সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, পরিচালনা কমিটির নিষ্ক্রিয়তা, নতুন বই ও প্রযুক্তি-আধুনিকতার অভাবসহ নানা কারণে জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরিটি এখন প্রাণহীন। বই পড়তে এখন আর কেউ লাইব্রেরিমুখী হয় না। ফলে প্রায় ১৮ হাজার মূল্যবান বই নষ্ট হওয়ার পথে।
সংশ্লিষ্ট জানায়, জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরির আদি নাম ছিল করনেশন রিডিং ক্লাব। ব্রিটিশ আমলে ব্রাহ্ম সমাজের সুধীজন এটি প্রতিষ্ঠা করেন। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে জামালপুর পৌরসভার কার্যালয়ের একটি কক্ষে জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরি নামকরণ করে এর কার্যক্রম শুরু হয়। সেই সময় এ এইচ সিদ্দিক নামে এক সাব-রেজিস্টার ও স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা লাইব্রেরি পরিচালনা পরিষদে ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় জেলার প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক-অ্যাডভোকেটসহ সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার স্থানীয় ব্যক্তিরা লাইব্রেরি পরিচালনা করেন। ১৯৭৬ সালে ১৮ মে শহরের বকুলতলাস্থ কলেজ রোডে নিজস্ব একতলা পাকা ভবনে জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরি কার্যক্রম শুরু হয়। সেই থেকে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাণ কেন্দ্র এই লাইব্রেরি।
পাঠকদের বই লেন-দেন, বই মেলা, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, চিত্রপ্রদর্শনী, বিতর্ক অনুষ্ঠান, পিঠা উৎসবসহ নানা উৎসব-আয়োজনে মুখরিত ছিল লাইব্রেরি প্রাঙ্গন। প্রতিদিন শতাধিক সদস্য এখান থেকে বই নিতেন, জমা দিতেন। বিকাল হলেই উন্মুক্ত পাঠকদের সংবাদপত্র পড়তে ভিড় জমে যেতো। গবেষণা এবং বিভিন্ন চাকরি প্রত্যাশীদের চাকরির খোঁজখবর ও তথ্য সংগ্রহ করতে একসময় এই পাবলিক লাইব্রেরির সংবাদপত্রগুলোই ছিল মূল উৎস।
আরও পড়ুন: হারিয়ে যাচ্ছে মুরাদনগরের ‘মৃৎশিল্প’
জানা গেছে, প্রায় দেড় যুগ আগে এই লাইব্রেরিতে ১৭৫ জন আজীবন সদস্য ছাড়াও ২৪৫ জন ছাত্র সদস্য ও ২৪৯ জন সাধারণ সদস্য ছিল। যারা প্রতিদিন লাইব্রেরি থেকে বই সংগ্রহ করে তাদের জ্ঞান ভাণ্ডরকে সমৃদ্ধ করতেন। এখন দিন বদলে গেছে, ডিজিটাল যুগে বইয়ের পাতায় জ্ঞান অন্বেষণ থেকে মানুষ সরে যাচ্ছে। ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব নিয়ে সবাই ব্যস্ত। তাই কেউ লাইব্রেরিমুখী হতে চায় না। যে কারণে লাইব্রেরিতে দৈনিক পত্রিকা রাখাও দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ রয়েছে।
বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এই লাইব্রেরির কার্যক্রম প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। ২০০৪ সালে তিন বছর মেয়াদি ১৩ সদস্য বিশিষ্ট নতুন কার্যকরি কমিটি হয়। তারপর আর নির্বাচন হয়নি। মূলত ওই কার্যকরী কমিটির নিষ্ক্রিয়তার কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।
বর্তমানে এখানে খুবই সামান্য বেতনে একজন করে গ্রন্থাগারিক ও পিয়ন কর্মরত আছেন। কিন্তু প্রায় ১২/১৩ বছর ধরে তারা বেতন পান না। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে লাইব্রেরির উন্নয়নে প্রতি বছর বই ও নগদ টাকা অনুদান হিসেবে আসতো কিন্তু পরিচালনা কমিটির নিষ্ক্রিয়তার জন্য চার/পাঁচ বছর সেটাও বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুতের বকেয়া বিলের পাহাড় জমে গেছে। ভবনের ছাদের পলেস্তারা খসে বর্তমানে জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরির জীর্ণশীর্ণ ভবন চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
স্থবির হয়ে থাকা লাইব্রেরির কার্যক্রমকে গতিশীল ও দ্রুত একটি নির্বাচন করে নতুন কমিটির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার লক্ষ্যে মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে গত বছর ২০ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসককে প্রধান করে সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। অথচ কমিটি গঠনের ১১ মাস অতিবাহিত হলেও লাইব্রেরির উন্নয়নে দৃশ্যমান কোনকিছু দেখাতে পারেননি কমিটির সদস্যরা।
আরও পড়ুন: বাস্তবে জীবিত হলেও জাতীয় পরিচয়পত্রে তারা মৃত!
লাইব্রেরির বিলুপ্ত কমিটির একাধিকবার নির্বাচিত সদস্য, কবি ও লেখক আলী জহির বলেন, বইয়ের পাঠক আগের মতো আর নেই। ডিজিটাল যুগ আসার পর বই থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চললে প্রকৃত জ্ঞান অন্বেষণ হবে না। নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হবে না। প্রযুক্তিবান্ধব তরুণ প্রজন্মকে বইমুখী করতে লাইব্রেরিকে আধুনিক করতে হবে, বইকে তাদের কাছে নিয়ে যেতে হবে, বই করতে হবে সহজলভ্য।
বিলুপ্ত কমিটির নির্বাচিত অপর সদস্য কবি, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী সাজ্জাদ আনসারি বলেন, ‘একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার যুগে পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নের সর্বোচ্চ প্রশংসার দাবিদার। জামালপুরেও এই উন্নয়নের ধারা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই উন্নয়ন দৃশ্যমান সবকিছুতেই হচ্ছে কিন্তু চেতনার উন্নয়ন হচ্ছে না। মানবিক চেতনার উন্নয়নের জন্য পাবলিক লাইব্রেরি একটি প্রধান মাধ্যম। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রায় দেড় যুগ ধরে জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরির কমিটির অস্তিত্ব নেই।’
তিনি বলেন, ‘মানবিক উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরিটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আমি মনে করি অবিলম্বে জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরির নতুন কমিটি গঠন করে ব্যাপক কর্মসূচির মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে যুক্ত করে লাইব্রেরিটিকে পুনর্জাগর প্রয়োজন। সম্ভবমত লাইব্রেরিকে ডিজিটাল প্রযুক্তির আওতায় আনা জরুরি।’
জাসদ জামালপুর জেলা শাখার সভাপতি জাহিদ হাবিব জানান, বর্তমান কম্পিউটার, ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের যুগে তরুণ প্রজন্মের আজ আর লাইব্রেরিমুখী হওয়ার ফুসরত নেই। পাঠকের আনাগোনা না থাকায় আড়ালে পড়ে যাচ্ছে এক সময় আলোর মশাল জ্বালানো জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরি।
আরও পড়ুন: পাহাড়ে চলছে নবান্নের প্রস্তুতি
জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরির নবগঠিত কমিটির আহ্বায়ক ও জামালপুরের জেলা প্রশাসক মোর্শেদা জামান জানান, দীর্ঘদিন ধরে স্থবির হয়ে পড়া জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে এর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছি। লাইব্রেরির সামনে রাস্তার চলমান কাজ শেষ হলে জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরিকে গতিশীল করার লক্ষ্যে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যা যা করা প্রয়োজন তা দ্রুতই শুরু করা হবে।