স্বল্পমূল্যে গবাদিপশুর ব্রুসেলোসিস রোগের ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের দাবি করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক।
গবেষক দলের প্রধান হিসেবে আছেন বাকৃবির ভেটেরিনারি অনুষদের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল ইসলাম। এর আগে তিনি দেশের গরুতে ব্রুসেলোসিস রোগের জীবাণু শনাক্ত ও এই ব্যাকটেরিয়ার জীবনরহস্য (জিনোম সিকোয়েন্স) উন্মোচন করেছেন বলে জানা যায়।
ড. মো. আরিফুল ইসলামের গবেষক দলে আরও রয়েছেন একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মিনারা খাতুন, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. জামিনুর রহমান এবং বাকৃবির স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মো. রাইসুল ইসলাম, স্নাতকের শিক্ষার্থী নাহিদুজ্জামান ও অর্ণব সাহা।
বাংলাদেশ একাডেমি অব সাইন্সেস - ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের (বিএএস-ইউএসডিএ) অর্থায়নে গবেষণাটি সম্পন্ন হয়েছে। ২০২০-২৩ সাল পর্যন্ত এই গবেষণাটি করা হয়।
ব্রুসেলোসিস ভ্যাকসিন তৈরির উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল হক ইউএনবিকে বলেন, ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর অ্যানিমেল হেলথের (ডব্লিউওএএইচ) নির্দেশনা অনুযায়ী ব্রুসেলোসিসে আক্রান্ত প্রাণীকে হত্যা করে তাকে পুঁতে ফেলতে হবে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই নির্দেশনা মানা হলেও বাংলাদেশে তা মানা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। কেননা অন্যান্য দেশে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও বাংলাদেশে এর ব্যবস্থা থাকলেও প্রয়োগ নেই বললেই চলে।
আরও পড়ুন: বিগত ১৫ বছরের অপরাধের বিচার কার্যক্রম শুরু করেছে বাকৃবি প্রশাসন
তিনি আরও বলেন, বিদেশি অনেক ভ্যাকসিন থাকতেও এ ভ্যাকসিনটি তৈরির উদ্দেশ্য হলো প্রতিটি অণুজীবের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় অনেক পার্থক্য দেখা যায়, যার ওপর ভিত্তি করে ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্থানীয় জীবাণু নিয়ে গবেষণা করে ভ্যাকসিনটি তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ কমমূল্যে খামারিদের ভ্যাকসিন সরবরাহ ও জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করেই এই ভ্যাকসিনের উদ্ভাবন।
ভ্যাকসিনের খরচের বিষয়ে অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ভ্যাকসিনটির জন্য গবাদিপশু প্রতি খরচ পড়বে মাত্র ৫০ থেকে ১০০ টাকা। বুস্টার ডোজের জন্যও একই খরচ পড়বে। উৎপাদন খরচ, সস্তা কাঁচামাল ও প্রযুক্তিগত বিষয়ে খরচ কম হওয়ায় এত অল্প মূল্যে ভ্যাকসিনটি সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে। ভ্যাকসিনের ফর্মুলা তৈরি আছে তবে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা হয়নি। তবে পর্যাপ্ত অর্থায়ন এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ভ্যাকসিনটির বাণিজ্যিক উৎপাদন সম্ভব। এছাড়াও কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি চায় তাহলে আমরা ভ্যাকসিনটি তৈরি করে তাদের সরবরাহ করতে পারব।
অধ্যাপক আরিফুল ইসলাম বলেন, ব্রুসেলোসিস রোগটি ব্রুসেলা ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে হয়ে থাকে। এই রোগে আক্রান্ত গরু, ছাগল, ভেড়া যদি গর্ভধারণ করে তখন তাদের গর্ভপাত হতে পারে। গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন ৬ মাস পর সাধারণত গর্ভপাত হয়ে যায়। ফলে খামারি একইসঙ্গে বাছুরটিও হারায় এবং গাভীর দুধের উৎপাদনও কমে যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের প্রায় পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ গবাদিপশু এই রোগে আক্রান্ত। পশু মারা না গেলেও খামারিরা প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়েন।
জনস্বাস্থ্যেও ব্রুসেলোসিস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে অধ্যাপক আরিফুল বলেন, ব্রুসেলোসিস একটি জুনোটিক রোগ যা প্রাণী থেকে মানুষে ছড়ায়। সাধারণত পশু চিকিৎসক এবং খামারিরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হন। অজ্ঞতাবশত মাস্ক, গ্লাভস ছাড়া ব্রুসেলোসিসে আক্রান্ত প্রাণীর বাছুর বের করতে গেলে অথবা পরিষ্কার করতে গেলে মানবদেহে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ ব্রুসেলায় আক্রান্ত হলে তার কর্মক্ষমতা কমে যাওয়াসহ নানা সমস্যা দেখা দেয় এবং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ যা থেকে সহজেই আরোগ্য লাভ করা যায় না।
ভ্যাকসিন তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে অধ্যাপক বলেন, ক্লিনিক্যাল ও ফিল্ড ট্রায়ালের মাধ্যমে আমরা ভ্যাকসিনটি তৈরি করেছি। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আমরা ল্যাব প্রাণী সাদা ইঁদুরে ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করে দেখেছি। ইঁদুরগুলোকে ভ্যাকসিন গ্রুপ এবং কন্ট্রোল গ্রুপ এই দুইটি ভাগে ভাগ করা হয়। উভয় গ্রুপের ইঁদুরগুলোকে আমাদের শনাক্ত করা ব্রুসেলা জীবাণু দিয়ে নিয়মিত সংক্রমিত করা হয় এবং পরবর্তীতে বুস্টার ডোজ দিয়ে আবার সংক্রমিত করে দেখতে পাওয়া যায় ভ্যাকসিন গ্রুপে রোগের কোনো লক্ষণ তৈরি হয়নি কিন্তু কন্ট্রোল গ্রুপে হয়েছে। ওই ভ্যাকসিনটি মাঠ পর্যায়েও প্রয়োগ করা হয় এবং এর সফলতা পাওয়া যায়।
ড. আরিফুল বলেন, আমরা ফিল্ড ট্রায়ালের জন্য ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও টাঙ্গাইলের প্রায় ৪০০ গাভীর দেহে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করি এবং পরবর্তীতে ওই গাভীগুলোর এন্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে নির্ণয় করতে পারি ব্রুসেলোসিসের বিরুদ্ধে উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনটি যথেষ্ট কার্যকর। প্রায় ১ বছর ভ্যাকসিনটির ফিল্ড ট্রায়াল চলে।
ভ্যাকসিন সম্পর্কে অধ্যাপক আরিফুল ইউএনবিকে আরও বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ব্রুসেলা অ্যাবোরটাসের আধিক্য বেশি দেখা যায়। ব্রুসেলা অ্যাবোরটাসের বায়োভার-৩ এর বিরুদ্ধে উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনটি সবচেয়ে বেশি কার্যকর। তবে অন্যান্য বায়োভারের বিরুদ্ধেও এটি প্রতিরক্ষা দিবে অ্যান্টিজেনিক মিল থাকার কল্যাণে। আমাদের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনটি মৃত ভ্যাকসিনের অন্তর্গত। প্রতি ছয়মাস অন্তর অন্তর ভ্যাকসিনটির বুস্টার ডোজ দিতে হবে।
ভ্যাকসিনটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অধ্যাপক আরিফুল বলেন, ভ্যাকসিন মূলত দুই ধরনের, জীবিত ভ্যাকসিন ও মৃত ভ্যাকসিন। জীবিত ভ্যাকসিনে অণুজীবটি জীবিত ও দুর্বল থাকে কিন্তু মৃত ভ্যাকসিনে অণুজীবটি মৃত থাকে কিন্তু এন্টিবডি বিদ্যমান থাকে। জীবিত ভ্যাকসিনের অসংখ্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে যেমন, ভ্যাকসিন দেওয়ার সময় ইনজেকশনের সুঁচ ঠিকমতো না ফুটলে ওই জীবিত ব্যাকটেরিয়া মানুষ ও অন্য পশুর সংস্পর্শে এসে রোগ সৃষ্টি করতে পারে, গর্ভপাত করতে পারে, জীবিত ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য কোল্ড চেইন দরকার পড়ে। মৃত ভ্যাকসিনে এমন কোনো সমস্যা নেই বিধায় আমাদের তৈরি ভ্যাকসিনেরও তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
বাকৃবি গবেষক দলের ব্রুসেলোসিস ভ্যাকসিন আবিষ্কারের গুরুত্ব ও মাঠপর্যায়ে ব্রুসেলোসিস রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা পদ্ধতি ও রোগটির ব্যাপকতার চিত্র ইউএনবির কাছে তুলে ধরেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. কর্ণ চন্দ্র মল্লিক।
ডা. মল্লিক বলেন, গবাদিপশুর ক্ষেত্রে প্রধানত লক্ষণ দেখেই রোগটি নির্ণয় করা হয়। ব্রুসেলোসিস গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে। গ্রাম পজেটিভ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট এন্টিবায়োটিক থাকলেও গ্রাম নেগেটিভের বিরুদ্ধে তা নেই। আমরা এক্ষেত্রে ব্রড- স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে থাকি। এছাড়া জেন্টামাইসিনও কার্যকরী। ব্রুসেলোসিস হলে গাভী দুর্বল হয়ে পড়ে বিধায় মাল্টিভিটামিন ব্যবহারের পরামর্শও দিয়ে থাকি।
তিনি আরো বলেন, মাঠ পর্যায়ে আমরা দেখেছি একই গাভীর বারবার গর্ভপাত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রচলিত চিকিৎসার সাফল্যের হার খুবই কম। তবে খুব বেশি পরিমাণে গবাদিপশু যে ব্রুসেলোসিসে আক্রান্ত হয় এমনও না৷ কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে রোগটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষণ দেখে রোগটি নির্ণয় করা হয় বিধায় অনেক সময় এটির নির্ণয় সম্ভব হয় না। বাংলাদেশে সরকার ও বেসরকারি উভয়ভাবেই কোনো ভ্যাকসিন নেই। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা হিসেবে মনে করি দেশে উদ্ভাবিত এই রোগের ভ্যাকসিন পাওয়া গেলে সমগ্র দেশ, জাতি ও প্রাণিসম্পদের জন্য এটি যুগান্তকারী একটি পদক্ষেপ হবে এবং গবাদিপশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে পারব।