গণগ্রেপ্তারের ভয়ে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ৩ ইউনিয়নের ১০ গ্রামের পুরুষ ঘর ছাড়া হয়েছেন। এতে করে গ্রামগুলোতে ব্যবসা ও আয়মূলক কর্মকাণ্ডে ভাটা পড়েছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির দালালরা মানুষের দুর্বলতাকে পুঁজি করে মামলা থেকে নাম প্রত্যাহারের কথা বলে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
এ ব্যাপারে উলিপুর থানা পুলিশ জানায়, গ্রামের মানুষকে আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে। শুধুমাত্র ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদেরকে যাচাই-বাছাই করে আটক করা হচ্ছে। দালাল চক্রের বিষয়টিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের নজরেও এসেছে। সেটি কঠোরভাবে নজরদারী করা হচ্ছে।
চলতি বছরের ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার ঘটনায় কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের পাঁচ মন্দিরে ভাঙচুর চালানো হয়। এ সময় দুর্বৃত্তরা প্রতিমা ভাঙচুরসহ বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটায়। পরে উলিপুর থানা পুলিশ বাদী হয়ে মন্দির ভাঙচুর ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে পৃথক পাঁচটি মামলায় ৭৯ জনের নাম উল্লেখসহ প্রায় সাত শতাধিক অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। আর এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৬৬ জনকে আটক করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: করতোয়া নদী দখল করে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ!
এছাড়া মামলার পর থেকে গুনাইগাছ ইউনিয়নের নেফড়া, কালুডাঙ্গা গ্রামের কাঠালীপাড়া, হাজীপাড়া, খারিজাপাড়া, মৌলভীপাড়া, পূর্বপাড়া, কালুডাঙ্গাপাড়া এবং থেতরাই ইউনিয়নের রামপ্রসাদ, হোকডাঙ্গা, কিশোরপুর, বকশিপাড়া, তেলিপাড়া, থেতরাই বাজার এলাকার ফকিরপাড়া, সাতদরগাহ্, বকশিরবাজার, দালালীপাড়া, মতুল্ল্যাটারী, বকশিপাড়া, নাপিতপাড়া, হাজীপাড়া, কানিপাড়া, তেলিপাড়া পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে। পুরুষ শূন্য হয়ে পড়ায় বিরুপ প্রভাব পড়েছে আশেপাশের গ্রামসহ হাট বাজারগুলোতে। বিঘ্নিত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
সরেজমিন দেখা গেছে, গ্রেপ্তার আতঙ্কে ওইসব গ্রামে দিনের বেলা কিছু মানুষ চোখে পরলেও বিকাল হওয়ার সাথে সাথে গ্রামগুলো পুরুষ শূন্য হয়ে পরে। ফলে হাটবাজারগুলোতে আগের মত কোলাহল বা ভিড় দেখা যাচ্ছে না। বেচাকেনা না হওয়ায় ক্ষুদ্র ব্যবসার সাথে জড়িত লোকজন বিপাকে পড়েছে।
আরও পড়ুন: প্রাণহীন জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরি!
উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের রামপ্রসাদ পাড়ার বাসিন্দা কৃষক বাবলু মিয়া বলেন, ‘মামলার ভয়োত কামলারা পলাইছে। এ্যালা শাক তোলার কামলা পাবার নাগছি না। হামার এটে এবার ভালোই শাকসবজি হইছে। কিন্তুক বর্তমানে এলাকাত পুরুষ মানুষ নাই। ফকির মিসকিনও এই গ্রামোত আসপের চায় না।’
একই ইউনিয়নের সাতদরগা গ্রামের মুদি দোকানদার জাহাঙ্গীর জানান, ‘হামার এটে বেশির ভাগ পুরুষ মানুষ আর মাদরাসা ছাত্ররা বাড়ি ছাড়ি পালাইছে। মুই পঙ্গু মানুষ সাহস করি দোকানদারী করবের নাগছং। গণ্ডগোলের পর থাকি বেচাকেনা নাই। চা বেচেয়া কোনদিন দশ টেকা কোনদিন বা ২০ টেকা লাভ হয়। এই দিয়া কী সংসার চলে।’
থেতরাই বাজারের পাশে ফকিরপাড়ার বাসিন্দা সাথী আক্তার জানান, গ্রেপ্তারের ভয়ে বাড়ির পুরুষ মানুষগুলো পালিয়ে রয়েছে। সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে এলাকার নারীরাই এখন বাজার করছে।
বাজারের অটোচালাক খোরশেদ আলম জানান, আগে দিনে ৮০০ থেকে হাজার পর্যন্ত আয় হতো। কিন্তু মামলার পর থেকে এলাকায় পুরুষ শূণ্য হওয়ায় প্যাসেঞ্জার পাওয়া যাচ্ছে না। এখন দিনে দু’-আড়াইশ টাকার বেশি কামাই হচ্ছে না।
আরও পড়ুন: হারিয়ে যাচ্ছে মুরাদনগরের ‘মৃৎশিল্প’
এ ব্যাপারে উলিপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন মন্টু জানান, প্রকৃত অপরাধীদের অবশ্যই আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। বাংলাদেশে সম্প্রীতির বন্ধন নষ্ট করতে দেয়া যাবে না। তবে দালাল চক্র যাতে ফায়দা লুটতে না পারে সে ব্যাপারে পুলিশকে সতর্ক থাকতে হবে।
তিনি জানান, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সেটি প্রভাব ফেলতে পারে।
এ বিষয়ে উলিপুর থানার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইমতিয়াজ কবীর জানান, এখন পর্যন্ত ৬৬ জনকে আটক করা হয়েছে। বিভিন্ন তথ্যাবলী ও ভিডিওর মাধ্যমে দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। নিরীহ কেউ যাতে ভোগান্তিতে না পড়ে সে ব্যাপারে পুলিশ সজাগ রয়েছে। আর গ্রামের সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।