মারাত্মক এ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার পরে একে মোকাবিলা করে একজন কোন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে কীভাবে সেরে ওঠেন তা নিয়ে প্রত্যেকেরই নিজস্ব গল্প রয়েছে।
বাংলাদেশে এ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার পর সেরে ওঠাদের একজন হলেন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের সাংবাদিক আশিকুর রহমান অপু। তিনি ভাইরাসটিকে হারিয়ে সেরে ওঠাদের একজন হতে পারায় নিজেকে শুধু একজন ভাগ্যবানই মনে করছেন না, সেই সাথে আক্রান্ত অন্যরা কীভাবে ঘরে থেকেই চিকিৎসা নেবেন এবং সেরে ওঠার পুরো প্রক্রিয়াটি কীভাবে চালবেন তা নিয়েও উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
ইউএনবিকে তিনি জানান, ‘কখনও মনোবল হারাবেন না- এটাই প্রথম জিনিস। শান্ত থাকুন, হতবিহ্বল হয়ে যাবেন না। সাহস রাখুন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ কঠোরভাবে অনুসরণ করুন। অন্য বড় কোনো শারীরিক জটিলতা না থাকলে আপনার পক্ষে অবশ্যই করোনাভাইরাসকে পরাস্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে।’
বেসরকারি টিভি চ্যানেল এটিএন নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক অপু ভারত থেকে দেশে ফিরে কোভিড-১৯ এর কোনো ধরনের লক্ষণ ছাড়াই ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক হোম কোয়ারেন্টাইন পালন করেন। এর কিছু দিন পরে তীব্র জ্বর, কাশি এবং শরীরে ব্যথা শুরু হলে তিনি কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে যান।
গত ৮ এপ্রিল থেকে তরুণ এ প্রতিবেদক প্রচণ্ড জ্বরে ভুগতে শুরু করেন এবং ১০ এপ্রিল করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা জমা দেন। পরীক্ষা শেষে ১১ এপ্রিল পাওয়া প্রতিবেদনে তার করোনাভাইরাস ধরা পড়ে।
‘আমি একজন অধূমপায়ী। আমার শ্বাসকষ্টের কোনো সমস্যা ছিল না। এটা আমার অনেক ইতিবাচক একটি বিষয় ছিল। চিকিৎসকরা আমাকে বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন,’ বলেন অপু।
এপ্রিল মাসের শেষে দিকে পরপর দুটি পরীক্ষায় তার মাঝে করোনোভাইরাস উপস্থিতির নেতিবাচক ফল আসে। যা তাকে বড় স্বস্তি এনে দেয়।
বাড়ি থেকে চিকিৎসা
সেরে ওঠার পুরো সময়টায় অপুর সাথে ডা. সাকলাইন রাসেল এবং তার এক চিকিৎসক বন্ধু সাবক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন। ওষুধ খাওয়া থেকে শুরু করে চিকিৎসকদের দেয়া পরামর্শগুলো কঠোরভাবে অনুসরণ করেন অপু।
মানসিকভাবে দৃঢ় থাকতে তার অফিস এবং অন্যান্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সহকর্মীরা তাকে উৎসাহ দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু আমার শ্বাসকষ্টের কোনো সমস্যা ছিল না তাই আমাকে হাসপাতালে নেয়ার দরকার পড়েনি।’
পুরো সময়টা জুড়ে অপু ফেসবুক ও মেসেঞ্জারের মাধ্যমে এ দুজন চিকিৎসকের সাথে যুক্ত ছিলেন। তার স্ত্রীও ফোনে চিকিৎসকদের সাথে যোগাযোগ করতেন।
কী কী খেতে হবে?
এ সাংবাদিক বলেন, ‘বিশ্বাস করুন, চিকিৎসা চলার সময়ে আমি প্রচুর পরিমাণে খেয়েছি। প্রতিদিন নিয়ম করে আমি এক গ্লাস দুধ পান করেছি, যা আমি গত ২০ বছর ধরে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম।’
অপু বলেন, আমি ঘন ঘন হালকা গরম পানি পান করেছি এবং গলা শুকিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগই দেইনি। ‘কোনোভাবেই গলা শুকিয়ে যেতে দেয়া উচিত হবে না।’
তিনি দিনে দুবার লবণ মিশ্রিত গরম পানি দিয়ে গারগল করতেন, যা তাকে অনেক আরাম দিত।
সাংবাদিক অপু বলেন, ‘আমি নিয়মিত গরম গরম চিকেন ও ভেজিটেবল স্যুপ খেয়েছি। এবং তা অবশ্যই ঘরেই তৈরি! আমি সিদ্ধ ডিম ও পানিতে লেবু দিয়ে পান করতাম। প্রতিদিন একটি করে মাল্টা খেতাম, যা এ সময় খুবই উপকারী। এছাড়াও ভাত, রুটি এবং অন্যান্য খাবার খাওয়ার পাশাপাশি পেয়ারা এবং আপেল খেয়েছি।’
আলাদা থাকার জায়গা
আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জানার পরে, শুরু থেকেই অপু নিজেকে বাথরুম ও বারান্দা সংযুক্ত একটি কক্ষের মধ্যে চলাচল সীমিত করে ফেলেন।
তিনি বলেন, ‘আমি কখনই আমার কক্ষ থেকে বের হইনি। আমার স্ত্রী আমার কক্ষের দরজার সামনে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সময় সময় যা কিছু খেতে চাইতাম তা রেখে দিতেন।’
অপু তার ব্যবহারের সবকিছু- গ্লাস, প্লেট এবং ফ্লাক্স- আলাদা করে রেখেছিলেন।
অপু বলেন, ‘আমাকে খাবার পরিবেশনের আগে আমার স্ত্রী মাস্ক ব্যবহার করছেন কি না সে বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলাম। আমি তাকে নিরাপদ রাখতে চেয়েছিলাম। খাবার দেয়া ও নেয়ার সময় আমরা একে অপরের সংস্পর্শে আসিনি এবং প্রয়োজনীয় দূরত্ব বজায় রাখতাম।’
শুরুর দিকে বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষীরা অপুর জন্য খাবার কিনে পাঠাতেন এবং তিনি নিজেও অনলাইন থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতেন।
তিনি বলেন, ‘অনলাইনে কেনা ফল, দুধের প্যাকেট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলো খাওয়ার আগে লবণ পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে নেয়া নিশ্চিত করতাম।’
ফিট থাকার জন্য নিয়মিত অনুশীলন করুন
শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে অপু বলেন, আমি প্রতিদিন নিয়ম করে কিছু সময় হালকা অনুশীলন করার সর্বাত্মক চেষ্টা করতাম।
করোনাভাইরাসে সংক্রমিত না হলেও সবাইকে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের পরামর্শ দিয়ে অপু বলেন, ‘আপনি শারীরিকভাবে দুর্বল বোধ করলেও ব্যায়াম করা উচিত। এ সময় আমি বিভিন্ন ধরনের শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামও করেছি।
এখন পুরোপুরি ফিট বোধ করায় এ প্রতিবেদক আগামীকাল শনিবার তার অফিসিয়াল কাজ আবার শুরু করতে যাচ্ছেন।
প্রত্যেকেরই শান্তির জন্য স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যের জন্য শান্তির প্রয়োজন। জীবনযাত্রা ব্যাহত করা, স্বাস্থ্যগত বিষয়ে সাম্প্রতিক অগ্রগতিকে হুমকিতে ফেলা এবং বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাধা দিয়ে পৃথিবী জুড়ে কোভিড-১৯ মহামারি জীবনযাত্রার অনেক ক্ষতি সাধন করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, করোনাভাইরাস সমস্যা সহসাই শেষ হচ্ছে না এবং সারা বিশ্বের মানুষকে একে সাথে নিয়েই চলতে শিখতে হবে।
ডব্লিউএইচওর জরুরি বিষয়ের পরিচালক মাইকেল রায়ান বলেন, ‘এ প্রথমবারের মতো মানুষের মধ্যে নতুন এ ভাইরাস প্রবেশ করেছে। কখন ভাইরাসটিকে মোকাবিলা করে মানুষ বিজয়ী হবে তা অনুমান করা খুব কঠিন।’
জেনেভায় অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এ ভাইরাসটি হয়ত কখনই দূর হবে না।