জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের অষ্টম মাসটি সবসময়ই বাংলাদেশিদের জন্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এটি শোকের মাস হিসেবেও পরিচিত। 

আপাদমস্তক রাজনৈতিক নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি একটি লক্ষ্যের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগের জীবন পরিচালনা করেছেন। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়ে তিনি ইতিহাসে তার স্থান নিশ্চিত করেছেন। 

জনগণের উন্নতিতে অপরিসীম অবদানের জন্য, আজকের বাংলাদেশিরা, তাকে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় নেতাদের একজন হিসেবে চিহ্নিত করে। বাঙালির অবিসাংবাদিত এই নেতা একজন সংস্কৃতিমনাও ছিলেন। তিনি তার প্রমাণ দিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে শিল্প ও সংস্কৃতির পাশাপাশি শিল্পীদের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করে। 

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় সমস্ত পরিবর্তনের পেছনের স্বপ্নদর্শী হিসেবে বঙ্গবন্ধু সকলের হৃদয়ে এবং জাতির বুননে রয়েছেন। তিনি দেশের জন্য কাজ করে গেছেন, যতক্ষণ না প্রায় পুরো পরিবারসহ তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই দিনে জাতির পিতাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।

এই দিনটিকে সামনে রেখেই গ্যালারি কসমস ২০১৫ সাল থেকে শোকের মাস আগস্টে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। এই যাত্রা অব্যাহত রেখে, এ বছর গ্যালারি কসমস ‘ব্রেভহার্ট’- শিরোনামে দিনব্যাপী চিত্রশিল্প, আলোকচিত্র ও ভাস্কর্য প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। শুক্রবার, ১২ আগস্ট প্রদর্শনীর  উদ্বোধন হয়েছে। রাজধানীর কসমস সেন্টারে আয়োজিত প্রদর্শনীটি চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি মফিদুল হক প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে এতে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা বীরেন শোম, প্রখ্যাত ভাস্কর রাশা এবং ইন্দোনেশিয়া প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূত হেরু হারতান্তো সুবোলো।

আরও পড়ুন: ‘ব্রেভহার্ট’: বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে গ্যালারি কসমস

কসমস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গ্যালারি কসমসের পরিচালক তেহমিনা এনায়েত এবং কসমস গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ জামিল খান।

মফিদুল হক প্রদর্শনীর উদ্বোধনকালে এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘আগস্ট আমাদের জাতির জন্য শোকের মাস, যেহেতু আমরা এই মাসে জাতীয় শোক দিবস পালন করি। যাইহোক, এই মাসটি একই সঙ্গে আমাদের অনুপ্রাণিত করে, একটি জাতি হিসাবে ঐক্যবদ্ধ হতে - যা বঙ্গবন্ধু তার ঘটনাবহুল জীবনজুড়ে আমাদের শিখিয়েছেন। সকলের জন্য একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক জাতি গঠনের পিছনে তাঁর আদর্শ ছিল সত্যিকার অর্থে ক্ষমতায়ন, যা আমাদেরকে তাঁর আত্মত্যাগকে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে পরিচালিত করে - এবং গ্যালারি কসমস ২০১৫ সাল থেকে ‘ব্রেভহার্ট’ শীর্ষক এই মহান সাংস্কৃতিক উদ্যোগের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করছে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আনা শিল্পকর্ম, ভাস্কর্য, আলোকচিত্র এবং অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের দ্বারা বঙ্গবন্ধুর প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রতিফলিত হয়েছে। আমি এই প্রদর্শনীর সর্বাত্মক সাফল্য কামনা করছি।’

বঙ্গবন্ধুর পরিবার ছাড়াও একজন সত্যিকারের নায়ক ছিলেন, যিনি সেদিন তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁর নেতার ডাকে ছুটে গিয়েছিলেন তাকে বাঁচানোর জন্য। একমাত্র, যিনি অসম্ভব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, দায়িত্বের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। তিনি আর কেউ নন, তিনি শহীদ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (মরণোত্তর) জামিল উদ্দিন আহমেদ, 'বীর উত্তম'। তিনি বাংলাদেশিদের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন কর্নেল জামিল নামে।

সেই নৃশংস সময়ের কথা স্মরণ করে কর্নেল জামিলের বড় মেয়ে এবং গ্যালারি কসমসের পরিচালক তেহমিনা এনায়েত বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধু আমাদের বাবাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন যে তিনি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলা হয়েছে। তিনি তাকে সরাসরি এসে বাঁচাতে বললেন। আমাদের বাবা দ্রুত সাড়া দিলেন এবং তিনি গাড়িতে উঠার আগেই আমাদের মা, আঞ্জুমান আরা জামিল তাকে শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করলেন- ‘তোমাকে কি সত্যিই যেতে হবে?’ তিনি গেলেন। কারণ, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার বিপদে পড়েছে। আমি সত্যিই কখনই কল্পনা করিনি যে আমরা তাকে শেষবারের মতো দেখছি। তবে, আমাদের কোন দুঃখ নেই। কারণ তিনি আমাদের জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারকে বাঁচানোর বীরত্বপূর্ণ প্রচেষ্টার সময় তার জীবন উৎসর্গ করেছেন।’

‘সেই মর্মান্তিক রাতে ঘাতকরা কাউকে করুণা করেনি, এমনকি বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেলকেও নয়। এই স্মারক প্রদর্শনীর মাধ্যমে, আমরা শুধু আমাদের জাতির পিতা ও তার পরিবারের জন্য শোক প্রকাশ করছি না। বরং তাদের প্রাপ্য সর্বোচ্চ সম্মানের সঙ্গে তাদের স্মরণ করছি,’ অনুষ্ঠানে তেহমিনা এনায়েত বলেন।

তেহমিনা এনায়েত এই প্রদর্শনীর নলেজ পার্টনার হওয়ার জন্য ইউএনবি ও ঢাকা কুরিয়ারকে ধন্যবাদ জানান।

কসমস গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাসুদ জামিল খান বলেন, ‘আমাদের ইতিহাসে দুটি উল্লেখযোগ্য বছর রয়েছে- একটি হল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি; অন্যটি হল ১৯৭৫- আমরা এই বছরের ১৫ আগস্ট আমাদের মহান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারকে হারিয়েছি। এই তারিখটি আমার পরিবারের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমার বীর নানা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (মরণোত্তর) জামিল উদ্দিন আহমেদ 'বীর উত্তম'ও এই দিনে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। একমাত্র তিনিই বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে সেখানে গিয়েছিলেন। আমাদের স্বাধীনতার পেছনের এই দুটি দিন অবশ্যই মনে রাখতে হবে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অনুযায়ী বাংলাদেশ দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে, তার কন্যা এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফলতার সঙ্গে জাতিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আমি নিজেই এর সাক্ষী। এই ইভেন্টটি আমাদের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ এবং আমি এই ইভেন্টটি সফলভাবে আয়োজন করার জন্য গ্যালারি কসমসকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই।’

আরও পড়ুন: শনিবার ‘দ্য প্যাশন অব ড্রয়িং-২’ আয়োজন করবে গ্যালারি কসমস

গ্যালারির চেয়ারম্যান এনায়েতউল্লাহ খান বিদেশ থেকে বার্তা পাঠিয়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ছাঁচে আর কোনো নেতাকে আমরা দেখিনি, সে কারণেই আজ তার মৃত্যুর ৪৭ বছর পরও আমি তাকে আমার আজীবন নেতা হিসেবে গণ্য করি।’

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (মরণোত্তর) জামিলের কথা বলতে গিয়ে এনায়েতউল্লাহ খান বলেন, ‘তাঁর সাহস ও বীরত্ব একটি অনন্য কাজের উদাহরণ হিসাবে দাঁড়িয়েছে। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা একটি জাতি হিসাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনাগুলিকে কখনই ভুলব না। আমি এবং আমার পুরো পরিবার মনে করি যে ইতিহাস, সাহিত্য বা অন্য কোনও শৃঙ্খলার মতো সত্য সংরক্ষণে শিল্পের ভূমিকা ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি এই গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীর উদ্বোধনে উপস্থিত থাকার জন্য আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’

বিশিষ্ট শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা বীরেন সোম বলেন, ‘১৯৬৪ সালে যখন আমি প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ) ভর্তি হই, তখন দেখেছিলাম বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ও এর জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কীভাবে লড়াই করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মহান নেতৃত্ব সেই সময়কার রাজনৈতিক আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। আজকের সোনার বাংলা তাঁরই কল্পনা ছিল এবং তিনিই সেই মানুষ যিনি আমাদেরকে একটি সার্বভৌম পতাকা উপহার দিয়েছেন। আমাদের মহান জাতির পিতার যা প্রাপ্য, তা সঠিকভাবে জানানো হচ্ছে।’

কিংবদন্তি কার্টুনিস্ট ও চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী অন্য একটি ভিডিও বার্তার মাধ্যমে এই উদ্যোগের বিষয়ে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘গ্যালারি কসমস  জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর আগস্টে  প্রদর্শনীর আয়োজন করে। ১৯৭৫ সালে যখন বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারকে হত্যা করা হয়েছিল, এটি ছিল আমাদের জাতীয়তা এবং আমাদের সদ্য স্বাধীন দেশের ওপর একটি জঘন্য আক্রমণ। এই প্রদর্শনীটি আমাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধুর প্রতি একটি উপযুক্ত শ্রদ্ধা নিবেদন। গ্যালারি কসমস প্রতি বছর এই বিশেষ প্রদর্শনী এবং এর অন্যান্য শৈল্পিক উদ্যোগের সঙ্গে তাকে স্মরণ করার জন্য প্রশংসার দাবি রাখে।’

বাংলাদেশে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত হেরু হারতান্তো সুবোলো তার স্ত্রীর সঙ্গে প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য গ্যালারি কসমসের এই শৈল্পিক উদ্যোগের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এবং ইন্দোনেশিয়া কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছরের বেশি উদযাপন করছে এবং দুই দেশের মধ্যে অনেক সাংস্কৃতিক মিল রয়েছে। গ্যালারি কসমস কীভাবে এই বহুমুখী শিল্পকর্মের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে তা দেখে আমরা বিস্মিত।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিল্পী ভাস্কর রাশাও যোগ দিয়েছিলেন, যিনি ‘মহান নেতা’ শিরোনামে তাঁর স্বরচিত শ্রদ্ধাঞ্জলি কবিতা আবৃত্তি করেন।