খুলনার কয়রা উপজেলায় প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দে ৪৩ স্থানে জরুরি বেড়িবাঁধ মেরামত কাজ চলমান রয়েছে। টেন্ডারবিহীন এসব কাজে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা তালিকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে নিজেদের লোক দিয়ে কাজ করানোর অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, কাজের তালিকায় যেসব ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে চলমান কাজ সম্পর্কে তারা কেউ জানে না। ফলে বাঁধ মেরামতের নামে দায়সারা কাজ করে বরাদ্দের সিংহভাগ অর্থ আত্মসাৎ করা।
আরও পড়ুন: প্রাণহীন জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরি!
সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘আপদকালীন সময়ে জরুরি বাঁধ মেরামত’ এর আওতায় দরপত্র ছাড়াই ডিরেক্ট প্রকিউরম্যান্ট মেথড (ডিপিএম) পদ্ধতিতে উপজেলার ৪৩টি স্থানে কাজ চলমান রয়েছে। এ পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধে মাটির কাজসহ জিও ব্যাগ ডাম্পিং ও প্লেসিং কাজ করা হবে। নিয়ম অনুযায়ী দক্ষ ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এসব কাজ করিয়ে নেয়া কথা। কিন্তু পাউবো কর্মকর্তারা কাগজে কলমে কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম লিখে রাখলেও বাস্তবে নিজেদের পছন্দের শ্রমিক দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিল্লাল হোসেন নামে স্থানীয় এক ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য বলেন, ‘টেন্ডারবিহীন কাজগুলো পাউবো’র স্থানীয় কর্মকর্তারা সাব কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে করিয়ে নিচ্ছেন। এলাকার শ্রমিকদের সাথে চুক্তিভিত্তিক কাজ শেষে পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে বিল তুলে নেয় তারা। এতে উভয়ই আর্থিকভাবে লাভবান হয়। মাঝখান থেকে সরকারি বরাদ্দ অপব্যবহারের ফল ভোগ করি আমরাই।’
সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার গোবিন্দপুর নামক স্থানে ১৫০ মিটার বাঁধ মেরামত কাজে আফজাল হোসেন নামে এক ব্যাক্তি অ্যাক্সক্যাভেটরের সাহায্যে মূল বাঁধের ঢালে মাটি কেটে উচ্চতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। এতে ভাঙনের ঝুঁকি আরও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কায় স্থানীয় মানুষ কাজ বন্ধ করে দিলেও পাউবো কর্মকর্তারা ফের কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছেন তাকে।
ইউপি সদস্য আফজাল হোসেন বলেন, ‘কার লাইসেন্সের কাজ তা জানিনে। আমি নগদ তিন লাখ টাকায় কাজটি কিনে নিয়েছি।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯ লাখ ৪১ হাজার টাকা বরাদ্দের এ কাজটি মেসার্স জিয়াউল ট্রেডার্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে।’
আরও পড়ুন: হারিয়ে যাচ্ছে মুরাদনগরের ‘মৃৎশিল্প’
এদিকে, উপজেলায় ১৪/১ নম্বর পোল্ডারে জোড়শিং এলাকায় দুই গ্রুপে ৫৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকা ব্যয়ে ৬০০ মিটার বাঁধ মেরামতসহ অস্থায়ী ঢাল সংরক্ষণ কাজ চলছে। দু’টি কাজই করছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য মোজাফ্ফার হোসেন। তালিকা অনুযায়ি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রানা এন্টারপ্রাইজের নাম রয়েছে। অথচ প্রতিষ্ঠানটির মালিক কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম ওই কাজ সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
তিনি বলেন, ‘যতদূর জানি পাউবোর তত্ত্বাবধানে এই মুহূর্তে যেসব কাজ চলমান রয়েছে তার কোনটিই টেন্ডারে ওঠেনি। অফিস থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করা হয়েছে।’
জানা গেছে, শাকবাড়িয়া ও চৌকুনি নামক স্থানে ৯০ মিটার বাঁধ মেরামতসহ জিও ব্যাগ ডাম্পিং ও প্লেসিং এবং ৭০০ মিটার মাটির কাজে কেএম মনিরুজ্জামান নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। প্রায় ৩৪ লাখ টাকা বরাদ্দের এ কাজ দু’টি সোলায়মান নামে একজন শ্রমিক সরদার করেছেন। তিনি পাউবো কর্মকর্তাদের নির্দেশে কাজ করেছেন বলে জানিয়েছেন।
ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক মনিরুজ্জামান মনি বলেন, ‘আমি কখনই পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ করিনি। আমি মূলত এলজিইডির কাজ করে থাকি। আমার প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার কেন করা হয়েছে আমি কর্তৃপক্ষের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইবো।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাউবো’র স্থানীয় কর্মকর্তারা কাজগুলো বাস্তবায়ন করছে। সেক্ষেত্রে দাপ্তরিক প্রক্রিয়া ঠিক রাখতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করা হয়েছে।
জানা গেছে, পাউবো’র একজন উপসহকারি প্রকৌশলী ও উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ভাগাভাগি করে তাদের পছন্দের লোকজন দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। দেখা গেছে, কাজের নকশা ও প্রাক্বলন অনুযায়ি প্রতিটি কাজে দ্বিগুন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এতে বরাদ্দের অর্ধেক অর্থ আত্মসাতের সুযোগ আগে থেকেই করে রেখেছেন তারা। আবার বরাদ্দের অর্ধেক দামে কাজ কিনে নিয়ে স্থানীয় শ্রমিক সরদাররা লাভের আশায় নিম্নমানের কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে অনেক স্থানে কাজ শেষ হতে না হতেই ধসে পড়তে দেখা গেছে।
তাছাড়া ডাম্পিংয়ের জিও ব্যাগগুলো বাঁধের উপর বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কয়েকটি স্থানে দেখা গেছে, ব্যাগের অর্ধেকরও কম বালু ভরে বাঁধের ঢালে প্লেসিং করায় তা নদীতে চলে গেছে।
আরও পড়ুন: বাস্তবে জীবিত হলেও জাতীয় পরিচয়পত্রে তারা মৃত!
এ ব্যাপারে পাউবো সেকশান কর্মকর্তা (এসও) মশিউল আবেদীন বলেন, জরুরি ভিত্তিতে এ কাজগুলো করা হয়ে থাকে। পরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে বিল করা হয়। ঠিকাদারের সম্মতিতে এভাবে কাজ করা হয় বলে দাবি করেন তিনি।
নিম্নমানের কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, যে যতটুকু কাজ করবে তাকে ততটুকু কাজের বিল দেয়া হবে।
পাউবোর সাতক্ষীরা-২ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুর রহমান বলেন, ‘ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই কাজ করা হচ্ছে। যদি কোন ঠিকাদার অস্বীকার করে সেটা তার ব্যাপার। এখানে পাউবোর কোন কর্মকর্তা কাজের পার্টনার হওয়ার সুযোগ নেই।’