পনার প্রাথমিক খসড়ায় রাশিয়ার কয়েকটি মূল দাবি মেনে নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, ইউক্রেন যেগুলোকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে খারিজ করে দেয়। দাবিগুলো ছিল, ইউক্রেনের যেসব অঞ্চল রাশিয়া এখনও পুরোপুরি দখল করেনি, সেগুলোও রাশিয়াকে ছেড়ে দিতে হবে, ন্যাটোর সদস্য হওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে ইত্যাদি।
জেলেনস্কি বারবার বলেছেন যে ভূখণ্ড ত্যাগ করা কোনো বিকল্প হতে পারে না। গত বৃহস্পতিবার এক সাক্ষাৎকারে ইয়েরমাকও দ্য আটলান্টিককে বলেন, জেলেনস্কি ভূখণ্ড ছাড়ার শর্তে কোনো চুক্তিতে সই করবেন না।
জেলেনস্কির মতে, ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সবচেয়ে সহজ পথ হলো দেশটিকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া। ন্যাটোর ৩২ সদস্য দেশও গত বছর বলেছিল যে, ইউক্রেনকে ন্যাটোয় অন্তর্ভূক্তির বিকল্প নেই। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ট্রাম্প স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ন্যাটোর সদস্যপদ নিয়ে আর কোনো আলোচনা হবে না।
ওদিকে, ইউক্রেনের ভূখণ্ডে পশ্চিমা শান্তিরক্ষী বাহিনীর উপস্থিতি নিয়ে তীব্র বিরোধিতা করে রাশিয়া বলছে, ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য হতে না দেওয়াই ছিল চলমান এই হামলা শুরুর মূল উদ্দেশ্য।
সময় পুতিনের পক্ষে
এদিকে, নিজ দেশেই সম্প্রতি রাজনৈতিক চাপে পড়েছেন জেলেনস্কি। ইয়েরমাকের পদত্যাগ জেলেনস্কির জন্য বড় ধাক্কা, যদিও দুজনের কারো বিরুদ্ধেই কোনো অনিয়মের অভিযোগ আনেননি তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
জেলেনস্কি বলেন, রাশিয়া চায় ইউক্রেন ভুল করুক। কিন্তু আমাদের পক্ষ থেকে কোনো ভুল পদক্ষেপ নেওয়া হবে না। আমাদের কাজ চলমান, আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। একে শেষ পর্যন্ত না নিয়ে যাওয়ার অধিকার আমাদের নেই।
ইয়েরমাকের পদত্যাগে সাময়িক চাপে পড়লেও দীর্ঘ মেয়াদে তা ইউক্রেনের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করেন দেশটির বেসরকারি দুর্নীতি দমন কেন্দ্রের অ্যাক্টিভিস্ট ভ্যালেরিয়া রাডচেঙ্কো। তার মতে, এর ফলে সরকারের মধ্যে একটি ‘সংস্কারের সুযোগ’ তৈরি হবে।
তবে, এর মধ্যেই যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে দাবি করে তা নিয়ে গর্ব করছেন পুতিন। এ বিষয়ে কার্নেগি রাশিয়া ও ইউরেশিয়া সেন্টারের তাতিয়ানা স্তানোভায়া এক্স-এ লিখেছেন, রুশ প্রেসিডেন্ট যুদ্ধের ময়দানে সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। তিনি এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী। তাই তিনি (পুতিন) কিয়েভের পরাজয় মেনে নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতায় বাধ্য হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন।
স্তানোভায়া বলেছেন, ‘আমেরিকা যদি সমস্যা সমাধানের এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে সহযোগিতা করে, তাহলে ভালো। আর যদি না করে, সেক্ষেত্রে তিনি (পুতিন) জানেন কীভাবে এগিয়ে যেতে হবে। এটিই হচ্ছে ক্রেমলিনের বর্তমান যুক্তি।’
ধাঁধায় ইউরোপ
ইউক্রেন ইস্যুতে এ সপ্তাহে বেশ কিছু বৈঠক করছে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
সোমবার প্যারিসে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁর সঙ্গে বৈঠক করেছেন জেলেনস্কি। অন্যদিকে, ব্রাসেলসে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডেনিস শ্মিহালের সঙ্গে বৈঠক করছেন ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটে। একইসঙ্গে সামরিক সহায়তা ও নিজেদের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ ইউক্রেনের আলোচনা করছে। বুধবার (৩ ডিসেম্বর) আবারও ব্রাসেলসে ন্যাটো পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বৈঠকে বসবেন।
ইইউয়ের জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, বেলজিয়ামে জব্দ করা রুশ সম্পদের কী হবে? ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার প্রাথমিক খসড়ায় অবশ্য এগুলো যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ইউক্রেনের পুনর্গঠনে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।
ইউরোপীয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডের লিয়েন এসব তহবিল ইউক্রেনকে সাহায্য করতে ব্যবহারের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। পাশাপাশি রাশিয়ার ওপরও চাপ বজায় রাখার কথা জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু খোদ বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী জব্দ করা এই সম্পদ ইউক্রেনের জন্য ব্যবহারের পক্ষে নন। এর আইনি বৈধতা, ইইউয়ের ওপর প্রভাব এবং রাশিয়ার প্রতিশোধের বিষয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের নাইজেল গোল্ড-ডেভিস বলেছেন, ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার ফলে যে নতুন কূটনীতি শুরু হয়েছে, তা ইউরোপের দুর্বলতাকে ‘নিদারুণভাবে’ উন্মোচিত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রকে ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তাকারী হিসেবে উল্লেখ করে গোল্ড-ডেভিস বলেন, (ইউক্রেন) যুদ্ধ কূটনীতিতে প্রায় উপেক্ষিত। খসড়া প্রস্তাবে কিছু সংশোধন ছাড়া কিছুই করতে পারেনি তারা।’
২ দিন আগে