দীর্ঘ তাপপ্রবাহে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। অতিরিক্ত রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।
হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের অধিকাংশই রোগী হিট স্ট্রোক, জ্বর, সর্দি, ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত এবং এদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা বেশি।
গত কয়েক দিন ধরে ঢাকাসহ দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলের ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে লোডশেডিংয়ের সমস্যা। এ কারণে হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে গরমজনিত সমস্যায় অসুস্থ রোগীর চাপ।
তাপপ্রবাহের কারণে সবচেয়ে বেশি কাবু হচ্ছে শিশুরা। এরই মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রেণিকক্ষের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে অসুস্থ হয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগীরা আসছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে।
সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালে এসেও অতিরিক্ত গরমে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন রোগীরা। বেহাল অবস্থা তাদের স্বজনদেরও। ওয়ার্ডে ভর্তি ও মেঝেতে থাকা প্রায় সবাই হাতপাখা কিংবা ছোট টেবিল ফ্যান কিনে ব্যবহার করছেন।
ঢাকার নদ্দা থেকে ঢাকা মেডিকেলে এসেছেন আবুল মালেক। তার ছেলে নাদিম ইউএনবিকে জানান, ‘হাসপাতালে সিট খালি না থাকায় আমার বাবাকে ফ্লোরে রেখেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এই গরমে খুবই খারাপ অবস্থা।’
অন্যান্য রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালের অধিকাংশ ফ্যান নষ্ট। হাসপাতালের ভেতরে পর্যাপ্ত বাতাসের অভাব, রোগীর চাপ ও ফ্যান স্বল্পতায় বিপর্যস্ত অবস্থায় আছেন অধিকাংশ রোগী। ভর্তি রোগীদের সঙ্গে স্বজনরাও তীব্র গরমে অসহায় অবস্থায় পড়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘স্টোররুমে যেসব ফ্যান ছিল কর্মীদের বলেছি যেখানে নষ্ট ফ্যান আছে সব পরিবর্তন করে দিতে। যেখানে নতুন করে ফ্যান লাগানো যায় সেখানে ফ্যান সংযুক্ত করতে বলেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে তো অনেক রোগী আসে, অনেক বেশি ভিড়। তাই অনেকেই নিজের লাইট-ফ্যান ব্যবহার করেন। তাই আমি টেকনিশিয়ানদের বলে দিয়েছি যাতে আলাদা লাইনের ব্যবস্থা করা হয়, সেখান থেকে তারা লাইন নিয়ে ফ্যান, লাইট যেন জ্বালাতে পারে।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু ওয়ার্ডে পা ফেলার জায়গা নেই। বিছানা না পাওয়ায় মেঝেতে রেখেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে শিশুদের। জরুরি বিভাগ ও আউটডোরের মেডিসিন বিভাগে রোগীর চাপ সবচেয়ে বেশি।
কুর্মিটোলা হাসপাতাল, মুগদা হাসপাতাল, আইসিডিডিআর,বি ও ঢাকা শিশু হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঈদের পর থেকে দ্বিগুণ রোগী ভর্তি হয়েছে হাসপাতালগুলোতে। যার বেশিরভাগই ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া রোগী।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের জেনারেল পেডিয়াট্রিক্স বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও একাডেমিক পরিচালক অধ্যাপক (ডা.) ফরিদ আহমেদ ইউএনবিকে বলেন, বেশি তাপপ্রবাহের কারণে হিট স্ট্রোক, জ্বর, সর্দি, ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া রোগে সবচেয়ে বেশি কাবু হচ্ছে শিশুরা। যার ফলে হাসপাতালে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু ভর্তি হচ্ছে। এত বেশি শিশু ভর্তির ফলে এখন সিট সংকট প্রকট আকার দেখা দিচ্ছে।
এছাড়া শিশুদের আরও বিভিন্ন রোগের আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান তিনি। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি শিশুদের রাস্তার পাশের খাবার খাওয়া থেকে বিরত রাখার পরামর্শ দেন ডা. ফরিদ আহমেদ।
একই সঙ্গে জ্বরের পাশাপাশি ঘণ্টায় তিনবারের বেশি বমি হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে বলেও জানান তিনি।
ডা. ফরিদ আরও বলেন, গরম বেশি পড়লে সাধারণত ডায়রিয়া, জন্ডিস, পানিবাহিত রোগ, হেপাটাইটিস এ ও ই ভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যায়। এ সময়ে প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়া উচিত না।
এছাড়া বাইরে থেকেই এসেই এসি ছেড়ে দেওয়া, ঠান্ডা পানি খাওয়া ও রাস্তার পাশের শরবত পান থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেন তিনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক রোগ নিয়ন্ত্রক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ ইউএনবিকে জানান, ‘বর্তমানে যে দাবদাহ, একেবারেই অসহনীয়। দাবদাহের কারণে কলেরাসহ অনেক রোগ তৈরি হতে পারে। তাপপ্রবাহ চলমান থাকলে শিশুদের জন্য আরও বড় সমস্যা হতে পারে। পাশাপাশি হাসপাতালে রোগীদের সংখ্যা আরও বেড়ে যেতে পারে।’
তিনি আরও জানান, শরীর যে তাপমাত্রায় স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে, এমন উচ্চ তাপমাত্রায় তা পারে না। নানা ধরনের শারীরিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় অস্বাভাবিক হয়ে যায়। সরাসরি হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে কারো জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। আবার কারো কারো অন্য ধরনের অসুস্থতা ও সংক্রমণও হতে পারে।