মাস্টারশেফ বিশ্বের অন্যতম রান্না বিষয়ক টেলিভিশন রিয়েলিটি শো। বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশ মাস্টারশেফ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। মাস্টারশেফ প্রতিযোগিতায় বিশ্বে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে তালিকার শীর্ষে রয়েছে 'মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া'।
সম্প্রতি ‘মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া’য় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিশোয়ার চৌধুরীর কয়েক পদের রান্নার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। লাউ চিংড়ি, বেগুন ভর্তা, খিচুড়ি, আমের টক, খাসির রেজালা, ফুচকা, চটপটি, সমুচার রেসিপি দিয়ে সবাইকে অবাক করে দেন কিশোয়ার।
কিশোয়ার চৌধুরী বর্তমানে রান্নাবিষয়ক জনপ্রিয় টেলিভিশন রিয়েলিটি শো মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ তিনে জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার খেতাব জিতবেন কি-না কয়েক দিনের মধ্যেই জানা যাবে।
কে এই কিশোয়ার চৌধুরী?
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের বাসিন্দা কিশোয়ার দীর্ঘদিন ধরে পেশায় ‘বিজনেস ডেভেলপার’ এবং পারিবারিক প্রিন্টিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বাবা কামরুল হোসেন চৌধুরী ভিক্টোরিয়ার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সমাজসেবক ও মুক্তিযোদ্ধা এবং মা লায়লা চৌধুরী।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা অস্ট্রেলিয়ায় হলেও তার পারিবারিক পরিবেশটা সব সময়ই ছিল বাঙালিয়ানা। তার বাবার বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরের আর মা কলকাতার বর্ধমানে। ১৯৮০ এর দশকে তারা বাবা-মা অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান।
কিশোয়ার মেলবোর্নের প্রসবিটারিয়ান লেডিজ কলেজে পড়াশোন করেছেন। তিনি মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য স্নাতক করেছেন। এরপরে তিনি গ্রাফিক ডিজাইনে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
আরও পড়ুন: করোনা মহামারি থেকে শিশুকে নিরাপদ রাখবেন কীভাবে?
কিশোয়ার বাংলাদেশি না ভারতীয় তা নিয়ে বিতর্ক হলেও তিনি ১০০ ভাগ বাঙালি, তবে অর্ধ ভারতীয় এবং অর্ধ বাংলাদেশি। তাই কোনও রাষ্ট্রই তাকে তার নিজের হিসাবে দাবি করতে পারে না। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই তার পরিবার রয়েছে।
রান্নার প্রতি ঝোঁক যেভাবে এলো
বিদেশে বসবাস করলেও নিজের দেশের ভাষা, সংস্কৃতি চর্চা সবকিছুই বজায় রেখেছেন কিশোয়ারের বাবা-মা। আর সেটাই নিজের সন্তানদেরও ধারণ করতে তারা সব সময় উৎসাহিত করেছেন।
শৈশব থেকেই কিশোয়ারকে রান্না করার পাশাপাশি রান্নার উপাদানগুলোর উত্স সম্পর্কে শেখানো হয়েছিল। পরিবারে হার্বস থেকে শুরু করে শাকসবজি মরিচ-লাউ সব কিছুই নিজেরা উৎপাদন করতো। ছোটবেলা থেকে তার বাবা-মা এসব কাজে তাকে সম্পৃক্ত করেছেন। কিশোয়ারের কখনও মনে হয়নি যে হঠাৎ করে তিনি রান্না শুরু করেছেন।
তার রান্নার অভ্যাস রয়েছে যা তিনি তার পরিবার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পান। তার বাবা মাছ ধরা পছন্দ করতেন এবং তিনি ছোটবেলায় তার সাথে মাছ ধরতে যেতেন। তার বাবা যখনই মাছ ধরে আনতেন তখন বাড়িতে রান্না করা ফ্রেশ মাছ দেখে তিনি বেড়ে ওঠেন। আসলে, পরিবেশটা সব সময় বাসার মধ্যেই ছিল।
ঠিক কোন বয়স থেকে রান্না শুরু করেছিলেন সেই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না দিতে পারলেও প্রথম স্মৃতিই তার রান্নাকে ঘিরেই। সেই স্মৃতি হলো, ৩-৪ বছর বয়সের কিশোয়ারকে পাশে নিয়ে তার মা কেক বানিয়েছেন।
শেশব থেকেই কিশোয়ার শাকসবজি কুটে দেয়া, পেঁয়াজ ছিলে দেয়া, মাছ কোটা, মুরগি কেটে দেয়ার ট্রেনিং পান। অনেক সময় কিশোয়ারে মা তাকে এবং তার বোনদের ওপর রান্নার দায়িত্ব দিতেন। তারা কখনও পাস্তা, কখনও নুডলস তৈরি করতেন।
আরও পড়ুন: কিভাবে আত্মবিশ্বাসের সাথে ইংরেজিতে বলা রপ্ত করবেন?
মোট কথা বাবা-মায়ের কাছ থেকেই রান্নার হাতেখড়ি কিশোয়ারের। যত ধরনের রান্নাই হোক না কেন, বাসায় এক বেলা বিশেষ করে রাতের খাবারের মেন্যু হতো সবসময় বাঙালি খাবারের মেন্যু। কিশোয়ার এভাবেই রান্না শিখেছেন এবং রান্নার প্রতি তার আগ্রহ বাড়িয়েছিলেন।
কিশোয়ার চৌধুরীর মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় যাত্রা
কিশোয়ারের মাস্টারশেফে অংশ নেয়ার চিন্তুা মাথায় আসে ২০২০ সালে সারা বিশ্বের মতো অস্ট্রেলিয়াতেও করোনাভাইরাস পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর।
একটা বিষয় বারবার মনে হচ্ছিল যে তার বাবা-মা যে রকম করে তাদের সংস্কৃতি, খাবার-দাবার সবকিছু তাদের ইনস্টল করেছেন, তিনি সেটা তার সন্তানদের মধ্যে করে দিতে পারবেন কি-না। তিনি নিশ্চিত যে দেশের বাইরে যেসব বাবা-মায়েরা থাকেন সবার মধ্যেই এই চিন্তাটা থাকে। এমন চিন্তা থেকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা বই লেখার পরিকল্পনা করেন কিশোয়ার।
তবে কিশোরের কখনোই মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় আবেদন করার ইচ্ছা ছিল না। এটি তার ছেলের স্বপ্ন ছিল এবং তিনি প্রায়শই তাকে বলতেন মাস্টারশেফে অংশ নিতে। কিশোয়ারের ছেলেও বেশ ভালো রান্না করতে পারেন।
তিনি তার ছেলেকে জুনিয়র মাস্টারশেফ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বলেছিলেন। কিন্তু ছেলে তাকে মাস্টারশেফের জন্য আবেদন করার পরামর্শ দেন। তখনই কিশোয়ার তার ছেলে এবং পরিবারের কাছে উদাহরণ তৈরির জন্য আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেন।
চার বছরের কন্যা সেরাফিনা এবং ১১ বছরের ছেলে মিকাইলের কথা ভেবে কিশোয়ারে চেষ্টা যেন আরও এগুতে থাকে। এছাড়া তার পরিবার এবং জীবনসঙ্গী এহতেশাম নেওয়াজ সব সময় তার পাশে ছিলেন।
যে চ্যালেঞ্জ ছিল
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশি খাবার উপস্থাপন করাটা কিশোয়ারের জন্য ছিল যেমন চ্যালেঞ্জের, তেমনি ছিল আনন্দেরও। তিনি সব সময় পরিবার এবং বাচ্চাদের জন্য রান্না করেছেন। কিন্তু সেই রান্না এ রকম একটা প্রতিযোগিতায় কতটা কাজে দেবে, তা নিয়ে একটা চিন্তা ছিল। তবে তার আত্মবিশ্বাস ও রান্নার দক্ষতা তাকে মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় শীর্ষ ২৪ থেকে এরই মধ্যে সেরা তিনজনের মধ্যে নিয়ে এসেছে।
আরও পড়ুন: কঠোর ডায়েটের স্বাস্থ্য ঝুঁকিসমূহ জেনে নিন
কিশোয়ার সব সময় চেয়েছেন ভিন্ন সব বাঙালি খাবারের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার মানুষের পরিচিতি ঘটাতে। বাঙালির রান্না নিয়ে তারা যথেষ্ট আগ্রহী ছিল, কী হবে কেমন হবে এসব প্রশ্ন তাদের ছিল। অস্ট্রেলিয়ানরা এটি পছন্দ করবে কিনা তা তার পক্ষে চ্যালেঞ্জ ছিল।
কিশোয়ার কেন বাংলাদেশি খাবার বেছে নিলেন?
অস্ট্রেলিয়া, লন্ডনসহ বিদেশের নানান জায়গায় প্রচুর বাংলাদেশি রেস্তোঁরা রয়েছে তবে সেই রেস্তোঁরাগুলোতে খুব বেশি বাঙালি খাবার পাওয়া যায় না। বেশিরভাগই হয় ভারতীয়। রেস্তোরাঁর মালিক বাংলাদেশি হলেও বাংলাদেশি খাবার সেভাবে দেখা যায় না। তার ইচ্ছা ছিল 'বাঙালি ফুড আইডেনটিটি' তুলে ধরা এবং এটিই তিনি মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় পূরণ করেছেন।
সর্বশেষ কথা
ইতোমধ্যে কিশোয়ার চৌধুরী মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার ফাইনাল রাউন্ডে পৌঁছেছেন। রবিবার মাস্টারশেফের শেষ প্রতিযোগিতায় তিনি শীর্ষ তিনে উঠেছেন। আগামী সোমবার ও মঙ্গলবার দুই দিনে দুটি পর্বের মধ্য দিয়ে পর্দা নামবে রান্নাবিষয়ক জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার এবারের আসরের। সেখানে কিশোয়ারের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন নারায়ণ ও ক্যাম্পবেল।