নগর জীবনের কোলাহল থেকে কিছুটা দূরে চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার খ্যাত মিরসরাই উপজেলা। ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে অবস্থিত সেই উপজেলার ছোট্ট একটি বাজারের নাম ঠাকুর দীঘি। বাজার ঘেঁষে সামান্য দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রায় এক কিলোমিটার ভিতরে পাহাড় ঘেঁষে মহামায়া লেকের অবস্থান।
যেই মহামায়া একসময় ছিল অভিশাপ সেই মহামায়া আজ এলাকাবাসীর জন্য আর্শীবাদ। কোন একসময় মহামায়া নিয়ে দ্বন্দ্বে কয়েক ইউনিয়ের কয়েকজন মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে যায়। সে অনেক আগের কথা। সেসবই এখন কেবল ইতিহাস। সুষ্ঠ পরিকল্পনা যে একটি এলাকার তথা জনপদের জীবনমান বদলে দিতে পারে তার এক অনন্য উদাহরণ প্রকৃতির অপরূপ সাজে সজ্জিত পাহাড় ও লেক পরিবেষ্টিত মহামায়া। মহামায়া আজ রুচিশীল ও ভ্রমণ পিপাসু মানুষের পছন্দের একটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মহাময়ার প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক দৃশ্য যে কোন ভ্রমণ পিপাসু মানুষকে নিয়ে যাবে তার স্বপ্নের জগতে।
প্রায় ১১ বর্গ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মহামায়া। লেকের পূর্ব দিক পাহাড় পরিবেষ্টিত। পাহাড় ঘেঁষে রয়েছে একটি মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক ঝর্ণা যা এখানে ঘুরতে আসা মানুষের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। আঁকাবাঁকা লেকের স্বচ্ছ সবুজ জলধারা দেখলে মনে হবে কোনো শিল্পীর সুনিপুণ হাতের কারুকাজ। লেকের পানিকে ধরে রাখার জন্য রয়েছে কৃত্রিম রাবার ড্যাম। যাতে পানির তীব্র স্রোত জনজীবনের কোনো ধরনের ক্ষতি করতে না পারে। দিনে দিনে মহামায়া হয়ে উঠছে আকর্ষণীয় ও জমজমাট পিকনিক স্পট। প্রতিদিন দেশের দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এখানে বেড়াতে আসে।
তাদেরই একজন ঢাকা থেকে আসা মাকসুদ-অহনা দম্পতি। মাস তিনেক আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবার। দুজন- দুজনকে বুঝার জন্য দেশের ভিতর সুন্দর ও দৃষ্টি-নন্দন পর্যটন অঞ্চল মনে মনে মাকসুদ খুঁজছিলেন। অফিস সহকর্মী সোহরাব তাদের চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অবস্থিত মহাময়ার সন্ধান দিলেন। কালবিলম্ব না করে নতুন দম্পতি মহামায়াতে চলে আসলেন। নতুন দম্পতি এখানকার প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করে ভীষণভাবে খুশি। তাদের সাথে আলাপে এসব তথ্য জানা যায়। সময় ও সুযোগ হলে তারা ভবিষ্যতে আবার এই মহামায়াতে ঘুরতে আসবেন বলে জানান।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে আবদুর রহমান এসেছেন স্বপরিবারে। ছেলে-মেয়ে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনি নিয়ে তিনি এখানে ঘুরতে এসেছেন।
এখানকার কথা জিজ্ঞেস করতে তিনি তৃপ্তির হাসি দিয়ে বললেন, মহামায়া যে এত সুন্দর এখানে না আসলে উপলব্ধি করতে পারতাম না।
আরও পড়ুন: মেঘের রাজ্য সাজেকে স্বপ্ন ছোঁয়ার একদিন
তিনি বলেন, মহামায়ায় এসে এখানকার মায়ায় পড়ে গেলাম।
মহামায়া লেকে ঘুরার জন্য রয়েছে ইঞ্জিনচালিত ছোট বড় অসংখ্য বোট। ছোট সাইজের বোট ঘণ্টায় ৮০০ টোকা থেকে ১ হাজার টাকা। ৮-১০জন লোক উঠা যাবে। বড় সাইজের ২০-২৫ জন লোকের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন বোট ঘন্টায় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত নিবে।
প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে এখানে ভিড় জমায়। বছরে দুই ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবের দিনগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। কোথাও তিল ধারনের জায়গা খালি থাকে না। এখানে বেড়াতে আসা লোকজনের কথা মাথায় রেখে কর্তৃপক্ষ মহামায়ার ভেতরে ও বাহিরে খাবার হোটেলের ব্যবস্থা রেখেছেন। এখানকার হোটেলগুলো পরিচ্ছন্ন। দাম তুলনামূলক কম। পিকনিকে ঘুরতে আসা মানুষের গাড়ি রাখার জন্য রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। টিকিট কেটে লেকের ভেতরে ঢুকতে হয়। শীতের পুরো সময়টাতে ভ্রমণ পিপাসু লোকদের ভীড় লেগেই থাকে। এক কথায় নিরিবিলি সময় কাটানোর জন্য মহামায়া হয়ে উঠছে আকর্ষণীয় স্থান।
মহামায়াতে রয়েছে একটি সেচ প্রকল্প। তিনটি ইউনিয়নের বিশাল জনগোষ্ঠী সেচ প্রকল্পের সুবিধা গ্রহণ করে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রঘু নাথ জানান, এখানকার লোকজন সেচ প্রকল্পের সুবিধা গ্রহণ করে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমি আবাদ করে থাকে। যেই মহামায়া একসময় মানুষের জন্য অভিশাপ ছিল, লেকে বাঁধ দেয়ার কারণে সেই মহামায়া আজ মানুষের জন্য আশীর্বাদে পরিণত হয়েছে।
সেচ প্রকল্পের সুবিধাভোগী ঘড়িয়াইশ গ্রামের জয়নাল জানান, আগে শুকনো মৌসুমে আমরা চাষাবাদ করতে পারতাম না। ড্যাম হওয়ার কারণে লেকের পানি ধরে রেখে আজ আমরা চাষাবাদ করতে পারছি। আগে বর্ষাকালে লেকের পানিতে বিশাল এলাকা তলিয়ে যেত কিন্তু ড্যাম হওয়ার কারণে এখন আর ওইসব এলাকা প্লাবিত হয় না।
স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান হাজী জসিম উদ্দিন জানান, মহামায়া ছিল গণমানুষের নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি মহোদয়ের স্বপ্নের প্রকল্প। আজ সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে চলছে।
৮নং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু সুফিয়ান বিপ্লব বলেন, মানুষের কথা মাথায় রেখে এখানে সকল নাগরিক সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ধীরে ধীরে এই সুবিধা আরও বৃদ্ধি করা হবে।
আরও পড়ুন: রাঙ্গামাটিতে পর্যটকদের ঢল
তিনি বলেন, এই মহামায়া ইজারা দিয়ে সরকার প্রতি বছর বিরাট অংকের রাজস্ব পেয়ে থাকে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে অবদান রাখে।
এক কথায় মহামায়া ভ্রমণের জন্য অপূর্ব স্থান। সরকার যদি এই মহামায়ার প্রতি সুনজর দেয় অথবা বেসরকারি কোনো উদ্যোক্তা এগিয়ে এলে মহামায়া হয়ে উঠবে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র যা দেশের অর্থনীতির গতি তরান্বিত করার ক্ষেত্রে বিশাল অবদান রাখবে।