বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতে, র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ বিএনপিকে নির্ভয়ে রাস্তায় নামতে সক্রিয় করতে সাহায্য করেছে।  দলটির সাম্প্রতিক সমাবেশে এর প্রতিফললন দেখা গেছে।

তিনি আরও বলেন,আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিএনপির কর্মসূচিতে এখন আর অতীতের মতো আগ্রাসী নয়। কারণ এটি একটি সর্বজনীন অনুশীলন যে যখন জনগণ ন্যায্য দাবি নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, সামরিক ও বেসামরিক আমলারা তখন তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় না।

এই সপ্তাহে ইউএনবিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফখরুল বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের পরিকল্পনা,১০ ডিসেম্বরে ঢাকার সমাবেশ,নির্বাচন কমিশন,আগামী সাধারণ নির্বাচন,প্রস্তাবিত জাতীয় সরকার এবং ভারত ও জামায়াতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কসহ আরও অনেক বিষয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারের প্রথম অংশ প্রকাশ করা হলো।

ফখরুল বলেন,‘সরকার যখন অপ্রতিরোধ্য গতিতে তাদের সমস্ত অপকর্মগুলো করে যাচ্ছিল,দেশ ও দেশের বাইরে তীব্র প্রতিবাদ এবং র‌্যাবের ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা তখন বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষকে আশা জুগিয়েছে। এটি বিএনপিকেও উৎসাহিত করেছে।’

বিএনপি নেতা আরও বলেন,তাদের দলের নেতাকর্মীরা আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে একটি বার্তা পেয়েছে যে গণতন্ত্রপ্রিয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ধরনের কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আর মেনে নেবে না।

বিএনপি নেতা আরও বলেন,তাদের দলের নেতাকর্মীরা এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে একটি বার্তা পেয়েছে যে গণতন্ত্রকামী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ধরনের কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি আর মেনে নেবে না।

তিনি আরও বলেন,‘যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিবেদনে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু এবার তারা শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধেই সোচ্চার হয়নি,বরং তারা (নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে) পদক্ষেপ নিয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের দারুণভাবে উৎসাহিত করেছে। এছাড়াও, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটের বাংলাদেশে সফর এবং এই বিষয়ে তার পরবর্তী বিবৃতি অবশ্যই আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে।’

গণজাগরণ শুরু হয়েছে

ফখরুল বলেন,সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো, জনগণ এখন সরকারের দমনমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এগিয়ে আসছে।

অতীতের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, মানুষ যখন বাধা উপেক্ষা করে তাদের সাহসিকতা দেখাতে শুরু করে, তখন সরকার যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করতে চায়, তারাও সবসময় জনগণের মুখোমুখি হয়ে তার (সরকারের) অন্যায় নির্দেশ মানতে পারে না।

তিনি বলেন,‘আমরা আমাদের সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের খুব ভালভাবে জানি। জনগণ যখন প্রতিরোধ করে রুখে দাঁড়াবে, তখন সামরিক ও বেসামরিক আমলারা জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় না। শ্রীলঙ্কায়ও তাই হয়েছে এবং সব জায়গায়ই তাই হয়।’

ফখরুল বলেন,বিশেষ করে ভোলা,নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জে পুলিশের গুলিতে বিরোধী দলের চার নেতাকর্মী নিহত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন অতীতের মতো আগ্রাসী মনোভাব দেখাচ্ছে না।

এটা বিএনপিকে নির্বাচনে আনার কৌশল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘আমার তেমন মনে হয় না। আমরা মনে করি তারা (আইন প্রয়োগকারী সংস্থা) সম্ভবত জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ থেকে তারা এটি করছে।’

শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা

ফখরুল বলেন,আওয়ামী লীগের দুঃশাসন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সরকার পরিবর্তন ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছে না বলেই জনগণ জেগে উঠেছে।

একজন রাজনীতিক হিসেবে তিনি বলেন,‘বাংলাদেশের ঐতিহ্য আছে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের। অতীতেও আমরা এটা দেখেছি, পাকিস্তান আমলেও দেখেছি, এমনকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল বিশ্বাসও কিন্তু গণঅভুত্থান।একইভাবে আমরা ১৯৯০ সালেও দেখেছি। ‘আমরা সব দিক থেকেই এগোচ্ছি। আমরা একটি উদার গণতান্ত্রিক দল এবং আমরা আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের দিকে যাচ্ছি।’

শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধান না হলে বিএনপি কী করবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অতীতের কোনও সরকারই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জনগণের দাবি মানতে চায়নি। ‘কিন্তু যখন তারা ক্ষমতায় আঁকড়ে ধরার কোনও বিকল্প খুঁজে পায় না, তখন হয় তারা নিজেদের পালানোর পথ তৈরি করে বা মানুষ নতুন একটি পথ তৈরি করে।’

বিএনপির জ্যেষ্ঠ এই নেতা আরও বলেন, সেই মুহূর্ত এখনও আসেনি। ‘এরশাদের বিরুদ্ধে ৯ বছর একটি  আন্দোলন হয়েছে।  কিন্তু ১৯৯০ সালের সেই মুহূর্তটি ডা. মিলন হত্যার মধ্য দিয়ে এসেছে। আমরা লক্ষ্য করছি যে জনগণ এখন ক্রমান্বয়ে এগিয়ে আসছে এবং সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে আমাদের কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছে।’

তিনি বলেন,জনগণ বর্তমান সরকারকে গণবিরোধী বলে মনে করে এবং তারা মনে করে আওয়ামী লীগ শুধু নিজেদের কল্যাণে কাজ করছে। ‘তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি,নাগরিক পরিষেবা এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটেও বিরক্ত।’

এছাড়া এই বিএনপি নেতা বলেন,রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা এতটাই নির্যাতিত হয়েছেন যে, তারা স্বাধীনভাবে কোনও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও করতে পারছেন না। ‘সরকার জনসভা-সমাবেশে বাধা দিচ্ছে এবং বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। বর্তমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জনগণ মনে করে একটি আশু পরিবর্তন প্রয়োজন এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে সুস্থ পরিবেশ তৈরি হবে না।’

প্রধান লক্ষ্য নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার

ফখরুল বলেন, বর্তমান ‘ফ্যাসিবাদী’ শাসনব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে নির্দলীয় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য। যাতে দেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

তিনি বলেন,‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার  বহাল করলেই আমরা নির্বাচনে যাওয়ার কথা ভাবব। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে বর্তমান সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না। তাই আমাদের বর্তমান লক্ষ্য হচ্ছে সরকারকে পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করার জন্য অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে একত্রে আন্দোলন জোরদার করা।’

এসময় সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে বিএনপি নির্বাচনে যাবে বলে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের আন্দোলনকে দুর্বল করতে এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য এটা করছে। বিএনপি কোনোভাবেই বর্তমান সরকারের অধীনে কোনও নির্বাচনে অংশ নেবে না। নিশ্চিত করে এটা বলা যায়।’