ইতোমধ্যে ৩০ শতাংশ খনন কাজও শেষ হয়েছে। তবে নদী খনন প্রক্রিয়ায় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের বহুতল ভবন। কারণ চুয়াডাঙ্গা- ঝিনাইদহ সড়কের নুরনগর গ্রামে নবগঙ্গা নদীর মধ্যস্থলে দুই একর জায়গায় গড়ে উঠেছে সরকারি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের বিভিন্ন ভবন। এমন বাস্তবতায় নদী খনন প্রক্রিয়া থমকে গেছে।
গোটা বিষয়টি অবহিত করে চুয়াডাঙ্গা পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহেদুল ইসলাম ইউএনবিকে জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলেই যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের বহুতল ভবনসমূহ ভাঙার কার্যক্রম শুরু হবে।
এদিকে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ভবন নির্মাণ নিয়ে পাওয়া গেছে চমকপ্রদ তথ্য। নবগঙ্গার বুক চিরে গড়ে ওঠা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের দুই একর সরকারি জায়গাও কিনতে হয়েছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরকেই। এজন্য স্থানীয় দখলকারীদেরকে দিতে হয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা জেলাতে মোট ৫টি নদী রয়েছে। নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, নবগঙ্গা, চিত্রা ও কুমার। মূলত পদ্মার শাখা নদী মাথাভাঙ্গা। জেলার বাকি চারটি নদীর উৎস মাথাভাঙ্গা।
স্থানীয়রা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে দখল দূষণে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে মাথাভাঙ্গা। কারণ এক সময়ের খরস্রোতা মাথাভাঙ্গা নদী এখন খালে পরিণত হয়েছে। আর বাকি চারটি নদী মানচিত্রে থাকলেও বাস্তবে খুঁজে পাওয়া কঠিন। এমন বাস্তবতায় জেলাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার নদীগুলো খননে উদ্যোগ গ্রহণ করে।
চুয়াডাঙ্গা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা জেলাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে চুয়াডাঙ্গার নদীগুলো খনন করার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ মেলে ৩৭ কোটি টাকা। প্রাথমিকভাবে চুয়াডাঙ্গার নবগঙ্গা নদী খনন প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। জেলার মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে খনন নির্ধারণ করা হবে ১৪ কিলোমিটার। এর ব্যয় ধরা হয় সাড়ে ৭ কোটি টাকা। গত মাসের ১৪ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় নবগঙ্গা নদী খননের।
চুয়াডাঙ্গা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহেদুল ইসলাম জানান, চুয়াডাঙ্গা শহরের ইসলামপাড়া শ্মশান মোড় থেকে নবগঙ্গা নদীটি খনন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ইতোমধ্যে নদীটি খনন শেষ হয়েছে ৩০ শতাংশ। কিন্তু চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সড়কের নুরনগর গ্রামে নদীটির খননকালে থমকে গেছে কাজ। কারণ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের দুই একর জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊধ্র্বতন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি অবহিত করা হয়েছে মন্ত্রণালয়কে। জাহেদুল ইসলাম আরও জানান, পরবর্তী নির্দেশনা পেলে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাসুম আহমেদ বলেছেন, এটি নদীর জায়গা কিনা এ বিষয়ে আমরা কিছুই জানতাম না। আমরা জানতাম এটি ব্যক্তি মালিকানা জায়গা। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের জন্য মন্ত্রণালয় জায়গা খুঁজলে নুরনগর গ্রামের এই জায়গাটি নির্ধারণ করা হয়। পরে চুয়াডাঙ্গার তৎকালীন জেলা প্রশাসক স্থানীয় ১১ জনের কাছ থেকে দুই একর জায়গা অধিগ্রহণ করে দেন। এজন্য অধিদপ্তরকে গুনতে হয়েছে ১ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এছাড়া অধিদপ্তরের একটি প্রশাসনিক ভবন, একটি প্রশিক্ষণ ভবন, একটি অফিসার ও একটি স্টাফ কোয়াটার, ছেলে মেয়েদের জন্য দুটি হোস্টেল এবং দুটি শেড তৈরির নির্মাণে খরচ হয় ২০ কোটি টাকা।
মাসুম আহমেদ আরও বলেন, গত কয়েকদিন আগে আমরা জানতে পেরেছি অধিগ্রহণ করা জায়গাটি নাকি নবগঙ্গা নদীর। বিষয়টি নিয়ে আমরাও বিব্রত। পুরো বিষয়টি আমরা প্রধান কার্যালয়কে জানিয়েছি।
এদিকে, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কাছে জমি বিক্রি করা ১১ ব্যক্তি ওই জমি তাদের বলেই দাবি করছেন। এদের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা শিল্প ও বণিক সমিতির পরিচালক সালাউদ্দীন মো. মর্তুজা বলেন, ‘এই সম্পত্তি আমার বাপ-দাদার। বিভিন্ন রেকর্ড, দলিলপত্র ও আমাদের নামে। সব কাগজপত্র পরীক্ষা করেই আমরা যুব উন্নয়নের কাছে জমি বিক্রি করেছি।’
আক্তারুজ্জামান মজনু নামে অপর একজন জানান, সরকারের কর্মকর্তারা কি এতটাই বোকা নদীর জায়গা কিনবে। তিনিও বিক্রি করা জমি নিজেদের দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি এবং খুব শিগগিরই আমরা আদালতের শরণাপন্ন হবো।’
নদীর জায়গা দখল করে সরকারি ভবন গড়ে ওঠায় চরম উদ্বেগ জানিয়েছেন নদী বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সি। তিনি বলেছেন, ‘খবরটি আমাদের জন্য দু:খজনক। সরকার যখন সারাদেশে নদীগুলো বাঁচাতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তখন আমাদের জেলাতে নদী দখল করে সরকারি ভবন তৈরি হচ্ছে। এর চাইতে খারাপ খবর কিছুই নেই।’
নদীর বুক চিরে সরকারি ভবন এমন খবরে হতাশা প্রকাশ করেছেন সুজনের চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মাহবুল ইসলাম সেলিম। এ প্রসঙ্গে তিনি প্রশ্ন করেন, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর যখন ভবন তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ শুরু করেছিল তখন পানি উন্নয়ন বোর্ড কি ঘুমাচ্ছিল? সেই সময় কেন তারা প্রতিরোধ করেনি? এখানে যাদের দেখভালের দায়িত্ব ছিল তারা চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তিনি খুব্র দ্রুত যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ভেঙে নবগঙ্গার খনন প্রক্রিয়া চালু করার দাবি জানান।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মো. নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘দখলকারীরা যত শক্তিশালীই হোক, এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান খুব শক্ত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নদী দখলকারীদের বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। সুতরাং দখলকারীরা কে বা কারা, সরকারি না বেসরকারি তা দেখার কোনো সুযোগ নেই। নদী বাঁচাতে কোনো দখলকারীকেই ছাড় দেয়া হবে না।’