তিনি বলেন, ‘বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবির ঘটনায় আইনশৃংখলা বাহিনী মামলা করেছে। মামলার প্রতিবেদন ১৭ আগস্ট প্রকাশ হবে। তদন্তের স্বার্থে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখিত দুর্ঘটনার কারণগুলো প্রকাশ করা যাচ্ছে না। লঞ্চডুবির ঘটনায় নিহতদের স্বজনরা যাতে স্বস্তি পায়, আইনী বিচার পায় সে বিষয়ে সরকার সচেষ্ট। তদন্ত কমিটির ২০ দফা সুপারিশ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে।’
লঞ্চডুবির ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন নিয়ে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
আরও পড়ুন: বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবি: ১৩ ঘণ্টা পর নদী থেকে জীবিত উদ্ধার
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব রফিকুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি সোমবার রাতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে ২০টি সুপারিশ করা হয়েছে। তবে তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার কারণ এবং কাদেরকে দায়ী করা হয়েছে এ বিষয়ে কিছু জানাননি প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা যদি হত্যাকাণ্ড প্রমাণিত হলে এ সংক্রান্ত অবহেলাজনিত মামলাটি হত্যা মামলা হিসেবে বিবেচিত হবে।
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সরকার নিরাপদ নৌপথ তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে। নৌযান মালিক, শ্রমিক ও জনগণ সবার স্বার্থ দেখছে সরকার। ভেসেল ট্রাফিক সিস্টেম (ভিটিএস) চালুর লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। ভিটিএস চালু ও ডিজিটালাইজড হলে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। জনগণের অনুভূতির সাথে তাল মিলিয়ে অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: ‘পালিয়ে যাওয়ার পর’ ফের মিটফোর্ডে সুমন বেপারী, মিডিয়ায় কথা বলায় ‘নিষেধাজ্ঞা’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, গত ১১ বছরে দেশের অন্যান্য সক্টেরের ন্যায় নৌ সেক্টরকে শৃংখলার মধ্যে আনার চেষ্টা করা হয়েছে, অনেকটা শৃংখলার মধ্যে এসেছে। ভিটিএস, ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, প্রশিক্ষণ ভেসেল তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশে একটি মেরিন একাডেমি ছিল। নতুন চারটি মেরিন একাডেমি করা হয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে কাজ করা হচ্ছে। ঢাকা সদরঘাটের ওপারে ডকইয়ার্ড স্থানান্তরের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
নৌপরিবহন সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী তদন্ত কমিটির ২০-দফা সুপারিশ সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন। এসময় অন্যান্যের মধ্যে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম মোহাম্মদ সাদেক উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, বুড়িগঙ্গা নদীতে ২৯ জুন সকালে ময়ূর২ লঞ্চের ধাক্কায় মর্নিং বার্ড ডুবে যায়। লঞ্চডুবির ঘটনায় ৩২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সেদিনই তদন্ত কমিটি গঠন করে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) মো. রফিকুল ইসলাম খানকে আহ্বায়ক এবং বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক (নৌনিরাপত্তা) মো. রফিকুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়। তদন্ত কমিটি সোমবার তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
তদন্ত কমিটির সুপারিশ:
১. সদরঘাট হতে ভাটিতে ৭/৮ কি.মি. এবং উজানে ৩/৪ কি.মি. অংশে অলস বার্দিং উঠিয়ে দিতে হবে। এ অংশে পল্টুন ছাড়ানোঙ্গর করা নৌযান রাখা যাবে না। এ অংশ হতে পর্যায়ক্রমে শিপইয়ার্ড ও ডকইয়ার্ড উঠিয়ে দিতে হবে।
২. সদরঘাট টার্মিনালের আশপাশে কোনো খেয়াঘাট রাখা যাবে না। ওয়াইজঘাটের উজানে খেয়াঘাট স্থানান্তর করা যেতে পারে।
৩. লঞ্চের সামনে, পিছনে, মাস্টার ব্রিজ, ইঞ্জিন রুম, ডেকে সিসিটিভি ক্যামেরা বসাতে হবে। মাস্টারের দেখার সুবিধার জন্য পেছনে ক্যামেরা ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও লঞ্চে পর্যায়ক্রমে ওয়াকি-টকি সিস্টেম চালু করতে হবে।
৪. লঞ্চ/জাহাজ ঘাট ত্যাগ করার পূর্বেই ঘাটে ভয়েজ ডিক্লারেশন দাখিল বাধ্যতামূলক করতে হবে। লঞ্চে কতজন যাত্রী বহন করা হচ্ছে, ডেক সাইডে এবং ইঞ্জিনে কারা কারা কর্মরত আছে তা ডিক্লারেশনে উল্লেখ থাকতে হবে।
৫. ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচল বন্ধ করতে হবে। প্রত্যেক লঞ্চে জীবন রক্ষাকারী লাইফ জ্যাকেট ও বয়া রাখতে হবে।
৬. সকল নদীপথে বিভিন্ন নৌযানের স্পিড লিমিট নির্ধারণ করে দিতে হবে। সদরঘাটে স্পিড কন্ট্রোল করার জন্য টাওয়ার স্থাপন ও সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে।
৭. লঞ্চে মেকানিক্যাল স্টিয়ারিংয়ের পরিবর্তে ইলেক্ট্র হাইড্রোলিক স্টিয়ারিং প্রবর্তন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৮. যাত্রীবাহী লঞ্চে মেইন ইঞ্জিনস লোকাল কন্ট্রোল সিস্টেম এর পরিবর্তে ব্রিজ কন্ট্রোল সিস্টেম পর্যায়ক্রমে চালুর কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
9. সানকিন ডেক লঞ্চ পর্যায়ক্রমে উঠিয়ে দিতে হবে। প্রশস্ত ও ব্যস্ত নদীতে এগুলো চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রশস্ত ও ব্যস্ত নদীতে যথাযথ সনদধারী মাস্টার ও ড্রাইভার ছাড়া নৌযান পরিচালনা করা যাবে না। এক্ষেত্রে ডিসপেনসেশন সনদ গ্রহণের প্রথা বাতিল করতে হবে।
১০. যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ করে শিশু, নারী, বয়স্ক লোকদের উঠা নামার সুবিধার্থে গ্যাংওয়ে/ব্রিজ স্থাপন করতে হবে।
১১. সদরঘাটে পল্টুনের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।
১২. সার্ভের মধ্যবর্তী সময়ে নৌযানের নিরাপত্তা সরঞ্জাম ও অন্যান্য বিষয় পরিদর্শন করার নিমিত্ত পরিদর্শকদের পরিদর্শন কার্যক্রম আরও জোরদার এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে।
১৩. উৎসবসহ সকল সময়ের জন্য প্রত্যেক লঞ্চে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত টিকিট বিক্রি বন্ধ করতে হবে। টিকিট প্রদর্শন ব্যতিরেকে কোনো যাত্রীকে লঞ্চে উঠতে দেয়া যাবে না। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের সুযোগ বন্ধ করার জন্য কেবিন সংখ্যা ও ডেক যাত্রীর সংখ্যা নির্ধারণ করে দিয়ে এ সকল টিকেট অনলাইনে বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
১৪. নৌ আইন অমান্যকারীদের শাস্তির মেয়াদ ও জরিমানার পরিমাণ যুগোপযোগী করে আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
১৫. নৌকর্মীদের প্রশিক্ষণ ফলপ্রসূ করার জন্য বিআইডব্লিউটিএকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। নৌযানের ফিটনেস ও নৌকর্মীদের যোগ্যতা সনদ ইস্যুতে নৌপরিবহন অধিদপ্তরকে আরও কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। সার্ভে সনদ প্রদানকারী সংস্থা নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সার্ভেয়ারের সংখ্যা ও লজিস্ট্রিক সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে।
১৬. ডেক এবং ইঞ্চিন কর্মীর ট্রেনিং সেন্টার এর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। দেশে বর্তমানে প্রায় ১৪ হাজার রেজিস্ট্রিকৃত জাহাজ ছাড়াও আরও অরেজিস্ট্রিকৃত অসংখ্য জাহাজ রয়েছে। এ সকল জাহাজে গড়ে কমপক্ষে দুজন মাস্টার ও দুজন ইঞ্জিন চালক নিয়োগ করতে হলে প্রায় ৫৬ হাজার প্রশিক্ষিত জনবল দরকার। দেশে অসংখ্য শিক্ষিত বেকার ছেলে-মেয়ে রয়েছে। তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে জাহাজে নিয়োগ করতে পারলে দুর্ঘটনা কিছুটা লাঘব হতে পারে। এ সকল প্রতিষ্ঠানসমূহকে আরও সক্রিয় করতে হবে এবং প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বৃদ্ধি করতে হবে।
১৭. নৌ দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনের লক্ষ্যে দায়ী মাস্টার, ইঞ্জিন ড্রাইভারদের সাথে সাথে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নৌ দুর্ঘটনা ও নৌযান সংক্রান্ত অপরাধের নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ও আসামি গ্রেপ্তারের জন্য সদরঘাটে কর্মরত নৌপুলিশের জনবলের সংখ্যা ৯ জন থেকে বৃদ্ধি করে কমপক্ষে ২৫ জন করতে হবে।
১৮. নৌযান ও নৌকর্মীদের চলাচল জানার জন্য ও অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য নৌযান ও নৌকর্মীদের ডাটাবেজ তৈরি ও ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
১৯. নৌ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন করতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীদেরকে যথাযথ লজিস্টিক সুবিধা প্রদান করতে হবে। সার্চ এবং উদ্ধার পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
২০. নৌ দুর্ঘটনা গবেষণার বিষয়ে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।