বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত বেশ কয়েকজন নার্সের সাথে কথা বলে জানা যায়,তারা করোনা আক্রান্ত রোগীদের সংস্পর্শে থেকে কাজ করার সময় আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। এটি কেবল তাদের নিজেদের সুরক্ষার বিষয় নয়। বরং মারাত্মক ছোঁয়াচে ভাইরাসটি সহজেই তাদের আক্রমণ করতে পারে এবং অন্যান্য রোগী বা তাদের পরিবারের সদস্যরাও এতে আক্রান্ত করতে পারে।
কোভিড-১৯-পজিটিভ আসা রোগীদের সংখ্যা গত কয়েক দিনে নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় নার্সদের উদ্বেগ আরও বেড়েছে, কারণ তাদেরকেই এসব রোগীর দেখাশোনা করতে হবে।
সম্প্রতি সরকারি হাসপাতালে কর্মরত সিনিয়র স্টাফ নার্স আসমা আক্তার তাদের পেশার মানুষের দুর্দশার কথা জানিয়ে ফেসবুকে শেয়ার করলে পোস্টটি ভাইরাল হয়ে যায়।
ইউএনবি প্রতিবেদক তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন,করোনা মহামারি এই সময়ে আমরা নার্সরা অসহায় পরিস্থিতিতে পড়েছি, কারণ কেউ আমাদের সুরক্ষা নিয়ে ভাবছে না।
তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের দেশে বর্তমানে রেজিস্টার্ড নার্সের সংখ্যা ৪১ হাজার ৬০০। দেশের জনসংখ্যা ও নার্সের অনুপাত ৩৮৩৯:১। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড অনুসারে, প্রতি ১ হাজার রোগীর জন্য নার্স দরকার ২ জন। সেই হিসেবে বাংলাদেশে নার্স দরকার ৩ লাখ ২০ হাজার। চাহিদা অনুযায়ী, দেশে এখনও ২ লাখ ৭৮ হাজার ৪০০ নার্সের স্বল্পতা রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন,‘করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করার আগে আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত। কারণ আমরা নিরাপদ ও সুস্থ থাকলেও সঠিক সেবা দিতে পারবো।’
আসমা উল্লেখ করেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে টাকার লোভ দেখানো হচ্ছে, অপমান করা হচ্ছে। যা তাদেরকে এই সংকটকালীন সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের সেবাদানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’
এই দুঃসময়ে পেশা, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে একত্রিত হয়ে লড়াই করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি পেশা কিংবা স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে পরস্পরের সাথে দূরত্ব তৈরি করি, পরস্পরকে অবিশ্বাস করি তাহলে কিন্তু করোনার বিরুদ্ধে জয়ী হওয়া কঠিন হবে।’
‘আমাদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিন, দরকার হলে দেশের এই দুঃসময়ে আমরা বিনা বেতনেও চিকিৎসা সেবা দিতে রাজি আছি। তবুও আমাদেরকে কেউ লোভ দেখাবেন না, অপমান করবেন না প্লিজ,’ বলেন তিনি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স সুচন্দা হালদার বলেন, ‘করোনার এই সময়ে নার্সিংপেশাটা সত্যিই খুব চ্যালেঞ্জিং। কারণ নিজের জন্য না হলেও আমাদের সবারই পরিবার আছে। একদিকে রোগীদের প্রাণ,অন্যদিকে আমাদের পরিবার। আমরা আমাদের পেশাগত দায়িত্ব এড়াতে পারি না। আবার আমাদের বাবা-মা বা পরিবারের অন্য সদস্যদেরও মৃত্যুর কারণ হতে চাই না।’
‘আমাদেরকে আমাদের পরিবার থেকে বলছে যে প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে দাও। কিন্তু আমরা সেটা পারছি না, কারণ তাহলে দেশ ও দেশের মানুষের সাথে বেঈমানি করা হবে। নিজের পেশার সাথেও। কারণ মানুষের সেবায় আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ,’ উল্লেখ করেন তিনি।
রেজিস্টার্ড নার্সদের সংগঠন বাংলাদেশ রেজিস্টার্ড নার্স ঐক্য পরিষদের সদস্যরা জানান, রোগীদের কাছাকাছি বেশিরভাগ সময় থাকলেও তাদের পিপিই দেয়া হচ্ছে না। যারা করোনা ইউনিটে ডিউটি করে তাদের থাকার ব্যবস্থা নেই।
হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থাসহ শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান তারা। কারণ ডিউটি শেষে বাসায় গেলে তাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত অন্তত তিনজন নার্স করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন।
বেটার লাইফ হাসপাতালের সিনিয়র নার্স জহুরা চৌধুরী বলেন, ‘একজন রোগী যদি হাসপাতালে ভর্তি থাকেন, তা হোক ওয়ার্ড অথবা আইসিইউ, ২৪ ঘণ্টার তার সেবার জন্য একজন নার্স নিযুক্ত থাকেন। সেখানে কিন্তু ডাক্তার খুঁজে পাবে না, যদিও তারা মাঝে মাঝে দেখেন। কিন্তু একজন রোগীর সব দেখভাল একজন নার্সই করে থাকেন।’
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে প্রশ্ন করেন, ‘তাহলে আজ এই করোনা মহামারির সময়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে জনসাধারণ কেনই বা ডাক্তারদেরকেই শুধু হাইলাইট করছেন? আজ কেন নার্সদের পিপিই নেই? সবকিছু থেকে কেন তারাই শুধু অসহায়? নিজের জীবন বাজি রেখে মানুষের পাশে থাকাই কি আমাদের অপরাধ?’
‘আমরা লাখ লাখ টাকা চাই না, এই মুহূর্তে আমাদের শুধুমাত্র একটু সম্মান দিন। আমরা নার্সরা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে রাজি,’ উল্লেখ করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসে বিশ্বের ৫২টি দেশ ও অঞ্চলে ২২ হাজারেরও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন বলে শনিবার জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
নিয়মিত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানায়, বুধবার পর্যন্ত তাদের কাছে যে রিপোর্ট এসেছে সেই অনুযায়ী বিশ্বে ২২ হাজার ৭৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আক্রান্তের যে সংখ্যা বলা হচ্ছে সেটি কম হতে পারে। কেননা এখনও ডব্লিউএইচও-তে সরাসরি স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্তের তথ্য জানানোর কোনো পদ্ধতি নেই।
প্রাথমিক ফলাফলগুলো দেখাচ্ছে যে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা কর্মক্ষেত্রে এবং কমিউনিটি উভয় জায়গাতেই সংক্রমিত হচ্ছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংক্রমিত পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে আক্রান্ত হচ্ছেন।
সামনের সারির স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের রক্ষার জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম যেমন মাস্ক, চশমা, গ্লাভস এবং গাউনের সঠিক ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছে ডব্লিউএইচও।