বেশ কয়েক বছর ধরে সম্পর্কের টানাপোড়েনের পর কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করার দিকে ঝুঁকছে বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রচার আরও ছড়িয়ে দিতে এই প্রচেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন দুই দলেরই শীর্ষ নেতারা।
তবে সম্ভাব্য সমালোচনা এড়াতে, ক্ষমতাসীন দলের নেতিবাচক প্রচার মোকাবিলা করতে, জোটের কিছু শরিক ও জামায়াত সম্পর্কে আপত্তি রয়েছে এমন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে তারা নিজেদের মধ্যে প্রয়োজনীয় দূরত্ব বজায় রাখবেন বলে জানিয়েছেন।
বেশ কিছুদিন ধরেই বিএনপি ও তার দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতের মধ্যে লক্ষণীয় দূরত্ব রয়েছে। বিশেষ করে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দিয়ে কিছু বামপন্থীসহ আরও অন্যান্য দলের সঙ্গে বিএনপি যুগপৎ আন্দোলন করার পর থেকে এ দূরত্বের সৃষ্টি।
তবে চলতি সপ্তাহে বিএনপির কয়েকজন নেতা বলেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে নতুন উদ্যমে রাজপথে নামতে ডান ও বাম উভয় পক্ষের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছেন তারা।
সম্প্রতি ইসলামী দল সম্পর্কে দলের অবস্থান স্পষ্ট করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যদিও তিনি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি সমর্থন করেন না, তবে তিনি জামায়াতের কৌশলগত পদ্ধতিকে কমিউনিস্ট পার্টির মতো অত্যন্ত পদ্ধতিগত বলে স্বীকার করেন।
মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, এতে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সঙ্গে বিএনপির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়েছে।
পরে কাদেরের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে জামায়াত বিবৃতি দিলেও জামায়াতের রাজনীতির প্রতি সমর্থনের অভাবের ইঙ্গিত দিয়ে ফখরুলের বক্তব্যের বিষয়ে নীরব থাকে।
এরপর গত ২৭ মে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উপহার হিসেবে আম, লিচুসহ মৌসুমি ফল পাঠায় জামায়াত।
১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় বিএনপি-জামায়াত একে অপরের কাছাকাছি এলেও ১৯৯৯ সালে তাদের আনুষ্ঠানিক জোট প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে রাজনৈতিক যাত্রায় একসঙ্গে রয়েছে এই দুই দল। চারদলীয় জোট থেকে শুরু করে ২০ দলীয় জোটে সম্প্রসারিত হয়ে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে এই জোট ভেঙে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা রাজনৈতিকভাবে জোটবদ্ধ ছিল।
আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশের কারণে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে বলে স্বীকার করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য ভারতের আস্থা ও সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যেই গত জাতীয় নির্বাচনের আগে তারা ইসলামপন্থী দল নিয়ে তৈরি জোট থেকে বেরিয়ে এসেছিল।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচনের আগে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছিলাম। এজন্য জামায়াত আমাদের যুগপৎ আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি। কিন্তু জামায়াত থেকে দূরে সরে গিয়ে আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি। তাই আমরা এখন বিশ্বাস করি, কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জনে সব ডানপন্থী ও বামপন্থী বিরোধী দলকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
বিএনপি অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক এড়াতে বর্তমানে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে জামায়াতের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি এবং আমরা আশা করি, সামনের দিনগুলোতে জামায়াত কৌশলে যুগপৎ আন্দোলনে শামিল হবে।’
বিএনপি রাজনৈতিক জটিলতার মধ্যে কৌশলগত স্বার্থের ভারসাম্য রেখে সতর্ক সম্পর্ক বজায় রাখছে বলে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য। তিনি বলেন, 'জামায়াতের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়তো বাড়বে, কিন্তু আগের মতো গভীর হবে না।
তবে তিনি বলেন, কিছু বিএনপি নেতা জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের পক্ষে কথা বলছেন। তারা মনে করেন, ইসলামপন্থী দলটি থেকে দূরত্ব বজায় রাখা একটি ত্রুটিপূর্ণ কৌশল, বিশেষত যখন সরকার বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আগ্রাসী ও দমনমূলক নীতি অনুসরণ করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই নেতা আরও বলেন, ‘জামায়াতের ব্যাপারে আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আপত্তিও রয়েছে।’
এদিকে ইউএনবির সঙ্গে আলাপকালে জামায়াতের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, তারা পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী, বিশেষত আওয়ামী লীগের ভারতপন্থী অবস্থানের কারণে সৃষ্ট বর্তমান রাজনৈতিক দৃশ্যপটে।
বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতের প্রতি বিভ্রান্তিকর অবস্থান প্রদর্শন করে আসছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা স্বাধীনভাবে যুগপৎ আন্দোলনের কিছু কর্মসূচি পালন করেছি। বিএনপির দিক থেকে অনীহা বুঝতে পেরে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছি।’
গত সাধারণ নির্বাচনে ভারতের কাছ থেকে সহানুভূতি আদায় করতে ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপি তাদের দলের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করেন এই জামায়াত নেতা।
তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তবে গভীর আস্থা গড়ে উঠেছে বলে আমি মনে করি না।’
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য বিএনপি ও জামায়াত উভয়েরই দাবি এক, যা তাদের সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করে।
তিনি আরও বলেন, ‘নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আওয়ামী লীগও মেনে নিলে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে কোনো সমস্যা দেখছি না।’
বিএনপি এই অভিন্ন উদ্দেশ্যর জন্যই বিভিন্ন বাম ও ডানপন্থী দলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে বলে উল্লেখ করেন শামসুজ্জামান দুদু।
বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলছে কি না জানতে চাইলে তিনি ১৯৯৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আওয়ামী লীগের আন্দোলনে ইসলামপন্থী দলটির সমর্থনের কথা উল্লেখ করে এর সঙ্গে বিএনপির বর্তমান সম্পর্কের তুলনা করেন।
তিনি বলেন, ‘সেই আন্দোলনের সময় জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যে সম্পর্ক ছিল, জামায়াতের সঙ্গে এখন বিএনপিরও সেই সম্পর্ক। আওয়ামী লীগের মধ্যে যদি কৌশলগত সম্পর্ক থাকত, তাহলে জামায়াতের সঙ্গে এখন আমাদেরও কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে।’
২০ দলীয় জোট ভেঙে যাওয়ার পর থেকে জামায়াতে ইসলামী আর বিএনপির সঙ্গে জোটে নেই উল্লেখ করে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আমাদের সৌজন্যমূলক সম্পর্ক রয়েছে। অন্যান্য বিরোধী দলের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক রয়েছে।’
তিনি বলেন, তারা সব গণতান্ত্রিক বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান, যাদের বর্তমান সরকারকে অপসারণ, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, জনগণের হারানো ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্য রয়েছে।
রাজনৈতিক বিষয় ও কর্মসূচি নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে পরওয়ার বলেন, বিএনপির সঙ্গে তাদের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা ও যোগাযোগ রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, 'বিএনপি নেতাদের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে কথা বলি।'
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী ভবিষ্যতে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যাবে কি না- তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক ঘটনা ও মাঠপর্যায়ে রাজনীতির দাবির ওপর।