বাংলাদেশে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে কর্মপরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে ইউএনবির সঙ্গে কথা বলেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী।
সচিবালয়ে ইউএনবিকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো-
ইউএনবি : মন্ত্রণালয়ে কোন কোন বিষয়কে চ্যালেঞ্জ মনে করছেন?
মন্ত্রী: পানি, বায়ু ও শব্দদূষণসহ পরিবেশ রক্ষায় মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়ই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করি। কারণ, পরিবেশ অধিদপ্তর শুধু মানদণ্ড নির্ধারণ করে থাকে। শব্দদূষণের ক্ষেত্রে কোন এলাকায় কি পরিমাণ? বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে কখন বিপজ্জনক অবস্থায় চলে যাচ্ছে! আমরা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে থাকি। কিন্তু এনফোর্সমেন্টের দায়িত্ব শুধু আমাদের নয়। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের। এটা একটা সমন্বয়ের বিষয়। এটা আমরা কীভাবে করব? জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে খাদ্য, পানিসম্পদ, বাণিজ্য, স্থানীয় সরকার ও শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সরকারের আরও অনেক দপ্তর জড়িত। সুতরাং এই এজেন্ডা শুধু পরিবেশের নয়, এটা পুরো সরকারের। সরকারকেই সেই দায়িত্বটা নিতে হবে। আমরা শুধু সমন্বয়ের দায়িত্বটা নিতে পারি।
আরও পড়ুন: ইটভাটার দূষণ শনাক্তে ‘ব্রিক ক্লিন ট্র্যাকার’ ব্যবহার করবে সরকার: পরিবেশমন্ত্রী
ইউএনবি: আপনার মন্ত্রণালয়ের প্রথম অগ্রাধিকার কী?
মন্ত্রী: প্রথমে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি যে বিষয় নিয়ে কাজ করব তার সক্ষমতা কতটুকু আছে। মন্ত্রণালয় ও এর অধীনে যে সব সংস্থা আছে, তাদের সক্ষমতা আছে কি না? আমাদের মন্ত্রণালয়ের নাম কিন্তু পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। জীববৈচিত্র্য একটা বড় বিষয়। সেটাতে ফোকাস দরকার, কিন্তু এটা মন্ত্রণালয়ে কাঠামোতেই নেই। সুতরাং মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতাও গুরুত্বপূর্ণ।
ইউএনবি : জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম। এ বিষয়ে আপনার কী পরিকল্পনা আছে?
মন্ত্রী: মন্ত্রণালয়ের তিনটি বিষয়ের মধ্যে একটা জলবায়ু পরিবর্তন। বিষয়টি বৈশ্বিক এবং এতে আমাদের কোনো হাত নেই। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আমরাই। সেখানে আমাদের কৌশল হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কতটুকু কমাতে পারি, মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি। কার্বন নিঃসরণে আমাদের নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও যে পরিমাণ অর্থ আমাদের পাওয়ার কথা তা পাচ্ছি না। উন্নত দেশ বা দাতাগোষ্ঠী অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে যে অঙ্গীকার করেছিল, তা রক্ষা করে না। তাদের দেওয়া সীমিত অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আমাদের যেসব কর্মপরিকল্পনা আছে তা স্বচ্ছতা ও সাশ্রয়ের সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে।
আরও পড়ুন: প্লাস্টিকমুক্ত দেশ গড়ার আহ্বান বিশেষজ্ঞদের
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ দায়ী না হলেও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়তে কাজ করব।
সত্যিকারের টেকসই উন্নয়ন পরিবেশের উন্নয়ন ছাড়া সম্ভব নয়। তাই পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশের নীতি ও আদর্শগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। নানাবিধ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সমস্যা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণকে বাসযোগ্য পরিবেশ ও উন্নত জীবন দিতে কাজ করব।
ইউএনবি: পরিবেশ রক্ষায় আপনার কী পরিকল্পনা আছে?
মন্ত্রী: পরিবেশে নানা ধরণের চ্যালেঞ্জে আছি। বায়ুদূষণে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ অকালে মারা যাচ্ছে। আমাদের জীবন থেকে বছরগুলো হারাচ্ছে ও উৎপাদনশীলতা নষ্ট হচ্ছে। এটা নতুনভাবে বলার কিছু নেই। সুতরাং আমরা যখন টেকসই উন্নয়নের কথা বলব, তখন পরিবেশের বিষয়টি একেবারে মূলধারায় চলে আসে। নদীদূষণ আরও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। পাহাড় কাটা হচ্ছে। সেখানে কীভাবে কার্যকর ব্যবস্থা নেব? সবাই বলছে এটা থামাতে হবে। কিন্তু কীভাবে? বিভিন্ন জায়গায় ইটিপি প্ল্যান্ট বসানো আছে। বাস্তবে আমরা দেখেছি, অনেক ক্ষেত্রে ইটিপি প্ল্যান্টগুলো চালু রাখা হয় না। পরিদর্শক যাবে ঠিক তার আগে চালু করা হয়। আর যদি প্ল্যান্ট বন্ধ অবস্থাও পাই তাতে যে জরিমানা আছে তা মোটেও যথেষ্ট নয়। এটা হালনাগাদ করতে হবে।
আরও পড়ুন: দ্রুত লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড পেতে পদক্ষেপ নেবে বাংলাদেশ: প্রধানমন্ত্রীর জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত
পরিবেশ ও বন এ দুটো বিষয় সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে। এটা নিয়ে আমরা অন্য কাউকে দোষারোপ করতে পারব না। এই দু’টি ক্ষেত্রে যদি কোনো দূষণ হয়ে থাকে এটার জন্য আমরাই সম্পূর্ণভাবে দায়ী। বন যে উজাড় হচ্ছে তা সারা বিশ্বের পরিসংখ্যানে বাংলাদেশেই বেশি। সুতরাং একটা হচ্ছে বনের সংরক্ষণ, আরেকটা হচ্ছে বেদখল বন পুনরুদ্ধার। আরেকটা হচ্ছে যদি সম্প্রসারণ করা যায়, সেটাও বড় বিষয়। বন শুধু গাছ না, এটার সঙ্গে জীববৈচিত্র্য রয়েছে। পুরো ইকো সিস্টেম সম্পৃক্ত (রিলেটেড)। উন্নয়নমূলক কাজ করার সময় অনেকে বলে ৫ হাজার গাছ কাটলে ৫০ হাজার গাছ লাগাবো। সেটা কিন্তু কখনোই এটার ক্ষতিপূরণ হতে পারে না। কারণ এটা শুধু গাছ না, এটার সঙ্গে জীববৈচিত্র্যও আছে।
ইউএনবি: জলবায়ু ফান্ড সঠিক ব্যবহার ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আপনার পরিকল্পনা কী?
মন্ত্রী: প্রাপ্ত বরাদ্দ যাতে প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের হাতে পৌঁছায়- তা নিশ্চিত করা হবে। আন্তর্জাতিক লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড থেকে দ্রুততম সময়ে বরাদ্দ আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে এবং জলবায়ু ফান্ডের অর্থ ব্যবহারে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করে এর সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।
ইউএনবি: বায়ুদূষণের জন্য অন্যতম দায়ী ইটভাটাগুলোর ব্যাপারে কী কী ব্যবস্থা নেবেন?
মন্ত্রী: জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ লক্ষ্যে বায়ুদূষণকারী ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হবে। বায়ুদূষণের জন্য দায়ী অন্যান্য বিষয়গুলো বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
পরিবেশ দূষণকারী ও অবৈধ ইটভাটা শনাক্তকরণ ও তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়তার জন্য ‘ব্রিক ক্লিন ট্র্যাকার’ ব্যবহার করা হবে। এর ফলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অত্যন্ত ক্ষতিকর ইটভাটা শনাক্ত করে অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করা সহজ হবে। ফলে ইটভাটার সৃষ্ট বায়ুদূষণ হ্রাস করা সম্ভব হবে।
আরও পড়ুন: কপ২৯ অনুষ্ঠিত হবে আজারবাইজানে
পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটর যৌথ উদ্যোগে আইটি ও রিমোর্ট সেন্সিং প্রযুক্তি নির্ভর ‘ব্রিক ক্লিন ট্র্যাকার’ তৈরি করা হয়েছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সহ সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এই ট্রাকারের সহায়তায় পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং এবং এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম জোরদার ও সফল হবে।
ইউএনবি : পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানে জনগণের ভোগান্তি কমাতে উদ্যোগ নেবেন কী?
মন্ত্রী: জনগণ যাতে সঠিকভাবে যথাসময়ে এ সংক্রান্ত সেবা পেতে পারে তার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে। জনগণের ভোগান্তি কমাতে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান পদ্ধতির সহজীকরণ করা হবে। ছাড়পত্র প্রদানে কোনও অনিয়ম সহ্য করা হবে না।
ইউএনবি: কী আছে ১০০ দিনের কর্মপরিকল্পনায়?
মন্ত্রী: ১০০ দিনের কর্মপরিকল্পনা আগামী সপ্তাহে ঘোষণা করা হবে। মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অগ্রাধিকারমূলক কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত করে ১০০ দিনের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। বিশেষ করে , বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ, প্লাস্টিক-পলিথিন দূষণ এবং পাহাড় কর্তন রোধে অংশীজনদের পরামর্শ গ্রহণ করে সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার এবং মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হবে।
টেকসই উন্নয়ন, বন দখল রোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা হবে। আন্তর্জাতিক অর্থছাড়ের চেষ্টা করা হবে। পরিবেশ, বন, জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়কে পারফরমেনন্সের দিক দিয়ে ১ নম্বরে নেওয়ার চেষ্টা করা হবে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে।
এছাড়াও, পরিবেশ দূষণ রোধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন তাই অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করব।
আরও পড়ুন: সাফারি পার্ক নির্মাণের ফলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে: পরিবেশমন্ত্রী