আবরারকে রবিবার রাত ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই-বাংলা হলের সিঁড়ি থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সোমবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানায়, ছোটবেলা থেকেই আবরার ছিল অদম্য মেধাবী। ক্লাসে প্রথম ছাড়া কখনও সে দ্বিতীয় হয়নি। ২০১৫ সালে কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় সব বিষয়ে এ প্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। মেধার স্বীকৃতি হিসেবে অষ্টম ও দশম শ্রেণিতেও বিশেষ বৃত্তি পেয়েছিল আবরার।
পরে এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয় ঢাকার নটর ডেম কলেজে। সেখান থেকে ২০১৭ সালে এইচএসসি পরীক্ষাতেও সব বিষয়ে এ প্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। পরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ইলেকট্রিকাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়। সেখানে শেরেবাংলা হলের ১০১১ নং কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিল সে।
মেধাবী এই শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছিল আবরার। চান্স পেয়েছিল ঢাকা মেডিকেলে কলেজেও। পরিবারের সদস্যরা চেয়েছিল আবরার মেডিকেলে ভর্তি হোক। কিন্তু মেডিকেলে ভর্তি না হয়ে প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর আবরার নিজ পছন্দেই বুয়েটে ভর্তি হয়।
তার চাচা মিজানুর রহমান বলেন, ‘আবরার ফাহাদ শিবিরের কর্মী বলে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এটা বানোয়াট, আবরার একজন উদারমনা ও প্রগতিশীল ছেলে। আমাদের পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের সমর্থক। হানিফ সাহেবের সব অনুষ্ঠানে আমরা অংশ নেই। তবে আবরার এমনিতে মাঝেমধ্যে তাবলিগে যেত। বুয়েটে ভর্তির পরও দুই তিনবার সে তাবলিগে গিয়েছিল। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং পবিত্র কোরআন শরীফ পড়ত।’
ছেলের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে মা রোকেয়া খাতুন বলেন, রবিবার সকালে আমি তাকে নিজে ঘুম থেকে ডেকে তুলি। এরপর সে ঢাকায় রওনা দেয়। মাঝে তিন থেকে চারবার ছেলের সঙ্গে মুঠোফোনে আমার কথা হয়। বিকাল পাঁচটায় হলে পৌঁছে ছেলে আমাকে ফোন দেয়। এরপর আর কথা হয়নি। রাতে অনেকবার ফোন দিয়েছিলাম, ও আর ফোন ধরেনি।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন শোকে বিহ্বল আবরার ফাহাদের মা রোকেয়া খাতুন।
মঙ্গলবার সকালে নিজ গ্রাম কুমারখালীর রায়ডাঙ্গা কবরস্থানে ছেলেকে সমাহিত করে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ আবারও সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, তার ছেলেকে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। যে ছেলেটা বিকেল ৫টায় ঢাকায় পৌঁছাল, তাকে ৮টার দিকে নির্যাতন করার জন্য ডেকে নিয়ে গেল। ছয় ঘণ্টা ধরে নির্যাতন চালাল, এটা অবশ্যই পরিকল্পিত।’
এদিকে এই হত্যাকাণ্ডে ক্ষমতাসীন দলের বড় কোনো নেতার নির্দেশ থাকতে পারে দাবি করে আবরার চাচা মিজানুর রহমান বলেন, ‘এ ঘটনায় কোনো নেতার ইন্ধন রয়েছে। কেননা দু-একজন নয়, সেখানে ১৫ জনেরও বেশি ছেলে আবরার হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে। পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া এতোজন কাউকে মারতে পারে না।’
আবরারের ছোটভাই আবরার ফাইয়াজ বলেন, ‘সোমবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ভাইয়ার এক বন্ধু বুয়েট থেকে প্রথমে খবর দিয়ে বলেন, সে মারাত্মক অসুস্থ। কিছুক্ষণ পর আবার খবর পেলাম ভাইয়া মারা গেছে। মারা যাওয়ার খবরে পুরো পরিবারের অবস্থা কী হতে পারে?’
সে জানায়, ‘ভাইয়ার সেমিস্টার পরীক্ষার কারণে বাসায় ছুটি না কাটিয়ে হলে পড়াশোনার উদ্দেশে রবিবার সকাল সাড়ে ৯টায় কুষ্টিয়া থেকে বাসে ঢাকায় রওনা দেয়। বিকাল ৫টায় পৌঁছানোর পর সে মোবাইলে জানায়। এরপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি আমার সঙ্গে।’
ভাইয়ার মোবাইলে একাধিকবার রিং দিলেও সে ধরেনি। পরে ভাইয়ার মেসেঞ্জার অন থাকলেও সেখানে রিং হলেও ভাইয়া ধরেনি। ফলে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি।
ছোট ভাই বলেন, ‘ফোন না ধরায় আমি ফেসবুকের মেসেঞ্জারে ভাইয়াকে নক করি। ভাইয়া সে সময়ও ফেসবুকে অ্যাকটিভ ছিল, তবে সাড়া দেয়নি।’