দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধ, অনাক্রম্যতা বৃদ্ধি এমনকি মানসিক সুস্থতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর খাবারের কোনো বিকল্প নেই। শরীরের অভ্যন্তরে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নানাবিধ কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে উপযুক্ত খাবার। পাশপাশি প্রতিদিনের বিভিন্ন কাজে শরীরকে প্রাণবন্ত রাখার জন্য প্রত্যেকেরই আলাদা নজর থাকে পুষ্টিকর খাবারের প্রতি। তাই সঙ্গত কারণেই বিগত কয়েক বছর ধরে চলে আসছে ওমেগা-৩ ডিম নিয়ে গুঞ্জনটা। ডিমের বাজারে ব্যাপক হারে উপস্থিতির কারণে এটি সাধারণ ডিমের বিকল্প হিসেবেও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। চলুন, ওমেগা-৩ ডিম আসলেই স্বাস্থ্যসম্মতো কি না তা যাচাই করে নেওয়া যাক।
ওমেগা-৩ কী
পিইউএফএ (পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড) এর যতগুলো ধরন রয়েছে সবগুলো একটি নির্দিষ্ট পুষ্টিগ্রুপের অন্তর্ভূক্ত। অর্থাৎ গ্রুপটির মাধ্যমে সরাসরি বোঝানো হয় পিইউএফএকে। আর এই পুষ্টিগ্রুপের নাম ওমেগা-৩, যেটি মূলত মাছের তেল এবং অন্যান্য খাদ্য উৎসে পাওয়া যায়। অবশ্য অনেকেই মাছের তেল ও ওমেগা-৩ কে একই জিনিস ভেবে থাকেন। কিন্তু ওমেগা-৩ একটি পুষ্টি উপাদান, আর মাছের তেল হচ্ছে সেই পুষ্টির অনেক উৎসের মধ্যে একটি।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো ৩ ধরনের। আলফা-লিনোলেনিক অ্যাসিড (এএলএ), আইকোস্যা-পেন্টিনোয়িক অ্যাসিড (ইপিএ) এবং ডোকোস্যা-হেক্সিনোইক অ্যাসিড (ডিএইচএ)। এগুলোর মধ্যে ইপিএ এবং ডিএইচএ প্রধানত প্রাণিজ খাবার বিশেষত সামুদ্রিক খাবারে (প্রধানত মাছ) পাওয়া যায়। আর এএলএ’র সর্বোত্তম উৎস হলো উদ্ভিদজাত খাবার, যেমন আখরোট, তিসির বীজ, সয়াবিন এবং ক্যানোলার তেল।
আরও পড়ুন: নিরাপদ ব্রয়লার মুরগি কী, কেন খাবেন
ওমেগা-৩ ডিম বৃত্তান্ত
যথেষ্ট পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া মুরগি যে ডিম দেয়, সেগুলোই মূলত ওমেগা-৩ ডিম নামে পরিচিত। এক্ষেত্রে মুরগি পালনের সময় এদের খাদ্য তালিকায় তিসির বীজ অথবা মাছের তেল মেশানো হয়। মুরগির বেশি বেশি ওমেগা-৩ গ্রহণ করার ফলে তাদের টিস্যুগুলোতে এই ফ্যাটি অ্যাসিডের কার্যকারিতা শুরু হয়। তিসির বীজ হজমের সময় এতে থাকা এএলএ এবং ডিএইচএ উভয় ফ্যাটি অ্যাসিড ডিমের কুসুমে গঠনে অংশ নেয়। ফলস্বরূপ ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ ডিম তৈরি হয়।
ওমেগা-৩ মুরগির ডিম স্বাস্থ্যের জন্য কতটা উপকারি
স্বাস্থ্যকর কোষ ঝিল্লি
মানবদেহের প্রতিটি কোষ প্রধানত ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ কোষ ঝিল্লি দিয়ে পরিবেষ্টিত। এই ঝিল্লি দিয়ে কোষে সঠিক পরিমাণে প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রবেশ করতে পারে এবং একই সঙ্গে কোষ থেকে বর্জ্য পদার্থগুলো দ্রুত বেরিয়ে যায়। এই কাজগুলোর সুষ্ঠু সম্পাদনের জন্য প্রয়োজন হয় কোষ ঝিল্লির অখণ্ডতা এবং তারল্যে ভারসাম্য বজায় রাখা।
ফ্যাটি অ্যাসিডের ঘাটতিতে কোষগুলো পানি এবং গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি ধরে রাখার ক্ষমতা হারায়। সেই সঙ্গে এগুলো অন্যান্য কোষের গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশ নেওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। কোষ ঝিল্লিকে কার্যকরভাবে তার সর্বোত্তম অবস্থায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে ওমেগা-৩।
আরও পড়ুন: গরুর দুধের বিকল্প হিসেবে খেতে পারেন যেসব স্বাস্থ্যসম্মত খাবার
ত্বকের সুরক্ষা
মানব ত্বক একটি বেষ্টনি দিয়ে পরিবেষ্টিত থাকে, যেটি ত্বকের আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ এবং এপিডার্মিসের ক্ষতি রোধ করতে সহায়তা করে। যথেষ্ট পরিমাণে ওমেগা-৩ গ্রহণ এই বেষ্টনিকে আরও মজবুত করতে পারে। সেই সঙ্গে এটি ত্বকের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানির যোগান নিশ্চিত করে।
এছাড়া ত্বকের বেষ্টনিতে কোটি কোটি উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে। এগুলো বাইরে থেকে আগত ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে ত্বকের ভেতরে প্রবেশের আগেই ধ্বংস করে ফেলে। একটি ত্বকে ওমেগা-৩-এর পরিমাণ যত বেশি হয়, আক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোর বিরুদ্ধে এটি তত শক্তিশালী হয়।
হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি হ্রাস
ওমেগা-৩ এর গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাটি অ্যাসিড এএলএ হৃৎপিণ্ডের ধমনীতে ‘প্ল্যাক’ কমায়। ধমনী প্ল্যাক হলো ধমনীর আভ্যন্তরীণ আস্তরণে এক ধরনের জমাট, যেটি সৃষ্টি হয় কোলেস্টেরল, চর্বি বা কোষীয় বর্জ্য পণ্যের মতো পদার্থের মাধ্যমে। এই জমাট বাধার কারণে ধমনী সরু এবং শক্ত হয়ে রক্ত প্রবাহকে বাধা দিতে পারে। প্ল্যাক ফেটে গেলে টিস্যুগুলোতে রক্ত না পৌঁছানোর কারণে সেগুলোতে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। এতে করে চূড়ান্ত অবস্থায় টিস্যুগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং হার্ট-অ্যাটক ও স্ট্রোকের ঘটনা ঘটে।
আরও পড়ুন: চিনির কিছু স্বাস্থ্যকর প্রাকৃতিক বিকল্প
টানা ৬ বছর ধরে এএলএ উচ্চ মাত্রায় গ্রহণ করলে পুরুষ ও মহিলা উভয়ের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ৫৯ শতাংশ কমে যায়। প্রতিদিন ১ থেকে ১ দশমিক ২ গ্রাম করে এএলএ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এতে করে হৃদরোগ আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু ঝুঁকি ২০ শতাংশেরও বেশি কমে যায়। এটি সুস্থ ব্যক্তির হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
ডিম ও ফ্যাটি অ্যাসিডের স্বাস্থ্যকর সমন্বয়
সাধারণ ডিমের পুষ্টিগুণ
ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ হোক বা না হোক, ডিম একাই প্রোটিন, ভিটামিন ডি, আয়রন এবং বি-১২ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিতে ভরপুর।
ডিমে থাকে কোলিন, যা মানবদেহের সুস্থ কোষঝিল্লি, মানসিক কার্যকারিতা এবং স্মৃতিশক্তির জন্য প্রয়োজন। এছাড়া এই কোলিন শরীরে হোমোসিস্টাইনের মাত্রা কম রাখতে সাহায্য করে। প্রোটিন সংশ্লেষণ ও বিপাক ব্যাহত করার পাশাপাশি হোমোসিস্টাইন কোষের বিভিন্ন কার্যকারিতা বিশেষ করে ডিএনএকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
আরও পড়ুন: তীব্র গরমে পানিশূন্যতা প্রতিরোধে উপকারী শাকসবজি
ডিমে থাকা সেলেনিয়াম নামক খনিজটি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উন্নত করার জন্য দরকার।
ভিটামিন বি এর পাওয়ার হাউজ হচ্ছে ডিম। এর মৌলিক উপাদান ফোলেট এবং রাইবোফ্ল্যাভিন শরীরের জন্য দরকারি খাবারগুলোকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করে। ফোলেট হোমোসিস্টাইনের মাত্রা কমাতে এবং জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধে অংশ নেয়।
এছাড়া ডিম ভিটামিন এ ও ই এর একটি ভালো উৎস। ভিটামিন এ রাতের দৃষ্টিশক্তির প্রখরতা, কোষের সাধারণ বৃদ্ধি এবং ত্বকের সুস্থতায় কাজ করে। ভিটামিন এ এর সঙ্গে সম্পর্কিত দুটি উপাদান লুটেইন এবং জিয়াজান্থিন, যেগুলো পাওয়া যায় ডিমের কুসুমের হলুদ রঞ্জক পদার্থে। এগুলো চোখের রেটিনায় ম্যাকুলার অবক্ষয় প্রতিরোধে সাহায্য করে। ম্যাকুলার অবক্ষয় বার্ধক্যের সময় স্থায়ী ভাবে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে দেয়।
আরও পড়ুন: কাঁসা, পিতল ও তামার তৈজসপত্র ব্যবহার কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত, বিজ্ঞান কী বলে?
ভিটামিন ই একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ভিটামিন সি এবং সেলেনিয়ামের সঙ্গে মিলে শরীরকে ফ্রি র্যাডিকেল মুক্ত করে। ফ্রি-র্যাডিকেলের কারণে প্রদাহ জনিত রোগ এবং টিস্যুর ক্ষয় হয়ে থাকে।
ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ ডিমের পুষ্টিগুণ
একটি ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ ডিমে ৬০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকতে পারে, যা সাধারণ ডিমের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। এই ডিমগুলো সাধারণ ডিমের তুলনায় প্রায় এক তৃতীয়াংশ কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং সামান্য কম কোলেস্টেরল প্রদান করে। ওমেগা-৩-এর কার্ডিও-প্রতিরক্ষামূলক প্রভাবের কারণে এই ডিমগুলো উচ্চ কোলেস্টেরল থাকা এবং হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য বেশ উপকারী।
এছাড়া ইপিএ এবং ডিএইচএ বিভিন্ন খাবার উৎসে পাওয়া যায়। কিন্তু এএলএ’র সবচেয়ে পরিচিত ও সহজলভ্য উৎস হচ্ছে ডিমের কুসুম। তাই এএলএ’র উপরোক্ত উপযোগিতাগুলো পেতে হলে ওমেগা-৩ ডিম খেতে হবে।
আরও পড়ুন: শহরে রান্নার জন্য গ্যাসের চুলার সেরা কয়েকটি বিকল্প
শেষাংশ
ওমেগা-৩ এর এএলএ (আলফা-লিনোলেনিক অ্যাসিড) পুষ্টি উপাদানের স্বাস্থ্যগুণের বিচারে ওমেগা-৩ মুরগির ডিম নিঃসন্দেহে একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য। বিশেষ করে ওমেগা-৩ এর অন্যান্য উৎসগুলোর তুলনায় ডিম সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার সব থেকে পরিচিত এবং উপাদেয় এই খাবারটি বাড়ন্ত বয়স থেকে শুরু করে সব বয়সেই প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান দেয়। সেখানে ৫ গুণ বেশি পুষ্টি সমৃদ্ধ একটি বিকল্প দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাসে আরও বেশি সহায়ক হতে পারে।
আরও পড়ুন: রেস্তোরাঁ-শপিং মলে প্রবেশের আগে যে বিষয়গুলোতে সাবধান থাকা জরুরি