কানাডায় পাঠানোর কথা থাকলেও দালাল সৌদি আরবে পাঠায় গাজীপুরের আপন দুইভাইকে। বাবাকে জিম্মি করে হাতিয়ে নেয় কয়েক দফায় টাকা। অতপর খুন সৌদিতেই হত্যার শিকার হন দুই ভাই।
বুধবার (২১ মে) সৌদির দাম্মাম শহরের একটি ফ্ল্যাট থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
নিহতদের লাশ দেশে আনার ব্যাপারে সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন স্বজনরা। নিহতরা হলেন– প্রকৌশলী কামরুজ্জামান কাকন (২৬) ও কামরুল ইসলাম সাগর(২২)।
নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, দুই ভাইকে কানাডা পাঠানোর জন্য রাজধানীর নয়াপল্টনের সামিয়া ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক বাহার উদ্দিনের সঙ্গে তাদের বাবা ব্যবসায়ী মোশারফ হোসেনের চুক্তি হয়। কানাডা পাঠাতে ব্যর্থ হয়ে তাদের সৌদি আরবে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানেও চুক্তিমতো চাকরি হয়নি। এসব নিয়ে আদম ব্যবসায়ী বাহারের সঙ্গে নিহতদের বাবার বিরোধ হয়। এর জের ধরেই দুইভাইকে খুন করা হয়েছে বলে ধারণা স্বজনদের।
নিহতদের বাবা মোশারফ হোসেন জানান, দুই ছেলে ছাড়া তার আর কোনো সন্তান নেই। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই তাদের কানাডায় পাঠাতে চেয়েছিলেন। কানাডা পাঠানোর স্বপ্নই কাল হয় তার পরিবারের জন্য।
লাশ দেশে আনার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি। এছাড়া তদন্ত করে দ্রুত দোষীদেরকে বিচার আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন স্বজনরা।
জানা গেছে, বাহার উদ্দিন জব ভিসায় ২১ লাখ টাকায় মোশারফ হোসেনের বড় ছেলে কাকনকে কানাডায় পাঠানোর প্রস্তাব দেন। ৩ লাখ টাকা নিয়ে দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও তিনি কাকনকে কানাডা পাঠাতে পারেননি।
পরে বাহার উদ্দিন ভালো বেতনে ছোট ছেলে সাগরকে ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকায় সৌদি পাঠানোর প্রস্তাব দেন। রাজি হলে গত বছরের অক্টোবর মাসে সৌদি যায় সাগর। কিন্তু কাজের পরিবর্তে তাকে দাম্মামে একটি ঘরে আটকে রেখে আরও ৪ লাখ টাকা দাবি করায় হয় বাবা মোশরফ হোসেনের কাছে। ছেলের কথা ভেবে আরও ৪ লাখ টাকা দিতে বাধ্য হন তিনি।
কানাডা পাঠানোর জন্য নেওয়া ৩ লাখ টাকা ফেরত চাইলে বড় ছেলে কাকনসহ দুই ছেলেকে সৌদির মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ বেতনে চাকরির প্রস্তাব দেন বাহার।
এরপর নতুন করে ৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা নিয়ে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর কাকনকে সৌদি নিয়ে যান বাহার। সেখানে কাজ না দিয়ে দুই ভাইকে একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। বিষয়টি জানার পর বাহার উদ্দিন কাকন ও সাগরের বাবা মোশারফ হোসেনকে উমরা ভিসায় সৌদি গিয়ে ছেলেদের দেখে আসার প্রস্তাব দেন। গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাহার উদ্দিনের সঙ্গে সৌদি আরব যান মোশারফ হোসেন।
এ সময় দুই ছেলেই জানান- তাদের খাবার ডেলিভারির কাজ দেওয়া হয়েছে। ঠিকমতো খেতেও দেওয়া হয় না। রাখা হয়েছে ছোট একটি ঘরে। ২২ ডিসেম্বর তিনি দেশে ফিরলেও দুই ভাইয়ের কাগজপত্র ঠিক করার কথা বলে থেকে সৌদিতে থেকে যান বাহার।
আরও পড়ুন: কেরানীগঞ্জে বিদেশি অস্ত্রসহ যুবক গ্রেপ্তার
দেশে ফেরত আসার সময় বাহার মোশারফ হোসেনকে একটি পলিথিন মোড়ানো প্যাকেট দিয়ে ঢাকার ঠিকানায় পৌঁছে দিতে বলে বাহার। ব্যাগে কি ছিল দেখেননি বলে দাবি করেন মোশারফ। সৌদি বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশ তল্লাশি করে তার কাছ থেকে প্যাকেটটি বাজেয়াপ্ত করে। পরে সেটি রেখে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তিনি দেশে আসার পরদিনই বাহার বাংলাদেশে চলে আসেন। এসেই মোশারফ হোসেনের কাছে প্যাকেট ফেরত চায় সে। ইমিগ্রেশন পুলিশ রেখে দিয়েছে জানালে সেটিতে ১৩ লাখ টাকার স্বর্ণ ছিল দাবি করে টাকার জন্য চাপ দেওয়া শুরু করে বাহার। এমনকি টাকা না দিলে সৌদিতে থাকা ছেলেদের ক্ষতি হবে এমন কয়েক দফা হুমকিও দেন তিনি।
এসব ঘটনায় মোশারফ হোসেন গাজীপুর সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন।
সবশেষ গত ৯ মে একটি মাইক্রোবাসে করে ঢাকা থেকে লোকজন এসে অস্ত্র উঁচিয়ে মোশারফকে খুঁজতে থাকে। ঘটনার সময় মোশারফ বাড়িতে ছিলেন না। তাকে না পেয়ে মোশারফের বৃদ্ধ বাবা আবুল কাশেমকে জিম্মি ও দুই ছেলেকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এরপর জরুরি সেবা-৯৯৯ এ ফোন পেয়ে সদর থানা পুলিশ আবুল কাশেমকে উদ্ধার করে।
গত বুধবার রাত ১২টার পর এক বাংলাদেশি ফোনকলে দুই ছেলের হত্যাকাণ্ডের খবর পান স্বজনরা।
সৌদি দূতাবাসের খবর অনুযায়ী, মঙ্গলবার (২০ মে) সকাল ৭টার দিকে দুই ভাই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে। দুপুরের পর দরজার নিচ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে দেখে ফ্ল্যাট মালিক পুলিশে খবর দেয়। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে মঞ্জু নামে বাংলাদেশি এক যুবককে শনাক্ত করেছে পুলিশ।
মঞ্জুকে দিয়েই বাহার তার দুই সন্তানকে খুন করে থাকতে পারেন ধারণা মোশারফ হোসেনের।
এ বিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান বলেন, সৌদিতে দুই ভাই খুনের ঘটনাটি এক গণমাধ্যমকর্মীর মাধ্যমে জেনেছি। এ বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।