ভুক্তভোগী কিছু মানুষ ইউএনবিকে তাদের দুর্দশার কথা উল্লেখ করে বলেন, অসুস্থ ব্যক্তি এবং তাদের উদ্বিগ্ন স্বজনরা চিকিৎসা পরিষেবা পেতে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে চলেছেন এবং করোনার এ সংকটের সময়ে অন্য গুরুতর রোগীরা কীভাবে চিকিৎসা পাবেন বা রোগ নির্ণয় করাবেন সে বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা না থাকায় অনেক রোগী চিকিৎসা পাওয়ার আগেই মারা যাচ্ছেন।
তারা বলেন, ‘অব্যবস্থাপনা’, চিকিৎসকদের অতিরিক্ত নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত সুরক্ষার প্রতি ঝোঁক, ভাইরাস সংক্রমণের ভয় এবং জনবলের অভাবে বহু সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালই অন্য রোগীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
এমনকি, গুরুতর রোগী যারা কোভিড-১৯ আক্রান্ত নন তাদেরও স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য মনোনীত হাসপাতালগুলোতে স্থানান্তর করে ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নন এমন রোগীরা নিয়মিত চেকআপ এবং চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কারণ অনেক সিনিয়র চিকিৎসক ভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে রোগীদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), কুর্মিটোলা এবং মুগদা জেনারেল হাসপাতালের মতো বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো করোনার পরীক্ষা এবং এ জাতীয় রোগীদের চিকিৎসার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে উঠেছে যে করোনা চিকিৎসার জন্য মনোনীত নয় এমন এক ডজন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে শনিবার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে কিডনিজনিত সমস্যায় মারা গেছেন অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকার।
গৌতমের আইচের মেয়ে সুস্মিতা আইচ, যিনি নিজেও একজন চিকিৎসক এবং চিকিৎসা পরামর্শের জন্য সরকারের ৩৩৩ হেল্পলাইনে কাজ করেন, তিনি বলেন, তিনি তার বাবাকে বিএসএমএমইউ, ডিএমসিএইচ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, ইউনাইটেড, স্কয়ার, ল্যাবএইড, ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ এবং আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ সব বড় বড় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তারা বিভিন্ন অজুহাতে ভর্তি নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
সুস্মিতা বলেন, ‘আমার বাবার খুব জরুরি ভিত্তিতে আইসিইউ সহায়তা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু আমরা তাকে সেই সেবা সরবরাহ করতে পারিনি। চিকিৎসার অভাবে তিনি মারা যান। চিকিৎসক হওয়া সত্ত্বেও আমি তার জন্য কিছুই করতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘আমার বাবা করোনা আক্রান্ত কি না সেটির জন্য সব হাসপাতাল থেকেই তার করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট দেখতে চেয়েছিল। একজন চিকিৎসক হয়েও আমি যখন নিজের বাবার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছি, তখন আপনি অনুমান করতে পারেন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য অ-করোনা রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া কতটা কঠিন।’
নগরীর বাসাবো এলাকার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আলমাস উদ্দিনের মেয়েও প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতার কথা জানান। তার বাবা মার্চ মাসের শেষের দিকে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন।
তিনি তার বাবাকে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী, পপুলার মেডিকেল কলেজ এবং দুটি কোভিড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা জানান।
এরপর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার আন্তরিক প্রচেষ্টার পর আলমাস উদ্দিনকে মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও যথাযথ চিকিৎসার অভাবে কয়েক ঘণ্টা পরই তিনি মারা যান।
মুক্তিযোদ্ধা আলমাস উদ্দিনের মেয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমার বাবা যে কষ্ট ভোগ করেছেন তা আমি ভুলব না। হাসপাতালগুলো ভর্তি নিতে অস্বীকৃতি জানানোয় তাকে দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্সে রাখতে হয়েছিল। আমি চাই না যে আর কেউ এ ধরনের দুর্ভোগের মুখোমুখি হোক এবং চিকিৎসার অভাবে মারা যাক।’
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার কাশীপুর গ্রামের ৭০ বছর বয়সী ওষুধের দোকানদার আমান উল্লাহ সম্প্রতি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
আমান উল্লাহর মেয়ে শর্মি মাহমুদ ইউএনবিকে বলেন, ‘আমরা বাবাকে নারায়ণগঞ্জ শহরের একজন চিকিৎসকের চেম্বারে নিয়ে গিয়েছিলাম এবং কিছু রোগ নির্ণয়ের পরে তার ফুসফুসের সংক্রমণ ধরা পড়ে।’
তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাবাকে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল এবং কয়েকটি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হলেও করোনাভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়।’
স্বামীর দেখাশোনার জন্য তার মাকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হয় উল্লেখ করে শর্মি আরও বলেন, ‘একজন সাংবাদিকের সহায়তায় আমরা তাকে রাজধানীর মহাখালীর আইইডিসিআরে নিয়ে যাই। সেখান থেকে তাকে করোনা রোগী সন্দেহে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।’
তবে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসায় তিন দিন পর আমান উল্লাহকে বারডেম হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
তার মেয়ে শর্মি আরও বলেন, ‘আমার মায়ের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল। এখন দুজনই সুস্থ আছেন এবং হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। তবে তাদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে আমাদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।’
যোগাযোগ করা হলে ঢামেকের অধ্যক্ষ অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ বিষয়টি স্বীকার করেন যে কোভিড-১৯ রোগীদের চাপের কারণে করোনা আক্রান্ত নন এমন অনেক রোগীর স্বাস্থ্যসেবা পেতে অসুবিধা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমরা একটি করোনা ইউনিট স্থাপন করেছি, তাই আমরা আগে যেসব পরিষেবা সরবরাহ করতাম এখন সাবধানতা, জনবলের ঘাটতি এবং অন্যান্য কিছুর কারণে তা দিতে পারছি না। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত আমরা অ-করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য অন্যান্য হাসপাতালে যেতে অনুরোধ করছি।’
বিএসএমএমইউর কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, এটাই স্বাভাবিক যে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক ও নার্স করোনা আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি করোনা রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতালগুলো চরম চাপের মধ্যে থাকায় অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে অনেক হাসপাতাল ও চিকিৎসক অন্য রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবা দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। আমরা দেখেছি, উপসর্গহীন অনেক রোগীর ভর্তির পর পরীক্ষা করে তাদের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ জন্য হাসপাতাল ও চিকিৎসকরা এখন করোনা পরীক্ষার ফলাফল ছাড়া কোনো রোগী নিতে দ্বিধা বোধ করছেন।’
আতিকুর জানান, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে অনেক রোগীও হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসছেন না। কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাসপাতালগুলোতে কিডনি, ফুসফুসসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেয়েছে।
করোনা ব্যতীত অন্য রোগীদের টেলিফেনের মাধ্যমে চিকিৎসা পরিষেবা গ্রহণ এবং চিকিৎসকদের সাথে যোগাযাগের পরামর্শ দেন তিনি।
ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের (ডিসিএমসিএইচ) মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হারুন-অর-রশিদ বলেন, কোভিড-১৯ আক্রান্ত নন এমন রোগীদের কীভাবে চিকিৎসা বা রোগ নির্ণয় করা যায় সে সম্পর্কে হাসপাতালগুলোর একটি পরিকল্পনা থাকা উচিত।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এটি সব হাসপাতালের জন্য একটি সাধারণ নীতি হওয়া উচিত যে তারা কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দেবে না। চরমভাবে চাপে না পড়া পর্যন্ত তারা সব রোগীকে চিকিৎসা দেবেন। করোনায় আক্রান্তদের বাঁচানোর জন্য আমরা অন্য রোগীদের মরতে দিতে পারি না।’
ডা. হারুন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং মানসম্পন্ন পিপিই না পাওয়ায় চিকিৎসকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। চিকিৎসকদের উৎসাহ দেয়ার জন্য তাদের এসব সমস্যার সমাধান করা উচিত, যাতে তারা সব রোগীকে চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান করতে পারেন।’