জীবনের সব অর্জন তাকে ছেড়ে গেলেও, ছাড়েনি শুধু দীর্ঘশ্বাস। দিনের পর দিন আরও আরও দীর্ঘ হয়েছে সদা হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল তাহেরা পারভীনের নিশ্বাস।
সাঁতারু হিসেবে লড়ে অর্জন করেছেন ৩৩টি পদক। কিন্তু জীবনযুদ্ধে অকেটাই হেরে গেছেন খুলনার সাবেক অ্যাথলেট তাহেরা পারভীন।
একদিন পানি চিরে তীর বেগে ছুটে চলা তাহেরা এখন বন্দি দেয়ালঘেরা জীবনে। দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ভাঙা পা নিয়ে গতিহীন জীবন কাটছে তার। বিছানায় বসে পদকের সঙ্গে হিসাব মেলানোর চেষ্টা করেন জীবনের। মেলে না কোনো হিসাবই, নিজের অজান্তেই বেরিয়ে যায় দীর্ঘশ্বাস।
আনমনে বসে থাকতে থাকতেই চোখ চলে যায় ছাদের কড়িকাঠে। বর্তমানের বিশ্বাসঘাতকতায় ফিরে যান স্মৃতির অতলে। ভাবেন আবার যদি ফিরে যেতে পারতেন পুরোনো জীবনে!
অ্যাথলেট হিসেবে একের পর এক আঞ্চলিক, বিভাগীয়, জাতীয়, এমনকি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন তাহেরা। লাভ করেছেন সাঁতারে ১৫ স্বর্ণপদক, হার্ডেলে ৯টি রৌপ্য ও ৯টি ব্রোঞ্জ পদক। কিন্তু জীবনের দুঃসময়ে এসবের কোনোটাই কাজে আসছে না।
দুর্ঘটনায় পা ভেঙে এক মাস ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাবা-মা কেউ জীবিত নেই। বড় ভাই মোল্লা জাহাঙ্গীর কবির বাবুলের করুণায় কোনোরকম দিনাতিপাত করছেন।
খুলনার রুপসা উপজেলার দুর্জনীমহল গ্রামের মোল্লা গোলাম রসুলের ছোট মেয়ে তাহেরা পারভীন।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও খুলনা সদর হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে এক আত্মীয়ের সহায়তায় ১৯ জুন ভর্তি হন নগরীর শের-ই বাংলা রোডের খুলনা সেন্ট্রাল হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক নামে একটি বেসরকারি হাসপাতালে। ওই হাসপাতালের চিকিৎসক গৌতম মুখার্জির তত্ত্বাবধানে তিনি চিকিৎসাধীন।
শনিবার (২২ জুন) দুপুরে হাসপাতালের চতুর্থ তলায় ৪০৩ নম্বর কেবিনে তিনি তার দুর্বিষহ জীবনের বর্ণনা দেন এ প্রতিবেদকের কাছে।
তাহেরা পারভীন বলেন, ‘অ্যাথলেট হিসেবে সাঁতার আর হার্ডেল ছিল আমার ইভেন্ট। এই দুই ইভেন্ট আমাকে ১৫টি স্বর্ণসহ ৩৩টি পদক দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বাবা-মা বিয়ে দিতে চেয়েছেন, কিন্তু একের পর এক ইভেন্টের জন্য আমি বিয়ে করতে পারিনি। আজ সংসারহীন অবস্থায় আমাকে দেখাশোনারও কেউ নেই। অসহায় অবস্থায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি।’
তিনি জানান, ভাইয়ের অল্পবিস্তর সহায়তায় জীবনযাপন করছেন। কিন্তু তার ভাইও খুব সামর্থ্যবান নন। তার পক্ষে সংসার সামলে তাহেরার চিকিৎসা করা সম্ভব নয়।
এ অ্যাথলেট বলেন, ‘এ পর্যন্ত আমি কোনো সাহায্য পাইনি। বিজেএসমিসহ আমি যাদের হয়ে খেলেছি তারা কোনো সহায়তা দেয়নি। আমি শুধু খেলেই গেছি। বিজেএমসির অ্যাথলেট হিসেবে আঞ্চলিক, বিভাগীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুইমিংয়ে অংশ নিয়েছি। স্বর্ণপদক পেয়েছি। সুনাম হয়েছে তাদের। খেলা শেষে আমাকে শুধু ৫০০-৬০০ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। তারা কোনো চাকরির ব্যবস্থা কিংবা আর্থিক সহায়তা করেনি।’
ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম বাংলাদেশ অলিম্পিক গেমসে সাঁতারে প্রথম হওয়ায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে স্বর্ণপদক গ্রহণ করেন। ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ে, ঢাকা পুলিশ লাইনে, বিভাগীয় পর্যায়ে খুলনায়, চট্টগ্রামে বিজেএমসি ও খালিশপুর ক্রিসেন্ট জুট মিলে সাঁতার প্রতিযোগিতাসহ কয়েকটি ইভেন্টে ১৫টি স্বর্ণ পদক পান।
এছাড়া ভারত ও নেপালে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় রৌপ্য ও ব্রোঞ্চ পদক পান।
অ্যাথলেট তাহেরা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আকুল আবেদন, তিনি যদি আমাকে একটু সহযোগিতা করতেন, তাহলে বেঁচে থাকতে পারতাম।’
তাহেরার বড় ভাই মোল্লা জাহাঙ্গীর কবির বাবুল বলেন, ‘আমার বোন সারা জীবন খেলাধুলা করেছে। এখন দুর্ঘটনায় পা ভেঙে হাসপাতালে পড়ে আছে। দেখার কেউ নেই। আমার সামান্য রোজগার। চিকিৎসার এত খরচ কোথায় পাব?’
তিনি বলেন, ‘ক্রীড়া জগতে আমার বোনের অনেক অবদান। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, উনি যেন আমার বোনের প্রতি একটু সদয় হন।’
বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) এজিএম পারভীন সুলতানা বলেন, তাহেরা খাতুন ভালো অ্যাথলেট ছিলেন। জাতীয় পর্যায়ে বেশ কয়েকটি পদক পেয়েছেন। বিজেএমসির প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তবে তিনি আমাদের চাকরিজীবী ছিলেন না। তিনি আমাদের হয়ে অংশ গ্রহণ করে নগদ সহযোগিতা পেতেন। তারপরও তার কথা আমরা বিবেচনায় নিয়েছি।
খুলনা বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক কাজী শামিম বলেন, তাহেরা খুলনার হয়ে সাঁতারে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। স্বর্ণ ও রৌপ্য পদক বিজয়ী হয়েছেন। তার বর্তমান অবস্থার কথা আমার জানা ছিল না। তার জন্য কিছু একটা করা দরকার।