‘বাংলাদেশে কৃষিতে প্রতিবন্ধী মানুষের ভূমিকা’ এবং ‘প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন-জীবিকায় কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব’ সম্পর্কিত দুটি পৃথক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
শনিবার ঢাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি) মিলনায়তনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দি লেপ্রসী মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ, ইকো-কোঅপারেশন, নরেক এবং বাংলাদেশ কৃষক লীগ আয়োজিত অনুষ্ঠানে দুই গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন এবং সাংবাদিকদের সম্মাননা প্রদান করা হয়।
আরও পড়ুন: প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কোটা সংরক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি ইউজিসি’র অনুরোধ
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ কৃষক লীগের সভাপতি সমীর চন্দ, সাধারণ সম্পাদক উম্মে কুলসুম স্মৃতি, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক (মাঠ সেবা শাখা) মাহফুজ হোসেন মৃধা, ইকো-কোঅপারেশনের হেড অব প্রোগ্রামস মো. আবুল কালাম আজাদ এবং দি লেপসী মিশনের কান্ট্রি ডিরেক্টর সলোমন সুমন হালদার।
প্রধান অতিথি তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘প্রতিবন্ধী কৃষকেরা শারীরিক প্রতিবন্ধিতা জয় করে কৃষিতে অবদান রাখছে সেটি অবশ্যই অনুকরণীয়। যারা প্রতিবন্ধী হয়েও কষ্টসাধ্য কৃষি কাজের সাথে যুক্ত আছেন তাদের আমি ধন্যবাদ জানাই।’
তথ্যমন্ত্রী জানান, দেশে গত পাঁচ দশকে জনসংখ্যা আড়াই গুণ হয়েছে। প্রতি বছর ২ লাখ একর কৃষি জমি কমছে। কিন্তু এর সাথে কৃষি উৎপাদনও বেড়েছে। আর এটি সম্ভবপর হয়েছে বর্তমান সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে। কৃষি জমি যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নগরকৃষি এবং ছাদ কৃষির ওপরও জোর দিতে হবে।
আরও পড়ুন: প্রতিবন্ধী-বান্ধব ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করার আহ্বান
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশে আগে প্রতিবন্ধীদের লুকিয়ে রাখা হতো। কিন্তু এখন বাবা-মা তাদের প্রতিবন্ধী সন্তানদের শিক্ষিত করে এবং তাদের কীভাবে সাবলম্বী করা যায় সেটি ভাবছেন। প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্যকন্যা সায়মা ওয়াজেদের বিশেষ উদ্যোগে প্রতিবন্ধীদের জন্য নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। তারা বিভিন্ন খাতে ভাতা পাচ্ছেন, বিভিন্ন জায়গায় তারা পুরস্কার পাচ্ছেন।’
পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিকদের ধন্যবাদ জানিয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সকলে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের নিয়ে কথা বলে না। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে যেসব সাংবাদিক ভাইবোন রিপোর্ট করেছেন তাদের অভিনন্দন জানাই।’
পুরস্কৃত ৯ সাংবাদিক
দি লেপ্রসী মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ কৃষিতে প্রতিবন্ধীদের ভূমিকা ও অবদান নিয়ে সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করার জন্য নয় সাংবাদিককে পুরস্কৃত করেছে। তথ্যমন্ত্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিকদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন।
পুরস্কারপ্রাপ্ত টিভি সাংবাদিকরা হলেন চ্যানেল-২৪-এর হাসনাত রাব্বী (প্রথম), বাংলাদেশ টেলিভিশনের আফরিন জাহান ও ডিবিসির তাহসিনা সাদিক (যৌথভাবে দ্বিতীয়) এবং যমুনা টিভির রামিজ আহসান ও জিটিভির ফেরদৌস আরেফিন (যৌথভাবে তৃতীয়)।
পুরস্কারপ্রাপ্ত সংবাদপত্র সাংবাদিকরা হলেন আমাদের সময়ের এমএইচ রবিন (প্রথম), দেশ রুপান্তরের আবদুল্লাহ আল মামুন (দ্বিতীয়) এবং বাংলাদেশ প্রতিদিনের নিজামুল হক বিপুল ও ভোরের কাগজের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি শেখ মাহতাব হোসেন (যৌথভাবে তৃতীয়)।
এছাড়া, বিজয় বাংলাদেশের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি মীর খায়রুল আলম এবং ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক রতন মালোকেও বিশেষ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
গবেষণার ফল
দি লেপ্রসী মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ পরিচালিত দুটি গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানের প্রোগ্রাম সাপোর্ট কোঅর্ডিনেটর জিপ্তা বৈরাগী এবং টিএলএমআই-বি এর গবেষণা পরামর্শক জেমস সুজিত মালো। গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় এ বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত।
গবেষণায় পরামর্শক হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সাহানা নাসরিন এবং ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক এ্যাশলে কমা রায়।
আরও পড়ুন: পূর্বাচলে হবে বিশ্বমানের প্যাক হাউস ও অ্যাক্রেডিটেশন ল্যাব: কৃষিমন্ত্রী
‘বাংলাদেশে কৃষিতে প্রতিবন্ধী মানুষের ভূমিকা’ বিষয়ক গবেষণায় উঠে এসেছে যে কৃষিতে বাংলাদেশের শতকরা ৮৬ জন শারীরিক ও কুষ্ঠ প্রতিবন্ধী মানুষ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
দেশের আট বিভাগের ১৬ জেলার ২১০ জন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষ গবেষণায় অংশগ্রহণ করেন যাদের মধ্যে ৪২ শতাংশই পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী সদস্য।
গবেষণায় উঠে এসেছে যে ৬২ শতাংশ প্রতিবন্ধী মানুষ মুরগী পালন করেন, ৫২ শতাংশ গবাদিপশু পালন করেন, ৩৬ শতাংশ শাকসবজি চাষ করেন এবং ৩৭ শতাংশ প্রতিবন্ধী মানুষ জমিতে চাষাবাদ করেন।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে মাত্র ১২.৮৬ শতাংশ প্রতিবন্ধী মানুষ সরকার স্বীকৃত কৃষক, বাকিরা কৃষির সাথে যুক্ত হয়েও সরকারি কৃষিসেবা থেকে বঞ্চিত।
আরও পড়ুন: কৃষি নিয়ে জানতে পারেন সামাজিক মাধ্যম থেকে
এছাড়া মাত্র ৪ শতাংশ প্রতিবন্ধী কৃষক ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পর্যায়ে কৃষিভিত্তিক কমিটির সাথে যুক্ত। বাকি ৯৬ শতাংশ প্রতিবন্ধী কৃষক কোনো কমিটির সাথে যুক্ত নয়। তাছাড়া মাত্র ১৩.৪০ শতাংশ প্রতিবন্ধী কৃষক সরকার প্রদত্ত সেবাসমূহ পায়।
প্রতিবন্ধী ২৪ শতাংশ কৃষক বলেছেন কৃষি-বান্ধব যন্ত্রপাতির অভাবে তাদের কৃষিকাজে সমস্যা হয়। ৩১ শতাংশ বলেছেন তাদের কৃষি ঋণ পেতে সমস্যা হয়। কৃষি মূলধনের সমস্যার কথা বলেছেন ৩২ শতাংশ কৃষক।
প্রতিবন্ধী কৃষকদের মধ্যে ৬৭ শতাংশই বলেছেন তাদের মূলধন সহায়তা প্রয়োজন, ৫৫ শতাংশ বলেছেন সরকারি কৃষিনীতিতে তাদের যেন অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব বিষয়ক গবেষণায় উঠে এসেছে মহামারিকালে দেশের ৮৮ শতাংশ প্রতিবন্ধী কৃষকের আয় কমেছে। তাদের মধ্যে ৮১ শতাংশ চিকিৎসা পায়নি।
এছাড়া গবেষণায় উঠেছে এসেছে ২২ শতাংশ প্রতিবন্ধী কৃষক পরিবারের খরচ কমাতে তাদের কন্যা সন্তানের বিয়ে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: দেশে ভুট্টা চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে: কৃষিমন্ত্রী
লকডাউনের সময় ৬৫.১৪ শতাংশ তাদের কাজের ক্ষেত্র হারিয়েছেন এবং ৩৬ শতাংশ বাধ্য হয়ে কম মজুরিতে কাজ করেছেন।
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল পর্যালোচনা করে গবেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন যে কৃষিনীতি সহসা পরিবর্তন করা না গেলেও জরুরিভিত্তিতে প্রতিবন্ধী কৃষকদের জন্য প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে সরকার প্রদত্ত বিদ্যমান সরকারি কৃষি সুবিধাগুলো যেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিবন্ধী কৃষকদের জন্য সরবারহ করা হয়।
তাছাড়া মহামারির এ দুঃসময়ে রাষ্ট্র এ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সরকারি ভর্তুকির আওতায় আনলে প্রতিবন্ধী কৃষকরা উপকৃত হবেন এবং তাদের কৃষি কার্যক্রম চালিয়ে নিতে পারবেন।
বীজ, সার, প্রশিক্ষণ, কৃষি ঋণ, কৃষিপণ্য বিক্রয়ে সহায়তা, কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকিসহ নানা সুবিধা যেন প্রতিবন্ধী কৃষকও পায় জরুরি ভিত্তিতে সেই ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি বলে গবেষকরা উল্লেখ করেন।