সরকারের কাছে বেসরকারি খাতের উৎপাদকদের ক্রমবর্ধমান অর্থ বকেয়া বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে একটি বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। যা এই খাতের বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি খাতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে (পিপিএ) অর্থপ্রদানের পদ্ধতি মূলত বৈদেশিক মুদ্রা; বিশেষত মার্কিন ডলারে নির্ধারিত হয়েছে।
বিদ্যমান ব্যবস্থা অনুযায়ী, একক পরিশোধকারী হিসেবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি) তার বিদ্যুৎ ক্রয়ের বিপরীতে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের স্থানীয় মুদ্রায় অর্থ পরিশোধ করে।
পিপিএ এর অধীনে, বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা তাদের বিভিন্ন ধরনের অর্থপ্রদানের বাধ্যবাধকতা যেমন- ব্যাংক ঋণ, জ্বালানি এবং যন্ত্রপাতি আমদানি ও বিদেশি কর্মীদের বেতন প্রভৃতির ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারে অর্থ পরিশোধ করে।
বিনিয়োগকারীরা বিদেশি কোম্পানি হলে, তারা তাদের মুনাফা মার্কিন ডলারে ফেরত দিতে পারে বলে জানান বিপিডিবির কর্মকর্তারা।
তারা আরও উল্লেখ করেছে, বিপিডিবি সবসময় বৈদেশিক মুদ্রা প্রত্যাবাসন মসৃণ করতে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী, তাদের ব্যাংক এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ রাখে।
সরকারি সূত্র জানায়, কিন্তু দেশে ডলার সংকটের কারণে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিপিডিবি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী উভয়ই তাদের ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার পেতে চরম সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
সরকারি সূত্র আরও জানায়, বিপিডিবি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের পাওনা পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিপিডিবি-র কর্মকর্তারা বলেছেন, বর্তমানে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারের কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের (আইপিপি) মোট পাওনা ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার (৩৫ হাজার কোটি টাকার সমতুল্য)।
আরও পড়ুন: শীতকালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ৭০ শতাংশ নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে
সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, আইপিপিরা তাদের বিল নিয়ে দুই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। প্রথমত, তারা সময়মতো বিল পাচ্ছেন না এবং দ্বিতীয়ত, তারা আংশিক বিল পাচ্ছেন, কিন্তু ডলার সংকটের কারণে প্রাপ্তঅর্থকে বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তর করতে পারছেন না।
বিপিডিবির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ইউএনবি-তে সমস্যাটি স্বীকার করে বলেছেন, তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছেছেন যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিপিডিবিকে প্রতিদিন গড়ে ২০ মিলিয়ন ডলার দিবে তার খরচ মেটাতে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিডিবি'র একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ইউএনবিকে বলেন, ‘তবে আমরা প্রতিদিন ১০-১৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি পাচ্ছি না।’
তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ খাতে ক্রমবর্ধমান বকেয়া নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা না নিলে সমস্যা আরও বাড়বে।
অর্থ বকেয়ার কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সাবেক সভাপতি ইমরান করিম বলেন, বিদ্যুৎ খাতে বকেয়া পরিশোধের জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
তিনি ইউএনবিকে বলেন, ‘অন্যথায় এতে বকেয়া জমে থাকবে এবং এই খাতে একটি বড় সংকট তৈরি করবে।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশের বিদ্যুৎ খাত সংকটের দিকে এগোচ্ছে এবং মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়াতে সামগ্রিক অর্থনীতিতে একটি বড় প্রভাব ফেলবে এটি।
বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভুল পরিকল্পনার কারণে এত বড় সমস্যায় পড়েছে।
তিনি বলেন, ভুল পরিকল্পনার ফলে দেশে গ্রীষ্মকালে ৫০ শতাংশ এবং শীতকালে ৭০ শতাংশ উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ থাকছে, যার জন্য দেশ এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে।
তিনি ইউএনবিকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতে একটি বড় বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। কারণ বেসরকারি খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের চাপ বাড়তে থাকবে এবং প্রাথমিক জ্বালানির আমদানি বাড়বে। সবমিলিয়ে, এটি জ্বালানির নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করবে।’
আরও পড়ুন: আদানি প্ল্যান্ট থেকে বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে পরীক্ষামূলক বিদ্যুত সঞ্চালন শুরু
জ্বালানির দাম স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যুত ও গ্যাসের দাম কমানো যাবে না: তৌফিক ইলাহী