প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদে ভরপুর তাহিরপুরের অধিকাংশ ব্যবসায়ী কয়লা ও পাথর ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। উপজেলার অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি বালু-পাথর আর কয়লা। উপজেলার সীমান্ত নদী পাটলাইয়ে নাব্যতা সংকটে তৈরি হয়েছে নৌজট। বর্ষায় ভারতের পাহাড় থেকে আসা পলিতে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পণ্য পরিবহনে এই সহজ নদীপথে প্রতিবছর আটকা পড়ে শত শত পাথর ও কয়লাবাহী নৌযান। নদীর মাঝে আটকে খাবার-দাবার ছাড়াই অসহায়, নিরাপত্তাহীনতা দিন কাটাতে হয় নৌ শ্রমিকদের।
বিগত কয়েক বছর ধরে নদীতে নৌজট লেগে দুর্ভোগে পড়ছেন মানুষ। প্রত্যেক বছরই ভেকু দিয়ে নদী খনন করে সাময়িক নৌজট ছাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু, ভেকু দিয়ে খনন কাজের সময় মাটি নদীর পাড়ে রাখতে হয়। ফলে বর্ষা মৌসুমে পাড়ে রাখা মাটিগুলো আবার নদীতে পড়ে তলদেশ ভরাট করে ফেলে। এর স্থায়ী সমাধান কেন হচ্ছে না— এর কারণ খুঁজতে গিয়ে সামনে আসে নানা অভিযোগ।
অভিযোগ আছে, একটি সিন্ডিকেট ইচ্ছাকৃতভাবে নদীতে মাটি, বালুর বস্তা ফেলে নৌজট লাগিয়ে রাখছে। নৌজটের স্থায়ী সমাধানের জন্য ক্যাপিটাল ড্রেজিং করার উদ্যোগ নিলে সেটাও আটকে দেয় অভিযুক্তরা। অভিযুক্ত হিসেবে সামনে আসছে সাবেক ও বর্তমান দুই সহোদর মেম্বারের নাম। আর তাদের পেছনে কলকাটি নেড়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারাও। অভিযুক্ত স্থানীয়রা ড্রেজিংয়ে বাধা দিলে উপজেলা প্রশাসনের সহায়তা চেয়েও সহায়তা পায়নি বিআইডব্লিউটিএ।
বিআইডব্লিউটিএ সুনামগঞ্জের সদ্য বিদায়ী সহকারী পরিচালক সুব্রত সাহা বলেন, নৌজট থেকে মুক্তি পেতে গত বছর সুলেমানপুর এলাকায় পাটলাই নদীতে আড়াই কিলোমিটার এলাকা ড্রেজারের মাধ্যমে খনন করার উদ্যোগ নেই আমরা। এতে বাধা দেয় সিরাজ ও এমদাদ মেম্বার নামের দুইজন। লোকজন দিয়ে মানববন্ধনও করায়। সুলেমানপুরের পিছনে খেয়াঘাটের কাছে ড্রেজার নিয়ে আসলে, বাঁশের সেতুর কারণে ড্রেজার ঢুকতে পারেনি। খুলে দেওয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুপ্রভাত চাকমাকে জানালেও তিনি কোনো সহযোগিতা করেননি। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে খনন করলে মাটি দূরে নিয়ে কোথাও ফেলা যেত। এতে আর মাটি নদীতে ফিরে আসতো না।
আরও পড়ুন: সুনামগঞ্জের মধ্যনগরে পেঁয়াজের চাষ বেড়ে দ্বিগুণ
তিনি আরও বলেন, এখানে জট লেগে থাকলে স্থানীয় কিছু মানুষের সুবিধা হয়। পণ্যবাহী নৌযান থেকে চাঁদাবাজি করা যায়। জট খুলে দেওয়ার নামে তারা প্রতি নৌকা থেকে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা নেন। এজন্য নদীর কিছু জায়গায় ইচ্ছাকৃতভাবে বালুর বস্তা, মাটি ফেলে ভরাট করা হয় নৌজট লাগার জন্য।
এই দুর্ভোগ নিরসনে কারোরই সহায়তা পাওয়া যায় না। সহায়তা করলে আমরা সুনামগঞ্জের নদীপথে আরও অনেক কিছু করতে পারতাম। অসহযোগিতার কারণে মনোবল নষ্ট হয়ে যায়। তবে অভিযুক্ত দুই সহোদর সাবেক মেম্বার সিরাজ ও বর্তমান মেম্বার এমদাদ ড্রেজিংয়ে বাধা দেওয়ার কথা স্বীকার করেন।
চাঁদাবাজির বিষয়টি মিথ্যা বলে দাবি করে তারা বলেন, এটি কোন নদী নয়। এটি একটি খাল। এখানে ড্রেজিং করে নদী খনন করলে আমাদের হাওর নষ্ট হবে। ফসল রক্ষা বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাই আমরা বাঁধা দিয়েছি। আমরা যখন বাঁধা দেই তখন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অমল কর, স্থানীয় যুবলীগ নেতা হাবিবুর রহমানও সঙ্গে ছিলেন। পলাতক থাকায় আওয়ামী লীগের এই দুই নেতার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে তৎকালীন তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুপ্রভাত চাকমাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, পাটলাই নদীতে প্রত্যেক বছর নৌজট লাগার কারণে ড্রেজিং করে খননের উদ্যোগ নিয়েছিল বিআইডব্লিউটিএ। পরে স্থানীয়দের বাঁধায় আর সেই কাজ করা যায়নি।
বিআইডব্লিউটিএএর সিলেট অঞ্চলের উপপরিচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, পাটলাই নদীতে নৌজট লাগায় আমরা লংভুম ভেকু দিয়ে খনন করে নৌযান চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি। পর্যায়ক্রমে সুনামগঞ্জের সকল নদীপথে যেখানে চলাচলে বিঘ্ন হবে আমরা সেখানে খনন করব।
আরও পড়ুন: মৃত্যুফাঁদের মহাসড়ক আর কতকাল?