কৃষিপণ্যের উচ্চমূল্যের জন্য দায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে স্মার্ট এগ্রিকালচার সাহায্য করবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) স্মার্ট এগ্রিকালচার বিভাগের পরিচালক ও প্যারাসাইটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সহিদুজ্জামান।
তিনি বলেন, কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ও কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নে এটি ব্যাপকভাবে সহায়ক হতে পারে। এছাড়া কৃষিপণ্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কৃষক থেকে সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোও স্মার্ট এগ্রিকালচারের অন্তর্ভুক্ত। কৃষকরা সরাসরি বাজারজাত করতে পারলে মধ্যস্বত্বভোগীদের হস্তক্ষেপ কমবে এবং তারাও ন্যায্যমূল্য পাবেন।
স্মার্ট এগ্রিকালচারের পরিচালক অধ্যাপক সহিদুজ্জামান বলেন, স্মার্ট এগ্রিকালচার বলতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এবং নতুন নতুন কৃষি উদ্ভাবনের মাধ্যমে কৃষিকাজকে আরও দক্ষ, লাভজনক এবং টেকসই করার প্রক্রিয়াকে বোঝায়। এর মাধ্যমে স্যাটেলাইট ইমেজিং, ড্রোন, সেন্সর ও জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাটির গুণগত মান, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা ও অন্যান্য পরিবেশগত তথ্য সংগ্রহ করা যায়। এর ফলে কৃষকরা সঠিক সময়ে সঠিক সেচ, সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে পারেন। স্মার্ট এগ্রিকালচার ব্যবস্থায় ডেটা অ্যানালাইটিক্সের সাহায্যে ফসল উৎপাদনের পূর্বাভাস, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং কীটপতঙ্গের আক্রমণ সম্পর্কে আগাম তথ্য পাওয়া সম্ভব। এছাড়া এটি কৃষকদের আরও কার্যকরী পরিকল্পনা করতে সাহায্য করবে।
স্মার্ট এগ্রিকালচারের বিভিন্ন উপকারী দিক সম্পর্কে অধ্যাপক ড. সহিদুজ্জামান ইউএনবিকে বলেন, স্মার্ট এগ্রিকালচারের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা, খরা ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। উন্নত বীজ ও কৃষিপণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বেশি উৎপাদনশীল এবং জলবায়ু সহিষ্ণু ফসলের চাষ করা সম্ভব হবে, যা বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়াবে। নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তির সাহায্যে কৃষকরা প্রতিকূল পরিবেশেও সফলভাবে চাষাবাদ করতে পারবে।
স্মার্ট এগ্রিকালচারে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রযুক্তি সম্পর্কে এ অধ্যাপক জানান, স্মার্ট ট্রাক্টর, রোবটিক হারভেস্টার এবং অটোমেটেড সেচ সিস্টেম ব্যবহার করে কৃষি কাজের খরচ ও সময় উভয়ই কমানো সম্ভব। এর মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো এবং শ্রমের উপর নির্ভরতা কমানো যায়। ইন্টারনেট অব থিংস ব্যবহার করে স্মার্ট সেন্সর ও ডিভাইসগুলো মাটির স্বাস্থ্য, আর্দ্রতা এবং অন্যান্য পরিবেশগত তথ্য রিয়েল-টাইমে সংগ্রহ করে যা দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দেয়।
দেশে স্মার্ট এগ্রিকালচারের সম্ভাবনার পাশাপাশি মাটির সুরক্ষায় এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে স্মার্ট এগ্রিকালচারের ভূমিকা ইউএনবির কাছে তুলে ধরে বাকৃবির মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মফিজুর রহমান জাহাঙ্গীর এবং গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ওয়াকিলুর রহমান।
স্মার্ট কৃষিতে কীটনাশকের গুরুত্ব উল্লেখ করে মৃত্তিকা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. মফিজুর রহমান জাহাঙ্গীর ইউএনবিকে বলেন, কীটনাশক ব্যবহার করা স্মার্ট এগ্রিকালচারের একটি অংশ। স্মার্ট এগ্রিকালচার উদ্ভাবিত বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাৎক্ষণিকভাবে জমিতে কীটপতঙ্গের আক্রমণ, ফসলের বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ ইত্যাদি যথাসময়ে নির্ণয় করে প্রতিকারের ব্যবস্থা করা যায়। এছাড়া নির্দিষ্ট জমিতে কীটনাশক ব্যবহারের যথাযথ পরিমাণ, সময় ও ব্যবহার পদ্ধতি স্মার্ট এগ্রিকালচারের মাধ্যমেই জানা যাবে। স্মার্ট এগ্রিকালচার এবং কীটনাশকের সমন্বয় করলে দিনশেষে কৃষকরাই লাভবান হবে।
আগাছানাশক বা কীটনাশক সম্পর্কে ওই অধ্যাপক আরও বলেন, জৈব সার মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী মাইক্রোবিয়াল পপুলেশনের সংখ্যা বাড়াতে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু জৈব সার প্রয়োগে মাটির উর্বরতা বাড়ে কিন্তু আগাছা নির্মূল করা যায় না যা কৃষি উৎপাদনের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কিছু কিছু নন-টার্গেটেড মাইক্রো ও ম্যাক্রো অণুজীব প্রভাবিত হয়। এতে কিছু জীবাণুর সংখ্যা ও কার্যক্রম কমে যায় আবার কিছু অণুজীব প্রভাবিত হয় না। কীটনাশক কখনো মাটির ব্যাকটেরিয়াকে প্রভাবিত করে আবার কখনো মাটির ছত্রাককে প্রভাবিত করে। এটি নির্ভর করে কীটনাশকের রাসায়নিক গঠনের উপর। আগাছানাশক ব্যবহারের ফলে মাটিতে বসবাসকারী অণুজীব তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় না অথবা হলেও সেটা কীটনাশক প্রয়োগের প্রথম ১৪ থেকে ১৫ দিন পর আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক জাহাঙ্গীর তার একটি গবেষণার উদাহরণ উল্লেখ করে বলেন, একটি জমিতে নাইট্রিফায়ার্স মাইক্রোবিয়াল পপুলেশনের উপর আগাছানাশক প্রয়োগ করে দেখা যায় পপুলেশনের পরিমাণ প্রথম ১৫ দিন কিছুটা কমে যায়। তবে পরে ওই পপুলেশনের সংখ্যা আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।
মাটির মাইক্রোবিয়াল পপুলেশন ও তাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যর উপর কীটনাশকের প্রভাব যেমন সয়েল মাইক্রোবায়োলজি ও মাইক্রোবিয়াল ইকোলজির উপর প্রভাব জানতে হলে আরও অনেক গবেষণা প্রয়োজন বলে জানান মৃত্তিকা বিজ্ঞানী জাহাঙ্গীর।
এক্ষেত্রে কৃষি পেশার সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের কর্মসংস্থান হারানোর সম্ভাবনা আছে কি না-এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মো. ওয়াকিলুর রহমান ইউএনবিকে বলেন, দেশে বিস্তরভাবে স্মার্ট এগ্রিকালচার বাস্তবায়িত হলে কর্মসংস্থান নষ্ট হওয়ার কোনো ঝুঁকি নেই বরং এটি নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে ভূমিকা পালন রাখবে। উদ্যোক্তা তখনই তৈরি হবে যখন তারা কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত হয়ে লাভবান হতে পারবে। কৃষির সঙ্গে সরাসরি জড়িত অনেকেই অন্যান্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। ফলে দেশে অনাবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে স্মার্ট এগ্রিকালচার বাস্তবায়িত হলে অনাবাদি সকল জমিই চাষযোগ্য করা যাবে এবং অর্থনৈতিক লাভ নিশ্চিত হবে।
দেশের কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নে তরুণদের ভূমিকা ও বাণিজ্যিকভাবে স্মার্ট এগ্রিকালচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কৃষি কাজ এখনও ব্যবসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। স্মার্ট এগ্রিকালচারের মাধ্যমে সহজেই কৃষিকে বাণিজ্যিকভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব।
অধ্যাপক ওয়াকিলুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশের কৃষি কাজ এখনো প্রকৃতি নির্ভর। কৃষিকে লাভজনক ও বাণিজ্যিকীকরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে স্মার্ট এগ্রিকালচার বিস্তরভাবে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
স্মার্ট এগ্রিকালচারের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে বাকৃবির স্মার্ট এগ্রিকালচারের অধ্যাপক সহিদুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে স্মার্ট এগ্রিকালচার কার্যকর করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। প্রযুক্তিগত অবকাঠামো উন্নয়ন (ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ), কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং সহযোগিতা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যাপক বলেন, দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগের ঘাটতি রয়েছে। এটি স্মার্ট এগ্রিকালচার বাস্তবায়নে একটি বড় বাধা। তাই অবকাঠামোগত উন্নয়ন জরুরি৷ দেশের অধিকাংশ কৃষক আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে অবগত নন। এছাড়া এদেশের আবাদি জমিগুলো ছোট ছোট খণ্ডে ভাগ করা। এসব খণ্ডিত জমিগুলোতে ড্রোন বা আধুনিক কৃষি যন্ত্র ভালো পরিচালনা করা কষ্টসাধ্য আবার এতে উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়।