অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাত্র দুই মাসের মাথায় নির্বাচনি সংস্কার, সময়সীমা ও পদ্ধতি নিয়ে নানা আলোচনা গতি পাচ্ছে। তবুও কৌতুহলের মধ্যে মানুষের আবেদন ও পছন্দ হারিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর একটি দল প্রচলিত পদ্ধতিতে সংসদীয় নির্বাচনের পক্ষে কথা বলছে। আর অন্যরা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার কথা বলছে। এমতাবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কোন ধরনের সরকার ও নির্বাচন পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী?
রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বড় অংশ বিদ্যমান পদ্ধতির পরিবর্তে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে মত দিচ্ছে। কিন্তু, বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এই পদ্ধতির বিরোধিতা করে আসছে এবং বর্তমান ব্যবস্থাকে সমর্থন করে।
তবে চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের অবস্থান জানা যায়নি।
আরও পড়ুন: ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের কৃতিত্ব ছাত্র-জনতার, কোনো দলের নয়: জামায়াতের আমীর
কিন্তু নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকার বা রাজনৈতিক দল ও ভোটাররা কেউই আগামী নির্বাচনে এসব পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া অনুসরণের জন্য প্রস্তুত নয়।
তারা বলছেন, পিআর প্রক্রিয়াটি অনেক সম্ভাব্য সুবিধা দেবে। তবে এর সম্ভাব্যতা দৃঢ় রাজনৈতিক ইচ্ছা, জনসমর্থন এবং বর্তমান ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (এফপিটিপি) পদ্ধতি থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক পক্ষ এবং ভোটারদের উভয়ের প্রস্তুতির উপর নির্ভর করে।
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন, ভবিষ্যতে বাস্তবায়নের নির্দেশনা হিসাবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। কারণ, এটি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আরও প্রাণবন্ত সংসদ তৈরি, নির্বাচনে অর্থ ও পেশি শক্তির প্রভাব কমানো এবং স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে।
পিআর, বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, একটি নির্বাচনি ব্যবস্থা- যেখানে আসন বিতরণ প্রতিটি দলের প্রাপ্ত মোট ভোটের অনুপাতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো দল মোট ভোটের ৪০ শতাংশ ভোট পায়, তবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি অনুযায়ী সংসদে দলটি ৪০ শতাংশ আসন বরাদ্দ পাবে।
বিশিষ্ট নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, 'পিআর একটি ভালো নির্বাচন ব্যবস্থা। আমি এটাকে সমর্থন করি এবং বাংলাদেশের জন্য কেন এটি প্রয়োজন তা নিয়ে আমি একটি বইও লিখেছি। তবে আমরা প্রস্তুত না থাকায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে তা বাস্তবায়ন করতে পারব না। আমাদের সরকার, রাজনৈতিক দল ও ভোটাররা এর জন্য অপ্রস্তুত।’
আরও পড়ুন: আওয়ামী লীগের প্রণীত ‘কালা কানুন’ দিয়েই তাদের বিচার হোক: জামায়াত আমির
তিনি উল্লেখ করেন যে, বর্তমানে প্রায় ৭০ থেকে ৮০টি দেশে বিশ্বব্যাপী আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির কিছু পদ্ধতির অনুশীলন করা হয়।
তিনি বলেন, 'এটা আশাব্যঞ্জক যে রাজনৈতিক দলগুলো এই ব্যবস্থা চালু করার পক্ষে সওয়াল বা সুপারিশ করছে। কিন্তু আমাদের ভোটারদের এ বিষয়ে জ্ঞানের অভাব রয়েছে। আমাদের অবশ্যই প্রথমে তাদের শিক্ষিত করতে হবে এবং এই প্রক্রিয়াটি জনগণকে বোঝাতে সময় লাগবে।’
এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে বিভিন্ন রূপ ও সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যা নির্বাচনি ফলাফলে আনুপাতিকতা অর্জনের বিভিন্ন পদ্ধতির প্রতিফলন ঘটায়। ‘আমরা কোনটি গ্রহণ করব সে বিষয়ে আমাদের একটি রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার।’
তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য বাধা হলো- প্রধান দলগুলো এটি গ্রহণ নাও করতে পারে। কারণ, এটি তাদের প্রভাবশালী শক্তিকে ব্যাহত করতে পারে এবং তাদের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করাকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে।
তোফায়েল বলেন, ‘বিএনপি ও আওয়ামী লীগ আমাদের প্রধান দুই দল, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের সমর্থন ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। বিএনপি এই ব্যবস্থার বিরোধিতা করছে এবং বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আমরা আওয়ামী লীগের মতামত শুনতে পাচ্ছি না। আমার মনে হয়, তারাও এটা সমর্থন নাও করতে পারে। যদি জামায়াতের একটি বড় অঙ্কের ভোটার ভিত্তি থাকত, তাহলে তারাও সম্ভবত সমর্থন করত না।’
তিনি বলেন, ছোট দলগুলো আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব প্রক্রিয়ার পক্ষে, কারণ এটি তাদের আসনগুলো সুরক্ষিত করার সুযোগ দেবে, যা তারা বিদ্যমান ব্যবস্থার অধীনে নাও পেতে পারে।
তোফায়েল আরও বলেন, ‘তাই এ পদ্ধতির বাস্তবায়ন খুবই চ্যালেঞ্জিং। পিআর প্রক্রিয়া এবং এর সুবিধাগুলো বোঝার জন্য আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে সময় দেওয়া উচিত। রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।’
তিনি বলেন, সংবিধান সংস্কার কমিশন এই পদ্ধতি প্রবর্তন ও পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় সনদে একটি নির্দেশিকা অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করতে পারে।
এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, বিএনপি একটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও জাতীয় সরকার নিয়ে আলোচনা করছে, যা শাসন ব্যবস্থায় বিভিন্ন পটভূমির মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি এবং আইন প্রণয়ন সহজতর করতে পারে। ‘আমাদের এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের পাশাপাশি এই দুটি বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া উচিত।’
আরও পড়ুন: গণতন্ত্র নির্বাচনসহ অনেক কিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে: তারেক রহমান
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ-জানিপপের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে পিআর সিস্টেম বিভিন্নভাবে বিদ্যমান এবং তিনি ১৯৯০ এর দশক থেকে এটি বাস্তবায়নের পক্ষে পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
তিনি জোর দিয়েছিলেন যে পিআর সিস্টেম সম্পর্কে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে বোঝানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘তা না হলে ভবিষ্যতে এ পদ্ধতি চালু করা সম্ভব হবে না।’
সাবেক আমলা আবু আলম মো. শহীদ খান সংসদীয় আসনের সংখ্যা ৩০০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫০-এ উন্নীত করে বিদ্যমান প্রচলিত পদ্ধতির সঙ্গে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) সমন্বয় করে একটি মিশ্র নির্বাচনি ব্যবস্থার প্রস্তাব করেন।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘সেক্ষেত্রে বর্তমান নির্বাচনি ব্যবস্থা ৩০০ সংসদীয় এলাকার জন্য প্রযোজ্য হতে পারে, আর ১৫০টি নির্বাচনি আসনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) প্রয়োগ করা যেতে পারে।’
গত ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি চালুসহ ১০ দফা রাষ্ট্রীয় সংস্কার প্রস্তাব পেশ করেছে।
গত ১২ অক্টোবর নির্বাচনি সংস্কার বিষয়ক এক সেমিনারে জামায়াত নেতা ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স সকলেই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি ইসলামী দলও এটি চালুর আহ্বান জানিয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) ব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত নয়। ‘আমরা এটা সমর্থন করব না। বাংলাদেশে এই পদ্ধতির প্রচলন নেই, তাই আগামী নির্বাচনেও এটি প্রয়োগের প্রশ্নই আসে না।’
আরও পড়ুন: ইসিতেই এনআইডি নিবন্ধনের কাজ রাখার দাবি কর্মকর্তাদের