রাজধানীতে সরকারি হাসপাতালগুলোতে কোনো খালি জায়গা নেই।ডেঙ্গু রোগীর চাপ বাড়ার কারণে দেখা দিয়েছে শয্যা (বেড) সংকটও। শয্যা বাড়িয়ে পৃথক সেল করেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
প্রতিদিন শত শত ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে রোগীদের প্রচণ্ড চাপ বাড়ার কারণে শয্যা সংকটে অনেকেই চিকিৎসা নিতে এসে ফেরত যাচ্ছেন।সিট না পেয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে রোগীদের নিয়ে ছুটছেন স্বজনরা।
ঢাকার বেশ কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই নাজুক পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। হাসপাতালের আনাচে-কানাচেও বিছানো ম্যাট্রেসে আছে রোগীরা। শুধু হাসপাতালের মেঝেই নয়, হাসপাতালের বারান্দা, বাথরুমসংলগ্ন জায়গাও এখন রোগীতে ঠাসা। রোগী আর স্বজনদের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা পাওয়া ভার।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু: দেশে মৃতের সংখ্যা ২০০ ছাড়াল, একদিনে রেকর্ড ২৪১৮ জন হাসপাতালে ভর্তি
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকায় সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী সামাল দেওয়া মুগদা হাসপাতালে রোগী বেড়েছে কয়েকগুণ।
ডেঙ্গু ওয়ার্ডগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা পূর্ণ হয়ে গেছে। অনেকে মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পরও বেশিরভাগ রোগীকে মশারি ছাড়াই থাকতে দেখা গেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এসব রোগীদের মশারির ব্যবস্থা করে দিলেও গরমের কারণে অনেক রোগী মশারি টাঙাতে অনিচ্ছা প্রকাশ করছেন।
এই অবস্থা শুধু মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, মাতুয়াইল শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে চাপ সামাল দিতে রোগীদের মেঝেতেও রাখতে হচ্ছে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় বিভিন্ন জটিল রোগীদের সঙ্গে ডেঙ্গু রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে।
এসব হাসপাতালে একাধিক রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিকিৎসা নিতে এসে বিভিন্নভাবে ভোগান্তিতে পড়ছেন তারা। বিশেষ করে টিকিট কাটা, রক্ত জমা দেওয়া, টেস্টের ডেলিভারি রিপোর্ট পাওয়া, ডাক্তার দেখানো এবং ওষুধ সংগ্রহ করতে লম্বা সিরিয়ালে দাঁড়ানোসহ প্রতি পদে পদে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
এসব হাসপাতালের ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালে জনবল সংকট একটি বড় সমস্যা।রোগী বাড়লেও চিকিৎসক বাড়ছে না। তাই চাহিদার তুলনায় রোগী বেশি হওয়ায় চাপ সামলানো বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুন: দেশে ডেঙ্গুতে ১৪ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ২৬৫৩
ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকায় রাজধানীর কোভিড ডেডিকেটেড মহাখালী ডিএনসিসি হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ঘোষণার পর ডিএনসিসি হাসপাতালেও বাড়ছে রোগী।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. নিয়াতুজ্জামান ইউএনবিকে বলেন, হাসপাতালের ধারণক্ষমতা ও লোকবলের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি রোগী। আমরা এখন লিখিত শর্তে রোগী ভর্তি করছি, কোনো শয্যা দিতে পারব না। চিকিৎসক আছেন মাত্র পাঁচজন। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য নতুন করে কোনো লোকবল নেই।
তিনি আরও বলেন, এই হাসপাতালে প্যাথলজিতে প্রতিদিন ৩০০ জনের পরীক্ষার সক্ষমতা রয়েছে।যেখানে আমরা সাধারণত দেড় হাজার থেকে ২ হাজার রোগীর নমুনা পরীক্ষা করতাম, সেখানে আমাদের করতে হচ্ছে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার পরীক্ষা। আমাদের এখন তিন শিফট চালাতে হচ্ছে। তাই ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য আলাদা অতিরিক্ত রুটিন করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি।
তিনি বলেন, বর্তমানে দুই ধরনের ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। একটি হচ্ছে ‘ক্লাসিক ডেঙ্গু সিনড্রোম’ (যেখানে রোগীর লক্ষণ থাকে জ্বর কিংবা হাত-পা ব্যথা) এবং অপরটি হচ্ছে ‘কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গু সিনড্রোম’ (যে রোগীর এক থেকে তিনবারের বেশি ডেঙ্গু হয়েছে)। আর হাসপাতালগুলোতে ‘কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গু সিনড্রোম’ রোগী সংখ্যা বেশি।
মিটফোর্ড হাসপাতালে নতুন ভবনের ষষ্ঠ ও সপ্তম তলায় ডেঙ্গু ইউনিট। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি। রোগী ও স্বজনদের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা নেই। অনেক রোগীকে মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে।
আরও পড়ুন: রোগীতে পূর্ণ মুগদা হাসপাতাল, নতুন রোগী না যাওয়ার পরামর্শ
এ ব্যাপারে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (মিটফোর্ড হাসপাতাল) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মো. রশিদ উন নবী সাংবাদিকদের বলেন, শুধু ডেঙ্গু রোগী নয়, এখানে সব ধরনের রোগীকে সেবা দেওয়া হয়। ফলে রোগীদের কিছুটা ভোগান্তি হবে এটাই স্বাভাবিক।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নতুন ভবনে দুটি ডেঙ্গু ইউনিট রয়েছে। একটি ভবনের সপ্তম অপরটি ষষ্ঠ তলায়। এই দু’টি ইউনিটই নির্ধারিত শয্যার চেয়ে তিনগুণ বেশি রোগী ভর্তি। রোগীর এত চাপের পরও করা হয়নি আলাদা ইউনিট বা ওয়ার্ড। অন্য রোগীর সঙ্গে চলছে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা।
মাতুয়াইল শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালের নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ডাক্তার এমএ মান্নান ইউএনবিকে বলেন, চিকিৎসার জন্য সার্জারি বিভাগের ওয়ার্ডটিতে শুধু ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বিছানা, খাট অন্য ওয়ার্ড থেকে নেওয়া হচ্ছে।
ঢাকার বাইরের চিত্রও একই রকম। অনেক জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট না থাকায় রোগীদের পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। কোথাও নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক। শয্যা সংকট তো রয়েছেই। ডেঙ্গু চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা না থাকায় অনেক হাসপাতাল থেকে রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গুতে মৃত্যু ১০, আক্রান্ত ২৩৬১