মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে বিমানের জ্বালানিসহ অস্ত্র বা সামরিক শক্তি এবং দ্বৈত ব্যবহারের উপযোগী সামগ্রী সরবরাহ বন্ধের জন্য সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, দক্ষিণ কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।
শনিবার (২৫ মে) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত দেশগুলোর এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, 'মিয়ানমারে ক্রমবর্ধমান সংঘাত এবং বিশেষ করে বেসামরিক নাগরিকদের ক্রমবর্ধমান ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, যা দেশটিতে মানবাধিকার ও মানবিক সংকটকে আরও খারাপ ও ধ্বংসাত্মক করে তুলছে।’
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটিতে মানবিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষের সংখ্যা ১০ লাখ থেকে বেড়ে ১ কোটি ৮৬ লাখে দাঁড়িয়েছে।
বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত লঙ্ঘন ও নির্যাতনের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন রয়েছে যেখানে বাড়িঘর, স্কুল, উপাসনালয় ও হাসপাতালে বিমান হামলা, নির্যাতন, বেসামরিক নাগরিকদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার এবং নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
আরও পড়ুন: নৃশংস অপরাধের জন্য মিয়ানমার থেকে আসা বিজিপি সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্তের আহ্বান
বিবৃতিতে বলা হয়, সংঘাত বাড়তে থাকায় মিয়ানমারজুড়ে সম্প্রদায়গুলো আরও বাস্তুচ্যুত হচ্ছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, দেশটিতে জীবন রক্ষাকারী মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার সীমিত করে দিচ্ছে সামরিক শাসকগোষ্ঠী। আমরা ক্রমবর্ধমান পানি ও খাদ্য ঘাটতি এবং স্বাস্থ্যসেবা, ওষুধ ও গুরুত্বপূর্ণ মানবিক সেবাগুলোর সুযোগ থেকে ব্যাপকভাবে বঞ্চিত হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন। সংঘাতপূর্ণ এলাকাগুলোতে রাস্তাঘাট অবরোধ ও টেলিযোগাযোগ ব্যাহত করার মাধ্যমে মানবিক সহায়তা পাঠানো ও সেখানকার অবস্থা জানার সুযোগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
২০২৩ সালে দেশটিতে স্থলমাইনের কারণে ১ হাজারেরও বেশি বেসামরিক লোক নিহত বা পঙ্গু হয়েছে এবং হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
দেশটিতে বিপুল সংখ্যক মানুষ পাচারের শিকার হচ্ছে এবং এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আটকে রাখা হচ্ছে।
সব পক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে যে তারা বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
দেশগুলোর পক্ষ থেকে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সামরিক শাসকদের ২০১০ সালের বাধ্যতামূলক নিয়োগ আইনের প্রয়োগে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, যা বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই পদক্ষেপ সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বিভক্তি আনছে যা মিয়ানমারজুড়ে পরিচয়ভিত্তিক সহিংসতা বাড়িয়ে তুলছে।’
রাখাইন রাজ্যে সামরিক সরকার ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো শহর ও গ্রামগুলোতে হামলা চালিয়েই যাচ্ছে। বুথিডংয়ে বিপুল পরিমাণে বাস্তুচ্যুতির সাম্প্রতিক প্রতিবেদন নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’
আরও পড়ুন: ‘আমরা ফিরে আসব’ লিখে কি সতর্কতা দিচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী!
দেশগুলো সব ধরনের সশস্ত্র পক্ষকে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্যের ব্যবহার, গুজব ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের ব্যবহার সাম্প্রদায়িক ও আন্তঃসাম্প্রদায়িক সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে। রোহিঙ্গাসহ অন্যান্যদের জোরপূর্বক নিয়োগের প্রতিবেদন সম্প্রদায়গুলোকে আরও বিভক্ত করছে এবং উত্তেজনা ও অবিশ্বাসকে কাজে লাগাচ্ছে।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সব জনগোষ্ঠীই চরম মাত্রার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হচ্ছে। রাখাইন, রোহিঙ্গা ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীসহ সব বেসামরিক মানুষের জন্য পরিস্থিতি ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।’
মিয়ানমারে সংঘটিত সব নৃশংসতার জন্য জবাবদিহি করার দাবি জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের অস্থায়ী ব্যবস্থা আদেশ এবং মানবাধিকার রক্ষা এবং লঙ্ঘন রোধে এটি মেনে চলার প্রয়োজনীয়তার কথা স্মরণ করি।’
দেশগুলো মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২৬৬৯ নম্বর প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে অবিলম্বে সব ধরনের সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। এছাড়াও সব পক্ষকে মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানাতে এবং পূর্ণ, নিরাপদ ও অবাধ মানবিক প্রবেশাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
আরও পড়ুন: আইসিজে’র রায়ে মিয়ানমারের আবেদন খারিজ, গতি পাবে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ: ওআইসি
মিয়ানমারবিষয়ক জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত নিয়োগ ও সংকট সমাধানে অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান), ইউএনএসই ও আঞ্চলিক পক্ষগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টাকেও তারা স্বাগত জানান। বিবৃতিতে বলা হয়, 'আমরা দেশটিতে জাতিসংঘের নেতৃত্বকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা পুনর্ব্যক্ত করছি। সামরিক শাসকদের অবশ্যই নির্বিচারে আটক সবাইকে মুক্তি দিতে হবে এবং আসিয়ানের পাঁচ দফা ঐকমত্যের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।’
যৌথ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'আমরা সব পক্ষকে অর্থবহ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপের ক্ষেত্র তৈরি করার আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে গণতন্ত্র পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করা যায়।’
মিয়ানমারের জনগণের অন্তর্ভুক্তিমূলক, অহিংস ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধদের প্রতি তারা দৃঢ় সমর্থন অব্যাহত রেখেছেন।
এদিকে, শুক্রবার মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে শিরশ্ছেদ ও বাড়িঘর ধ্বংসসহ সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হামলার খবর পেয়ে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে লড়াই আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে, যার ফলে বুথিডং ও মংডু শহরে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
আনুমানিক ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে নাফ নদীর তীরবর্তী একটি এলাকায় পালিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এরই মধ্যে দেশটিতে অবস্থান করছে পালিয়ে আসা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা।
আরও পড়ুন: সহিংসতা বন্ধে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ানোর আহ্বান জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধানের