প্রতিষ্ঠিত অনলাইন নিউজ সার্ভিস, ইরাওয়াদ্দি জানিয়েছে যে দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি এবং দেশটির রাষ্ট্রপতি উইন মিন্টকে সোমবার ভোরে আটক করা হয়েছে। নিউজ সার্ভিসটি সু চির ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) মুখপাত্র মায়ো নিন্টের বরাত দিয়ে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, আইন প্রণেতা এবং আঞ্চলিক মন্ত্রিসভার সদস্যদেরও হেফাজতে নেয়া হয়েছে।
খবরে বলা হয়েছে, সোমবার ভোরে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান হচ্ছে এবং স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চিকে গৃহবন্দী করে আটক করা হয়েছে, রাজধানীর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
আরও পড়ুন: সু চি’র সাথে বরিস জনসনের আলোচনা, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: সু চির অবস্থান পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম
নেপিডোতে ফোন এবং ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে এবং সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি পার্টিতে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যান্য দেশ এই খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
ওয়াশিংটন থেকে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেছেন, ‘বার্মার সেনাবাহিনী স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি এবং অন্যান্য বেসামরিক কর্মকর্তাদের আটকসহ দেশটির গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে বিনষ্ট করার পদক্ষেপ নিয়েছে, এমন খবরে আমেরিকা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।’ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে এ সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। বার্মা মিয়ানমারের পূর্ব নাম।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন করতে বা মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে বাধা দেয়ার যেকোনো প্রয়াসের বিরোধিতা করছে এবং এই পদক্ষেপ থেকে সরে না আসলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেরিস পেইন সু চি এবং আটক অন্যদের মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। ‘আমরা ২০২০ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের সাথে সামঞ্জস্য রেখে জাতীয় পরিষদের শান্তিপূর্ণ পুনর্গঠনকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করি,’ তিনি বলেন।
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে সু চির প্রতি আহ্বান
জাতিসংঘের আদালতে গণহত্যার অভিযোগ সু চি’র অস্বীকার
গত বছরের নির্বাচনের পর সোমবার মিয়ানমারের আইন প্রণেতাদের সংসদের প্রথম অধিবেশনে যোগ দেয়ার জন্য রাজধানী নেপিডোতে জড়ো হওয়ার কথা ছিল।
মিয়ানমার ভিজ্যুয়াল টেলিভিশন এবং মিয়ানমার ভয়েস রেডিও সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ফেসবুকে পোস্ট করে জানায় যে তারা তাদের প্রোগ্রাম সম্প্রচার করতে পারছে না।
৭৫ বছর বয়সী সু চি এখন পর্যন্ত দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে অহিংস লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেয়ার পরে তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা হয়েছেন।
গত বছর নভেম্বরের নির্বাচনে অং সান সুচির এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু সেনাবাহিনী নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তোলে। তবে অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয় এবং নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনীল অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে। নির্বাচনে ৪৭৬ আসনের মধ্যে সু চির দল সংসদের নিম্ন ও উচ্চ কক্ষে মোট ৩৯৬টি আসনে জয়লাভ করে।
তবে ২০০৮ সালের সামরিক খসড়া সংবিধানের অধীনে মোট আসনের ২৫ শতাংশ সেনাবাহিনীর হাতে রয়েছে এবং বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর পদও সেনাবাহিনীর নিয়োগের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে।
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অবস্থানে মালয়েশিয়ার সমর্থন হারিয়েছেন সু চি
সামরিক বাহিনী ২০১১ পর্যন্ত মিয়ানমার শাসন করেছে। সু চি অনেক বছর ধরে গৃহবন্দী ছিলেন।
মিয়ানমারের স্বাধীনতার নায়ক জেনারেল অং সানের মেয়ে অং সান সু চি। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র দুই বছর পর তার যখন দুই বছর বয়স তখন তার বাবাকে হত্যা করা হয়।
মিস সু চিকে একসময় মানবাধিকারের বাতিঘর বলা হত- যিনি একজন নীতিবান অধিকারকর্মী হিসেবে দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারের শাসন ক্ষমতায় থাকা নির্দয় সামরিক জেনারেলদের চ্যালেঞ্জ করতে নিজের স্বাধীনতাকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন।
১৯৯১ সালে তাকে নোবেল শান্তি পুরষ্কার দেয়া হয় এবং তাকে ‘ক্ষমতাহীনদের ক্ষমতার অনন্য উদাহরণ’ হিসেবে সম্বোধন করা হতো। তখনও তিনি গৃহবন্দীই ছিলেন। ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে অন্তত ১৫ বছর বন্দী জীবন কাটিয়েছেন মিস সু চি।
২০১৫ সালের নভেম্বরে ২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবার অনুষ্ঠিত অবাধ নির্বাচনে অংশ নিয়ে এনএলডির নেতৃত্ব দেন এবং যাতে বড় ধরনের জয় পান তিনি।
নোবেল পুরস্কার পাওয়া সু চি সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হন দেশটির রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো ধর্ষণ, নির্যাতন ও গণহত্যার জন্য। দেশটির সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রতেবিশী দেশ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় রোহিঙ্গারা।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। আগে আশ্রয় নেয়াসহ বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন শিবিরে বসবাস করছেন।
আরও পড়ুন: সু চি ও জেনারেলদের অবশ্যই ফৌজদারি বিধিতে জবাবদিহি করতে হবে, দাবি নোবেল বিজয়ীদের