রোহিঙ্গাদের ২০ সদস্যসহ ২৭ সদস্যের প্রতিনিধি দল শুক্রবার মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য পরিদর্শন শেষে সন্ধ্যা ৫টা ৫০ মিনিটের দিকে বাংলাদেশে ফিরেছেন।
প্রতিনিধি দল ফিরে আসার পর কক্সবাজারের টেকনাফ-মিয়ানমার ট্রানজিট ঘাটে ব্রিফিংয়ে দুই রোহিঙ্গা নেতা বক্তব্য দেন।
এরপর প্রতিনিধি দলের প্রধান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের কাছে বক্তব্য দেন।
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যার বাংলাদেশের কাছে একমাত্র সমাধান হচ্ছে প্রত্যাবাসন। সে নিরিখে মিয়ানমারের কাছে বাংলাদেশের প্রস্তাব ছিল- যারা প্রত্যাবাসিত হবে সে সকল রোহিঙ্গাদের যাতে তাদের অ্যারেঞ্জমেন্ট দেখানো হয়। সে নিরিখে আমরা এটির নাম দিয়েছিলাম ‘গো অ্যান্ড ভিজিট’।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিয়ানমার প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। আমরা ২০ জন রোহিঙ্গা নিয়ে মিয়ানমারের মংডুর আশেপাশে যেখানে তাদের জন্য যেসব অ্যারেঞ্জমেন্ট করা হয়েছে সেগুলো ঘুরে দেখার পর আজকে আমরা ফেরত আসলাম। প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের সদিচ্ছা দেখেছি। আমরা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চাই।’
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতির 'নীরব সাক্ষী' জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ: রাষ্ট্রদূত মুহিত
কমিশনার বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরাও ছিলেন। মূলত তাদের জন্যই এই আয়োজন। তারা প্রত্যাবাসিত হবে, তাদেরকে স্বচক্ষে তা দেখানো হয়েছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ব্রিফ করেছে, বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ফিরে দেখিয়েছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ এখানে আসবে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আরও কথা বলবে। সবকিছু করা হয়েছে তাদের কনফিডেন্স বৃদ্ধির জন্য, তাদের আশ্বস্ত করার জন্য।’
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল আসার পর প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। মংডু শহরে প্রচুর রোহিঙ্গা আছে। আমি যতটুকু তথ্য নিলাম সেখানে প্রায় ৮০ শতাংশ রোহিঙ্গা ব্যবসা করছে। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না, এমনটাই জানিয়েছে।’
শুক্রবার যে প্রতিনিধি দলটি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রস্তুতকৃত ১৫টি গ্রাম ও সেখানে নির্মিত অন্যান্য অবকাঠামোগুলো পরিদর্শনে গেছেন ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন মো. মিজানুর রহমান। তিনি ছাড়াও প্রতিনিধি দলে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার-২ (অতিরিক্ত সচিব) মোহা. খালিদ হোসেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব বিশ্বজিৎ দেবনাথসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন।
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গাদের জন্য আরও সমর্থন বাড়ান: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
২০ সদস্যের রোহিঙ্গা দলে তিনজন রোহিঙ্গা নারীও ছিলেন। ২৭ সদস্যের প্রতিনিধি দল মিয়ানমার রাখাইন রাজ্য পরিদর্শন শেষে বিকাল ৫ টা ৫০ মিনিটে টেকনাফ-মিয়ানমার ট্রানজিট জেটি ঘাটে পৌঁছান। এর আগে তারা একই দিন সকাল ১০টায় মিয়ানমারের উদ্দেশে টেকনাফ ছাড়েন।
প্রতিনিধি দলের রোহিঙ্গা সদস্য ও ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘অনেক বছর পর আমাদের দেশ মিয়ানমার দেখার সুযোগ হয়েছে। আমরা মিয়ানমার গেছি, আমাদেরকে ক্যাম্পগুলো দেখিয়েছে। আমরা জানতে চাইলাম, ক্যাম্প কেন, কার জন্য? তারা বলেছে, আপনাদের জন্য। আমরা বলেছি, আমরা যদি সিকিউরিটি না পাই, নাগরিকত্ব কার্ড না পাই তাহলে কি হবে। তখন তারা জানিয়েছে, এনভিসি কার্ড নিতে হবে। আমরা বলেছি এনভিসি কার্ড অতিথিদের জন্য, আমরা এনভিসি কার্ড নেওয়া মানে আমরাও অতিথি বা মেহমানের মতো। এক্ষেত্রে আমরা কোনো জমির মালিক হতে পারব না, নাগরিকত্ব পাব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দাবি করেছি, আমাদের গ্রামে আমাদের ভিটা-জমি ফিরিয়ে দিতে, তখন আমরা নিজেদের টাকায় ঘর তৈরি করে থাকব। আমাদের শেষ কথা হয়েছে যে আমাদের নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব, ভিটে-মাটি না দিলে আমরা মিয়ানমার ফিরে যাব না।’
প্রতিনিধি দলের সদস্য ও ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা সুফিয়ান বলেন, ‘সেখানে গিয়ে আমরা আমাদের দাবি দিয়েছি। আমাদের নাগরিকত্ব দাবি করেছি, ভিটামাটি দাবি করেছি, সেগুলো ফেরত দিলে আমরা যাব, সেটা জানিয়ে এসেছি। আমাদের গ্রামের জায়গাগুলো ঘুরে দেখেছি, কিন্তু সেখানে যাওয়ার মতো এখনও সুযোগ দেখছি না দাবি আদায়ের আগে। আমরা এখানে (বাংলাদেশে) থেকেই ওই দাবি আদায় করে তারপর মিয়ানমার ফিরতে চাই।’
উল্লেখ্য, এর আগে বাংলাদেশ থেকে আট লাখের বেশি রোহিঙ্গার একটি তালিকা পাঠানো হয় মিয়ানমারের কাছে। ওই তালিকা থেকে ফেরত নিতে পাইলট প্রকল্প হিসেবে প্রথম দফায় প্রায় এক হাজার ১৪০ জনকে নির্ধারণ করে দেশটি। সেখান থেকে ৪২৯ জনের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিল মিয়ানমার। পরে গত ১৫ মার্চ ১৯ সদস্যদের একটি টেকনিক্যাল টিম বাংলাদেশের টেকনাফে এসে ১৭৭ রোহিঙ্গা পরিবারের ৪৮০ জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মিয়ানমারে ফিরে যায়।
আরও পড়ুন: প্রত্যাবাসন ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণে রাখাইনের উদ্দেশে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দল