স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, ১৯৭১ এর প্রত্যাশা ও ২০২৪ এর প্রত্যাশা অভিন্ন নয়। ৭১ এর প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বিধায় ২৪ এর এই গণঅভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে শনিবার গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ এই কথা বলেন।
উপদেষ্টা বলেন, আমরা যে স্বাধীন দেশ পেয়েছিলাম, তাকে সমুন্নত রাখার জন্যই দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র গঠনের প্রয়োজন। ৭১ এর পর সংবিধান রচনায় যে ধরনের আলোচনা হয়েছিল, তা থেকে আমরা দিক নির্দেশনা পেতে পারি। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংবিধানের পরিবর্তন করা হয়েছে বিভিন্ন দেশে। সংবিধান জীবিত ডকুমেন্ট, তাকে নিয়ে কাজ করা সম্ভব। গোঁজামিল দিয়ে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে বার বার, তা নিয়ে পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। সব ধরনের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েই গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের দিকে এগিয়ে যাবে দেশ। সরকার সিদ্ধান্ত দেবে না, সিদ্ধান্ত দেবে ছাত্র-জনতা।
আরও পড়ুন: সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে: শাহরিয়ার আলম
এসময় ছিলেন- যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ও সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) উপদেষ্টা ড. আলী রীয়াজ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম, আইন ও সালিশ কেন্দ্রে (আসক) চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না, নিউ এইজের সম্পাদক নূরুল কবীর, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সারা হোসেন, জাবির অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন, ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) সভাপতি মুনিরা খান, সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, চাকমা সার্কেলের প্রধান দেবাশীষ রায়, সাবেক বিচারক ইকতেদার আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের নির্বাহী পরিচালক মনজুর হাসান, সুপ্রিম কোর্টের দিলরুবা শরমিন ও ঢাবির আইন বিভাগের সাবেক ছাত্র হাবিবুর রহমান।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।
এসময় আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধান এমনভাবে পরিবর্তিত করা হয়েছে তাতে ব্যক্তি স্বার্থ বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ব্যক্তির হাতে, প্রধানমন্ত্রীর হাতে অবাধ ক্ষমতা থাকায় দলীয়, রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাংবিধানিক পুনর্লিখন ব্যতীত এই ক্ষমতার এক কেন্দ্রিকরণ বন্ধ করা সম্ভব নয়। সাংবিধানিক পদগুলোতে কেন, কীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল? তা আমাদের অজানা নয়। এমনকি রাষ্ট্রপতি নিয়োগের সিদ্ধান্ত একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর ছিল। ক্ষমতার অপব্যবহারের চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে? নির্বাচন কমিশন কারা নিয়ন্ত্রণ করে? রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও এর সমাধান হতে পারে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, সমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণ।
তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে সংবিধান সংস্কার নয় পুনর্লিখন প্রয়োজন, যাতে নতুনভাবে কোনো দল ক্ষমতায় এসে সংবিধানে নিজেদের মতো পরিবর্তন করতে না পারে। সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। সাংবিধানিকভাবে সংখ্যাগুরুর অত্যাচার বন্ধের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। সংবিধান সংশোধন নাকি নতুন করে পুনর্লিখন প্রয়োজন তা বিতর্কের বিষয়। কে পুনর্লিখন করবে? কে সংশোধন করবে? এই দায়িত্ব কোনো নির্দিষ্ট সরকারের নয়, এই দায়িত্ব জনগণের। সরকারের দায়িত্ব সব জনগণকে পথ তৈরি করে দিতে হবে সংবিধান প্রণয়নে অংশগ্রহণের জন্য।
মাহফুজ আলম বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক কাঠামোতেও পুনর্গঠন প্রয়োজন। সংবিধান পুনর্লিখনের প্রয়োজন বলা হচ্ছে কিন্তু জনগণের মতের প্রতিফলন আদৌ হচ্ছে কি না এইটাও দেখার প্রয়োজন। ধারাবাহিক আকারে সংবিধানে সংশোধন করতে হবে। আদর্শিক ও রাজনৈতিক দিকগুলো থেকে জনগণের সদিচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে হবে। ১৯৭১ এর প্রেক্ষাপট থেকে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সংবিধানে নতুনত্ব আনতে হবে। সব প্রতিষ্ঠানকে বিগত সরকার এমনভাবে ধ্বংস করে গেছে যে ব্যক্তি পর্যায়েও স্বৈরাচারী আচরণ শুরু হয়েছে, এর থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
জেড আই খান পান্না বলেন, বর্তমান সংবিধান ১৯৭১ এর পরিপ্রেক্ষিতে লেখা হয়েছিল। গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংস্কার প্রয়োজন। যে আইন ছিল শাসক শ্রেণির শোষণের জন্য সেই আইন এখনও কীভাবে বিদ্যমান থাকে? আদিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসনকে যদি কিনে ফেলা যায়, তাহলে গণতন্ত্র কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে? সংবিধান বাতিলের মধ্যে গেলে, দশ-বিশ বছর পরে তা আবারও বাতিল হবে।
নূরুল কবীর বলেন, সংসদের কাজ হলো সংবিধান বাস্তবায়ন করা, একই সংসদ সংবিধান প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জড়িত থাকলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। একটা দেশের সংবিধান সেই দেশের রাজনৈতিক জীবনবৃত্তান্ত। সার্বভৌমত্ব জনগণের জন্য হওয়া প্রয়োজন ছিল, যার প্রতিফলন দেখা যায়নি। মৌলিক অধিকার, সমতার কথা আছে কিন্তু তা বাস্তবায়নের কথা নেই সংবিধানে। প্রত্যক্ষ প্রতিবিম্ব থাকা প্রয়োজন সংসদীয় আলোচনায়। নানা রাজনৈতিক বৈষম্যের কারণে পিছিয়ে পড়া মানুষদের কথা তুলে আনতে হবে। সংবিধানের সংশোধনের নামে দলীয়করণ করেছে প্রতিটি সরকার। সব ক্ষমতা একজনের হাতে থাকলে স্বৈরাচার তৈরি হবেই। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা সসীম, জনগণের ক্ষমতা অসীম।
আরও পড়ুন: সংবিধান পুনর্লিখন ছাড়া রাজনীতিকরণ থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব: ড. আলী রীয়াজ
সারা হোসেন বলেন, বৈষম্য এখনো চলমান। সংবিধান সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়ে নতুন করে লেখা বেশ কঠিন। নতুন বাংলাদেশে নতুন সংবিধানে মৃত্যুদণ্ডকে বাদ দেওয়া প্রয়োজন। মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে মৌলিক অধিকারের ওপরও জোর দেওয়া প্রয়োজন। সংবিধানের ব্যাখ্যা আসা প্রয়োজন প্রধান বিচারপতির পক্ষ থেকেই। সংবিধানের সংশোধনের জন্য প্রয়োজন ভিন্ন মত, ধর্মের সবার অংশগ্রহণ দরকার।
ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও সব জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। বর্তমান সংবিধান নিয়ে কোনো গণতান্ত্রিক সরকার চলতে পারে না। বাংলাদেশ যে ভয়াবহ সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা উত্তরণের জন্য সংবিধান পুনর্লিখন। সংবিধান প্রণয়নের জন্য কমিটি গঠন করা প্রয়োজন ছিল তা হয়নি। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম আমাদের দেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক কোনো ব্যক্তিকেই ভরসা করতে পারেন না, তারা মনে করে যে এই প্রজন্মের মানুষ ক্ষমতা পেলেই লুটপাট করবে। বাংলাদেশের সমাজের যে ভঙ্গুর অবস্থা, তা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, সুশীল সমাজ যদি সংবিধান পুনর্লিখন বা সংশোধনে এগিয়ে আসে তাদের উচিত হবে দ্রুত সময়ে কাজ করা।
মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, সংবিধান পুনর্লিখনের ভিত্তিটা কী? যে আন্দোলন হয়েছে তা ছিল প্রথমত কোটাবিরোধী আন্দোলন, সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন নয়। পরিবর্তন সবাই চায়, পরিবর্তন হওয়া উচিত। দারিদ্র্যের জন্য গণতন্ত্রের সুবিধা ভোগ করতে পারছে বিশাল জনগোষ্ঠী। শ্রেণি বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে, গণতন্ত্রের ফল আস্বাদন করতে হলে। বেআইনি কাজকর্মকে আইনি করা হয়েছে আদালতের মাধ্যমে।
মুনিরা খান বলেন, আমরা গণআন্দোলনের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা পেয়েছি। সংবিধান সংশোধনে সদিচ্ছার প্রয়োজন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দেওয়া নির্বাচনের মাধ্যমে যে সংসদ আসবে তা যেন জনগণের মতের প্রতিফলন সংবিধানে নিয়ে আসে। সংবিধানের সংশোধন না করে একনায়কত্বকে প্রতিরোধ করা যাবে না। সংবিধান লিখনের দায়িত্ব সবাইকেই নিতে হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে সংবিধানের পুনর্লিখন বা সংশোধনের। সংবিধানের যে এক তৃতীয়াংশ সংশোধনযোগ্য নয়, তা কিন্তু সংবিধানের মৌলিক কাঠামো নয়। মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন না করেই সংবিধান সংশোধনযোগ্য করা সম্ভব। পঞ্চদশ সংশোধনী স্থগিত করে সংবিধানকে পুনরায় সংশোধন সম্ভব। তরুণ প্রজন্ম, জনগণের আকাঙ্ক্ষা, রাজনৈতিক দলের সুপারিশগুলো নিয়ে সরকারের কাজ করা প্রয়োজন। সংবিধান প্রণেতা কমিটিতে সবার অংশগ্রহণ হবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
দেবাশীষ রায় বলেন, সংবিধানে সংখ্যা যাই হোক, প্রধান বিষয় হোক মৌলিক অধিকারের। ভবিষ্যৎ সংবিধানে কী হবে? তা আমাদেরই ঠিক করতে হবে। নতুন সংবিধানে সমতলের আদিবাসী, পাহাড়ি আদিবাসী, ধর্মীয় বিভিন্ন গোত্রের জনগোষ্ঠী সবারই অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশের সংবিধান থেকে শিক্ষা নিয়ে সব জাতিগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্রের পুনর্গঠন সম্ভব। বর্তমান সংবিধানে জাতিগত নিরপেক্ষতা নেই, যা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
হাবিবুর রহমান বলেন, সংবিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দিতে বাধ্য বর্তমান সরকার নাহলে এই সরকারও ১/১১ এর সরকার হয়ে যাবে।
সংবিধান সংশোধনে দুইটি উপায় অবলম্বনের প্রস্তাব করেন তিনি। তা হলো-
১) জাতীয় সংবিধান প্রণেতা কমিটি
২) জাতীয় অধিবেশনের মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
মূল সমস্যাকে চিহ্নিত করে আগাতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বৈরাচারী সরকার থেকে বিচারিকতন্ত্রে যেন আমরা না চলে যাই।
আরও পড়ুন: সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কেন সাংঘর্ষিক নয়, হাইকোর্টের রুল
হাবিবুর রহমানের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে ইকতেদার আহমেদ বলেন, সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। বিচারকদের সীমাবদ্ধতা থাকায়, শপথ দ্বারা বাধিত হওয়ায় সংবিধান প্রণয়নে সুপ্রিম কোর্টের কোনো ভূমিকা থাকে না, ব্যাখ্যা দেওয়া ছাড়া। গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা প্রয়োজন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সর্বদাই প্রশ্নের সম্মুখীন। সারা বিশ্বের বিচার বিভাগ নাগরিকদের অধিকার আদায়ের প্রতিষ্ঠান, আর বাংলাদেশের বিচার বিভাগ অধিকার হরণের প্রতিষ্ঠান।