তাপমাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে তাপপ্রবাহকে ‘দুর্যোগ’ ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও আবহাওয়াবিদরা । একই সঙ্গে এর প্রভাব মোকাবিলায় একটি বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বানও জানানো হয়েছে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইউএনবির এক প্রশ্নের জবাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশে চলমান তাপপ্রবাহকে তারা 'দুর্যোগ' হিসেবে বিবেচনা করছেন।
চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে দীর্ঘ সময় ধরে দেশে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। প্রচণ্ড গরমে বিপর্যস্ত জনজীবন। হিট স্ট্রোকে ঘটছে মৃত্যু। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে অনেকে। ফসলি জমিসহ মৌসুমি ফলের বাগান ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমান এই তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় নেই সরকারের পরিকল্পিত কোনো উদ্যোগ।
খরা’ কে যদি দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়, তাহলে তাপপ্রবাহকে ‘দুর্যোগ’ ঘোষণা করা হবে কি না- জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান ইউএনবিকে বলেন, ‘অপশ্যই এই অতিরিক্ত তাপপ্রবাহকে আমি দুর্যোগ বলব।’
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বর্তমান যে তাপমাত্রা দেখা যাচ্ছে, এটি আমরা দুর্যোগ হিসেবে দেখছি। এর জন্য সারাদেশে আমরা তথ্য নিচ্ছি। কোন কোন জেলায় বেশি তাপমাত্রা, এর ফলে কী কী ক্ষতি হয়েছে, হিট স্ট্রোকে কোথায় কতজন মারা গেছে এবং অসুস্থ হয়েছে তার খবর নিচ্ছি। এছাড়া ফসলি জমিসহ আর কী ক্ষতি হয়েছে, এসব বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি।’
মন্ত্রণালয় থেকে আর্থিক সহযোগিতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেকোনো দুর্যোগে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করি, তেমনি এই দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহযোগিতাসহ সবধরনের সহযোগিতা করব মন্ত্রণালয় থেকে।’
কত তাপমাত্রা কে দুর্যোগ ঘোষণা দেবেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি আমরা এখনো ঠিক করিনি, তবে বর্তমানে কোথাও ৪২, ৪৩ তাপমাত্রা, কোথাও আরও বেশি শোনা যাচ্ছে। এজন্য এরই মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ রাখা হয়েছে। তাপমাত্রা অসহনীয় বলেই এই সিদ্ধান্ত। অতএব আমরা তার পরিমাপ ঠিক করে কোথায় কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে, তা দেখে প্রয়োজনে আমরা সহযোগিতার উদ্যোগ নেব।’
তাপপ্রবাহকে দুর্যোগ ঘোষণা করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো উদ্যোগ আছে কি না- জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান ইউএনবিকে বলেন, সরকার সবশেষ ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ ঘোষণা করেছে। অনেকে বলছেন তাপপ্রবাহকে দুর্যোগ ঘোষণা করার জন্য। আমরা বিষয়টি দেখছি। তাপমাত্রায় সর্বশেষ কী অবস্থা তা জানতে দেশের সব জায়গায় খোঁজ নিতে আমি কর্মকর্তাদের নির্দেশে দিয়েছি॥ তবে তাপপ্রবাহকে দুর্যোগ ঘোষণা দেওয়া হবে কি না- এটা পলিসি লেভেলের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আরও পড়ুন: রংপুর ও সিলেট বিভাগসহ ২ জেলায় মৃদু তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে
সচিব আরও বলেন, ‘এখন আমাদের দুর্যোগের তালিকায় তাপপ্রবাহ নেই। বিষয়টিও সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে। আগে এগুলো এভাবে ছিলও না। কোনো কোনো সময় সৌদি আরবের চেয়েও বাংলাদেশে তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। তবে বিষয়টা নিয়ে আমরা দেখছি।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছরই দেশে তাপপ্রবাহের তীব্রতা ও স্থায়িত্ব বাড়ছে। এটাকে দুর্যোগ ঘোষণা করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, বর্তমান তাপমাত্রা একেবারেই অসহনীয় পর্যায়ে। হিটস্ট্রোক হচ্ছে, শিশুরা ভুক্তভোগী হচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের আয়-উপার্জন কমে যাচ্ছে। তাপপ্রবাহের একটা নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতির ওপরে পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। যার ফলে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক রোগ নিয়ন্ত্রণ পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ ইউএনবিকে জানান, বর্তমানে তাপপ্রবাহ একেবারেই অসহনীয়। দাবদাহের কারণে যদি কলেরা, অন্য কোনো মহামারি দেখা দেয়, জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, সেক্ষেত্রে দুর্যোগ ঘোষণা করা যেতে পারে। দুর্যোগ ঘোষণা করে কর্মকৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে। কর্মকৌশলের একটি লক্ষ্য থাকবে যাতে দাবদাহে কারো মৃত্যু না হয়।
তিনি বলেন, ‘আমাদের শরীর যে তাপমাত্রায় স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে, এমন উচ্চ তাপমাত্রায় তা পারে না। নানা ধরনের শারীরিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় অস্বাভাবিক হয়ে যায়। সরাসরি হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে কারো জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। আবার কারো কারো অন্য ধরনের অসুস্থতা ও সংক্রমণও হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘দাবদাহজনিত সমস্যা মোকাবিলায় একটা জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন করা দরকার। সেই কর্মকৌশলের একটি বিষয় থাকবে। এই যে পরিবর্তনগুলোর ফলে তাপ বাড়ছে, সেটাকে কীভাবে প্রশমিত করা যায়। গাছপালা লাগানো, বনায়ন, অনেক ছায়াবদ্ধ গাছ থাকলে তাপমাত্রা বাড়লেও মানুষের জীবনযাত্রা সহনীয় থাকবে।’
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে 'অতি তীব্র' তাপপ্রবাহ বইছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন ও ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেন্ট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ড. মো. জিল্লুর রহমান ইউএনবিকে বলেন, তাপমাত্রা প্রতি বছরই বাড়ছে, এজন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বেড়ে গেছে। আমরা আগের চেয়ে বেশি গরম অনুভব করি গ্রীষ্মকালে। দাবদাহের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। তাপ যাতে সহনীয় হয় সেই পদক্ষেপগুলোও নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারা পৃথিবীতেই তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। দাবদাহ দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সার্বিকভাবে জনজীবন বিঘ্নিত হচ্ছে। আমাদের সেজন্য প্রচুর গাছপালা লাগাতে হবে, জলাশয় রাখতে হবে। জলাধার নষ্ট করা যাবে না।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কোনো বিস্তৃত এলাকাজুড়ে নির্দিষ্ট সময় ধরে তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি থাকলে মৃদু, ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি থাকলে মাঝারি ও ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তীব্র এবং ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকলে তাকে অতিতীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়।
গত ২০ এপ্রিল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল যশোরে। এটিই ছিল চলতি মৌসুমে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। ওইদিন দিনের তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৪ ও পাবনার ঈশ্বরদিতে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ঈদের ছুটির পর গত ২১ এপ্রিল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা থাকলেও তাপপ্রবাহের কারণে তা বন্ধ।
আরও পড়ুন: তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকায় মঙ্গলবার ২ হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং