আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ বুধবার বলেছে, বাংলাদেশের শিবিরগুলোতে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছেন। যাদের শিগগিরই মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এর মধ্যে শিবিরগুলোতে সহিংসতা বেড়েছে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তার পরিমাণও কমেছে।
যুদ্ধ প্রতিরোধ এবং আরও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে কাজ করা স্বাধীন এই সংস্থাটি বলেছে, দাতাদের উচিৎ সহায়তার পরিমাণ বাড়ানো এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার জন্য ঢাকার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা।
সংস্থাটির নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসার ৬ বছর পরও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তাদের দেশে ফেরার কাছাকাছি পর্যায়ে নেই।’
আরও পড়ুন: ইন্দোনেশিয়ার মতো দুর্দশাগ্রস্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা করুন: জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ
নতুন কী
বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ২০১৭ সাল থেকে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর লড়াই এবং ত্রাণসহায়তা কমে আসায় সেখানকার ভয়াবহ পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ঢাকা ও নেপিডো শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিরাজমান নিরাপত্তাহীনতা এবং নাগরিকত্ব ও অন্যান্য সুরক্ষার বিষয়ে স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি না থাকায় বড় সংখ্যক শরণার্থীর প্রত্যাবাসনের বিষয়টি অবাস্তব।
কেন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ
প্রত্যাবাসনের জন্য চাপ প্রয়োগে ঢাকা শরণার্থীদের চলাফেরার স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশে কাজ করার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। ত্রাণসহায়তা সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ড সংকুচিত করার মাধ্যমে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার কাজও জটিল করে তুলেছে। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে শরণার্থীরা অপরাধী চক্রগুলোতে যোগ দেওয়া থেকে শুরু করে ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসনের মতো মরিয়া পথে পা বাড়াচ্ছে।
কী করা উচিৎ
মানবিক সহায়তায় সাড়াদানের ক্ষেত্রে নিজেদের সমর্থন আরও বাড়ানোর মাধ্যমে বিদেশি সরকারগুলো শরণার্থীদের আশু স্বস্তির ব্যবস্থা করতে পারে। একইসঙ্গে, দীর্ঘস্থায়ী সংকটের সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে দাতাদের সহযোগিতায় ত্রাণসহায়তা দক্ষতা এবং শরণার্থীদের স্বনির্ভরতা বাড়াতে ঢাকার উচিৎ নিজেদের নীতি-কৌশলে সমন্বয় সাধন করা। শরণার্থী শিবিরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোর বিষয়টিও খতিয়ে দেখা উচিৎ ঢাকার।
প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টা
এদিকে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা প্রদানে সাড়াদানে আন্তর্জাতিক সমর্থন কমছে। ২০২২ সালে জাতিসংঘের মানবিক আবেদনে মাত্র ৬৩ শতাংশ অর্থ পাওয়া গেছে। আর ২০২৩ সালের এখন পর্যন্ত অর্থসহায়তার প্রতিশ্রুতি আরও অনেক কমেছে। এর ফলে মানবিক সংস্থাগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাগুলো থেকে পিছিয়ে আসতে হয়েছে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) দুইবার খাদ্য রেশনের পরিমাণ কমাতে বাধ্য হয়েছে। প্রতি মাসে জনপ্রতি ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ৮ ডলার করা হয়েছে, যা একদিনে ২৭ সেন্ট করে পড়ে।
এই কাটছাঁট বিপর্যয়কর; কারণ অধিকাংশ শরণার্থী ত্রাণসহায়তার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাওয়া ঠেকাতে সরকারের বিধিনিষেধের অর্থ হলো তাদের বৈধ কর্মসংস্থান খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক আগ্রাসনের পর খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ইতোমধ্যেই এমন অনেক ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, ত্রাণসহায়তা কমানোর ফলে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার বেড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে দাম্পত্য সহিংসতা আরও বেড়ে যাওয়ার মতো ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে।
২০১৮ ও ২০১৯ সালে দু’টি ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর ২০২৩ সালের শুরুর দিকে নেপিডো এবং ঢাকা প্রত্যাবাসনের একটি পাইলট প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। এর অংশ হিসেবে প্রথম পর্যায়ে এক হাজারের বেশি শরণার্থী ফিরতে পারে।
মধ্যস্থতাকারী ভূমিকায় থাকা চীনের পাশাপাশি দুইপক্ষ (নেপিডো এবং ঢাকা) বিভিন্ন কারণে এ নিয়ে অগ্রগতি সাধনে আগ্রহী। মিয়ানমারের সামরিক সরকার বিশ্বাস করে, ২০১৭ সালের গণহত্যার অভিযোগের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে এ প্রত্যাবাসন তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনে সাহায্য করবে।
আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ বলেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আশা করছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে এটি তাদের পক্ষে কাজে লাগবে। তবে প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। শরণার্থীরা তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে নেপিডোর দেওয়া আশ্বাসের বিষয়ে সন্দিহান আর তাদেরকে স্বাভাবিকভাবে নাগরিকত্ব প্রদানে অস্বীকৃতির বিষয়ে সতর্ক। শরণার্থীদের সতর্ক হওয়ার উপযুক্ত কারণ রয়েছে।
আরও পড়ুন: গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে জি-২০ নেতাদের প্রতি আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নভেম্বরে রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী এবং দেশটির অন্যতম শক্তিশালী জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে নতুন করে লড়াই শুরু হয়। যা নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ এবং স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনকে কার্যত অসম্ভব করে তুলেছে।
ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা, ত্রাণসহায়তা কমে যাওয়া এবং প্রত্যাবাসনে অচলাবস্থা- এই ৩টি বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিষয়গুলো এমন এক সংকট তৈরি করেছে যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের বিধিনিষেধ শরণার্থীদের সহায়তার ওপর নির্ভরশীলতাকে আরও গভীর করেছে এবং মানবিক সহায়তার ওপর চাপ বাড়িয়েছে। ঢাকার এমন নীতি বাস্তবতার সঙ্গে যায় না, যেখানে হাজার হাজার শরণার্থী ইতোমধ্যেই শরণার্থী শিবিরের আশপাশের শহরগুলোতে অনানুষ্ঠানিকভাবে কাজ করছে। সেখানে তারা নিজেদের অবৈধ অবস্থানের কারণে নিয়মিত শোষণের শিকার এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে বাধ্য হয়।
সংস্থাটি বলেছে, শরণার্থী শিবিরে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য এবং অদূর ভবিষ্যতে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা ঘিরে অনিশ্চয়তার কারণে সৃষ্ট হতাশা অনেক রোহিঙ্গাকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থের জন্য তরুণদের সশস্ত্র গোষ্ঠী বা অপরাধী চক্রগুলোতে যোগদান থেকে শুরু করে খাবার গ্রহণকারী সদস্যের সংখ্যা কমাতে পরিবারগুলোতে নিরুপায় হয়ে বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের বাল্যবিয়ে দেওয়া।
কয়েক হাজার হতাশ শরণার্থী মালয়েশিয়ায় যাওয়ার আশায় (সমুদ্রপথে) ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রাও করেছে। একই সময় অজ্ঞাত সংখ্যক শরণার্থী ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও নিরবে রাখাইন রাজ্যে ফিরে গেছে কিংবা সাধারণত শরণার্থী শিবির ছেড়ে যাওয়া নিষেধ এমন আইন থাকার পরও বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে।
ক্রাইসিস গ্রুপ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে এই দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে। দেশটির একটি টেকসই পদক্ষেপের সূচনা করা উচিৎ, যা এ সংকট যে দীর্ঘায়িত ধরনের তা স্বীকার করে নেবে, এমনকি যখন দেশটি প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি করতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে অব্যাহতভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছে।
স্বনির্ভরতা গড়ে তুলতে এবং ত্রাণনির্ভরতা কমিয়ে দেয় এমন উদ্যোগগুলো এগিয়ে নিতে দাতাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে তারা কেবল তখনই সেটা করতে পারে, যখন জরুরি ত্রাণসহায়তার বাইরের কর্মকাণ্ডের অনুমতি দিয়ে ঢাকা তার নীতিগুলো পুনর্বিবেচনা করবে।
অন্তর্বর্তী সময়টুকুতে দাতাদের মানবিক অর্থসহায়তাকে এমন পর্যায়ে ফিরিয়ে আনা উচিৎ, যা শরণার্থীরা যাতে পর্যাপ্ত খেতে পারে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা থেকে শুরু করে তাদের মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে।
গ্রুপটি জানিয়েছে, ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা মোকাবিলায় বাংলাদেশকেও শরণার্থী শিবিরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনা সংস্কার করতে হবে, শরণার্থী জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে বৃহত্তর বেসামরিক নেতৃত্বের সুযোগ করে দিতে হবে এবং ব্যক্তিগত লাভের জন্য শরণার্থী সংকটকে কাজে লাগাচ্ছে এমন অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
আরও পড়ুন: অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তার আহ্বান জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞের