জরিপে আরও দেখা গেছে, লকডাউনের কারণে ৫৭ শতাংশ পরিবার খাদ্য সংকটে ভুগছে এবং প্রায় ৪৬ শতাংশ পরিবারে নারীর প্রতি সহিংসতার পরিমাণ বেড়েছে।
বাংলাদেশি এনজিও কোস্ট ট্রাস্টের মনিটরিং অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগ এ জরিপ চালিয়েছে।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বাংলাদেশে ঘোষিত লকডাউনের ফলে উপকূলে দরিদ্র মানুষের জীবিকার ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়েছে তা জানতে কোস্ট ট্রাস্ট আটটি উপকূলীয় জেলায় জরিপ চালিয়েছে।
জরিপ সম্পর্কে কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় মহাজনের ঋণ শোধ করতে না পারায় একজন দরিদ্র মানুষকে হত্যা করা হয়।
লকডাউনের মধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষের সংকট বুঝতে এ জরিপের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, খাদ্য সংকটে পড়া মানুষের সহায়তায় কোস্ট ট্রাস্ট তার নিজস্ব আয় থেকে উপকূলীয় নয় জেলা ও ৪৯ উপজেলা প্রশাসনের ত্রাণ তহবিলে প্রায় ২০ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে।
কোস্ট ট্রাস্টের মনিটরিং ও গবেষণা বিভাগের তথ্য মতে, সংস্থার ১২টি শাখার অধীনে ২৪০ জন দরিদ্র, নারী প্রধান ও নিম্ন আয়ের পরিবারের মধ্যে এ জরিপ চালানো হয়। ৮৩ শতাংশ উত্তরদাতা গ্রামে এবং ১৭ শতাংশ শহরে বাস করেন। উত্তরদাতাদের মধ্যে ৫৭ দশমিক ৩ শতাংশ নারী-প্রধান পরিবার।
জরিপ অনুসারে, ৪২ শতাংশ পরিবার ৩ বেলা খাদ্যগ্রহণ চালিয়ে যেতে পারছেন। দিনে ২ বেলা খাদ্য গ্রহণ করছেন ৫২ শতাংশ পরিবার এবং ৫ শতাংশ পরিবার একবেলা করে খাচ্ছেন। সপ্তাহে ৩-৪ দিন মাছ, মাংস বা ডিম অর্থাৎ নিয়মিত প্রোটিন খেতেন ৫৬ শতাংশ পরিবার, লকডাউনের ফলে যা নেমে এসেছে ১৩ শতাংশে। ৮৭ শতাংশ পরিবার এখন সপ্তাহে ১-২ দিন প্রোটিন গ্রহণ করছেন।
লকডাউনের কারণে পরিবারের আয় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৪ শতাংশ পরিবারের, আয় এক-চতুর্থাংশে নেমে এসেছে ৩৯ শতাংশ পরিবারের এবং অর্ধেকে নেমে এসেছে ১৯ শতাংশের। নারী-প্রধান পরিবারের ক্ষেত্রে এ চিত্র ভিন্ন। আয় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৬ শতাংশ পরিবারের এবং ৩০ শতাংশ পরিবারের আয় এক-চতুর্থাংশে নেমে এসেছে।
এ সংকট মোকাবিলায় ৬৩ শতাংশ পরিবার চড়া সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন। আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করেছেন ১৮ শতাংশ পরিবার এবং কোথাও ঋণ পাননি বলে জানিয়েছেন ১৩ শতাংশ পরিবার।
লকডাউনে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছেন ৪৮ শতাংশ পরিবার। গরু-ছাগল বিক্রি করে ফেলেছেন ৩৫ শতাংশ পরিবার। নারী-প্রধান পরিবারগুলোর মধ্যে ৩০ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, সঞ্চয় ভাঙা, গরু-ছাগল বা গহনা বিক্রি করার মতো কোনো উপায় ছিল না।
৫৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, লকডাউনের ফলে তাদের পরিবারে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে গালাগালি বা কটুক্তির ঘটনা ঘটেছে ৮২ শতাংশ পরিবারে। ৯ শতাশং পরিবারে গায়ে হাত তোলা এবং ৯ শতাংশ পরিবারে যৌতুকের জন্য চাপ দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
লকডাউন চলমান থাকলে কী করার পরিকল্পনা রয়েছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে ৭৮ শতাংশ পরিবার বলেন, তাদের হয়ত এনজিও বা ব্যাংক হতে ঋণ নিতে হবে। না পাওয়া গেলে চড়া সুদে স্থানীয় মহাজনের থেকে ঋণ করতে হবে। এছাড়াও বাকি সঞ্চয় ভেঙে ফেলতে হবে বলে জানিয়েছেন ৩৮ শতাংশ পরিবার। গরু-ছাগল বা গহনা বিক্রি করে ফেলবেন ২০ শতাংশ পরিবার। আগাম শ্রম বিক্রি করবেন ১৫ শতাংশ। নারী-প্রধান পরিবারে এ হার ১৮ শাতংশ।
৯৪ শতাংশ পরিবার এনজিওর কাছ থেকে নানা ধরনের ঋণ সহায়তা চেয়েছেন, যা এ মুহূর্তে বন্ধ আছে। ৪১ শতাংশ উত্তরদাতা নতুন ঋণ চেয়েছেন, ১৩ শতাংশ চলমান ঋণ বৃদ্ধির দাবি করেছেন এবং ৪৩ শতাংশ সহযোগিতামূলক ঋণ বা আর্থিক সহায়তা চেয়েছেন।
উল্লেখ্য, ঋণপ্রত্যাশীদের প্রায় সবাই তাদের জীবিকার জন্য বিনিয়োগ করবেন। ৬৯ শতাংশ পরিবার এ পরিস্থিতিতে সরকারের কাছ থেকে ত্রাণ সহায়তা দাবি করেছেন এবং ২১ শতাংশ পরিবার নগদ অর্থ সহায়তা চেয়েছেন।
কোস্ট ট্রাস্টের মনিটরিং ও গবেষণা বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়, খাদ্য সংকটে পতিত নিম্ন আয়ের মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য তাদের ক্ষুদ্র উদ্যোগে বিনিয়োগ করতে চায়। সে জন্যই তাদের ঋণ প্রয়োজন। ক্ষুদ্র ঋণ বা অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ব্যবস্থা না থাকলে তারা চড়া সুদে স্থানীয় মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেবেন অথবা সঞ্চয় ভেঙে আরও বিপদগ্রস্ত হবেন।