বিশেষ-সংবাদ
একটা বাজলেই পড়ে ছুটির ঘণ্টা, শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের অসন্তোষ
ঘড়ির কাটায় দুপুর ২টা বেজে ৩৩ মিনিট। এমন সময় বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে সুনসান নীরবতা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কেউ সেখানে নেই। শ্রেণিকক্ষে ঝুলছে তালা। শিক্ষকদের কক্ষ খালি। কেবল পরিছন্নতাকর্মী পতাকা নামাচ্ছেন।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের হাসিমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রবিবার (৪ মে) গিয়ে এমন চিত্রের দেখা মেলে। অথচ বিদ্যালয় ছুটি হওয়ার কথা বিকাল ৪টায়। অবস্থিত।
জানতে চাইলে পরিছন্নতাকর্মী অলোক বিশ্বাস বলেন, ‘আজ (রবিবার) ২টার দিকে প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয় ছুটি দিয়ে চলে গেছেন। এসএসসি পরীক্ষার কারণে প্রতিদিন ১টার মধ্যেই স্কুল ছুটি হয়ে যায়।’
অফিস সহায়ক আশরাফুল আলম বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ে ৩৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে। তার মধ্যে আজ দুই শতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। তবে ছুটির বিষয়ে হেড স্যারের (প্রধান শিক্ষক) সঙ্গে কথা বলেন।’
শিক্ষার্থী ও অভিভাবক থেকে শুরু করে এলাকাবাসীর অভিযোগ, অন্যান্য বিদ্যালয় প্রতিদিন ১০টায় শুরু হয়ে চলে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। কিন্তু ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত হাসিমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস হয় না। শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে এসে ক্লাসে না নিয়ে অফিসে বসে থাকেন। দুপুর একটা বাজলেই ছুটি দিয়ে চলে যান যে যার মতো। এটি এ বিদ্যালয়ের নিত্যদিনের চিত্র।
অভিযোগের সত্যতা জানতে চাইলে নবম শ্রেণির এক ছাত্রী বলে, ‘আজকে (রবিবার) শুধু ইংরেজি ক্লাসের পর ১টার দিকে স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। প্রতিদিনই এমন ঘটনা ঘটে। ৪টা পর্যন্ত স্কুল চললে ভাল হয়।’
‘সামনে পরীক্ষা, তবুও অন্যান্য ক্লাস ঠিকমতো হয় না। পড়াশোনা নিয়ে তাই আমার চিন্তা হয়।’
অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্র বলে, ‘প্রতিদিনই ১২ টা থেকে ১ টার মধ্যে স্কুল ছুটি হয়ে যায়। আবার অনেকদিন সাড়ে ১০ টার দিকে নাম ডেকেই ছুটি দিয়ে দেয়।’
অভিভাবক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমার তিন ছেলে এই স্কুলে পড়েছে। ছোট ছেলে এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। সে প্রতিদিন সকাল ১০টায় স্কুলে গেলেও দুপুর ১টার মধ্যে বাড়ি চলে যায়। জানতে চাইলে সে বলে, এই স্কুলে আর আগের মতো পড়া হয় না।’
তিনি বলেন, ‘শিক্ষকরা সবাই দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। (বর্তমান) সব শিক্ষককে সাসপেন্ড করে নতুন শিক্ষক আনা দরকার।’
বিদ্যালয় থেকে প্রায় ৩০ গজ দুরে ব্যবসায়ী আব্দুর রহিমের দোকান। তার মেয়ে বিথি অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আব্দুর রহিম বলেন একই কথা।
‘প্রতিদিন একটা বাজলেই ছুটি হয়ে যায় স্কুল। এসব দেখার কেউ নাই। বিদ্যালয়টি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।’
আরও পড়ুন: বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শাখা স্থাপনের অনুমতি দিতে গাইডলাইন হচ্ছে
২৩৫ দিন আগে
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শাখা স্থাপনের অনুমতি দিতে গাইডলাইন হচ্ছে
দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শাখা ক্যাম্পাস স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে গাইডলাইন পলিসি তৈরির জন্য কাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এ বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট ও কঠোর নীতিমালা প্রণয়নে কাজ করছে ইউজিসির হাই-পাওয়ার কমিটি।
নীতিমালা চূড়ান্ত হওয়ার পর মানসম্পন্ন ও স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবেদন বিবেচনা করে অনুমোদন দেওয়া হবে। তবে উচ্চশিক্ষার মান রক্ষা ও বাণিজ্যিকীকরণ রোধে প্রয়োজনীয় সতর্কতাও অবলম্বন করা হবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে থাকা ইউজিসি সদস্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ইউএনবিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বিদেশি (বিশ্ববিদ্যালয়ের) ক্যাম্পাস এলে বাংলাদেশের কতটুকু ভালো হবে—সব দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে একটি গাইডলাইন পলিসি তৈরির জন্য হাই-পাওয়ার কমিটি কাজ করছে। কমিটিতে প্রফেসররা আছেন। কমিটির প্রধান বুয়েট ভিসি। কমিটি পলিসি তৈরি করছে। পলিসি তৈরি হলে বিদেশি (বিশ্ববিদ্যালয়ের) ক্যাম্পাস অনুমোদনের বিষয়টি নিয়ে বলা যাবে।’
‘এই কমিটি সাব-কমিটি। মেইন কমিটির প্রধান আমি। সেখানে ঢাবি, বুয়েটে, নর্থ সাউথ ও জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়েসরদের নিয়ে একটি হাই-পাওয়ার কমিটি করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিদেশি ক্যাম্পাসের অনুমতি দিতে আমরা পজিটিভ। তবে আমরা দেখছি, শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হয় কি না। এছাড়া আমাদের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী ধরনের প্রেসারে পড়বে, সেটাও দেখতে হবে।’
আরও পড়ুন: দুর্নীতির অভিযোগ: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ব্যবস্থা নিতে পারে ইউজিসি
ইউজিসির এই সদস্য বলেন, ‘প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় একটি অবস্থানে চলে গেছে। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান, তাদের বেতনকাঠামো, সুযোগ-সুবিধা, গবেষণার সুযোগ খুব যে ভালো, তা দেখছি না। সবদিক থেকে বিবেচনায় নিয়ে বিদেশি ভার্সিটি এলে পাবলিক ও প্রাইভেট ভার্সিটিগুলো আরও শিক্ষক সংকটে পড়বে কি না তা দেখতে হবে। তাছাড়া এই পদক্ষেপ দেশের জন্য লাভজনক কি না, তা দেখে সেইভাবে পলিসি তৈরি করা হবে।’
ইউজিসি থেকে জানা যায়, ইউজিসি বর্তমানে ২০১৪ সালের ‘বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা বা স্টাডি সেন্টার পরিচালনা বিধিমালা’ সংশোধনের কাজ করছে। এই বিধিমালায় কিছু অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা থাকায় তারা এটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন নীতিমালায় শুধুমাত্র শাখা ক্যাম্পাস স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে, স্টাডি সেন্টার নয়। শাখা ক্যাম্পাস স্থাপনের জন্য নির্দিষ্ট শর্তাবলী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেমন: ২৫ হাজার বর্গফুট জায়গা, পূর্ণকালীন শিক্ষক নিয়োগ, ৫ কোটি টাকা ফিক্সড ডিপোজিট, অনুমোদনের জন্য ১০ লাখ টাকা ফি। সর্বোপরি, উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত এবং বাণিজ্যিকীকরণ রোধ করাই এই নীতিমালার লক্ষ্য।
বাংলাদেশে প্রথম বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শাখা ক্যাম্পাস খুলতে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়েছে মালয়েশিয়ার ইউসিএসসি ইউনিভার্সিটি। ইতোমধ্যে তারা ঢাকায় কার্যক্রম শুরু করেছে।
২৩৬ দিন আগে
বৈশাখী মেঘের ডাকে মাটি ফুঁড়ে ‘মে বলের’ হাতছানি
মে বল। সারা বছর ভূ-গর্ভে ঘুমিয়ে থাকার পর গ্রীষ্মের শুরুতে কালবৈশাখীর মেঘের ডাকে ঘুম ভাঙে। এরপর শরৎ-হেমন্ত-শীতে ইস্পাতকঠিন ভূ-তল ফুঁড়ে মাথা তোলে মে বল। তার কয়েকদিনের মধ্যেই ফুল ফুটিয়ে তপ্ত গ্রীষ্মকে রাঙিয়ে দেয় সে।
‘মে বল’ নামটি শুনতে একটু অন্যরকম। চট করে অনেকে হয়তো ধরতেই পারবেন না যে, নামটি আসলে একটি ফুলের। ফুলটির স্বভাবের কারণেই ব্যতিক্রম এই নামকরণ। ইংরেজি সনের কেবল মে মাসেই দেখা মেলে বিশেষ এই ফুলের। বলের আকৃতির এই ফুলকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘বল ফুল’ বলেও অভিহিত করে থাকেন অনেকে।
মে মাসে এই ফুল ফোটে বলে সারা বিশ্বে ‘মে ফুল’ নামেও জনপ্রিয় এটি। গোলাকার দেখতে হওয়ায় ফুলটিকে বল লিলিও বলা হয়। আবার শুধু লিলি, পাউডার পাফ লিলি, আফ্রিকান বাড লিলি নামেও পরিচিত এই ফুল। তবে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের দেওয়া নাম হলো ‘মে বল’। বছরের পর বছর ধরে একই নিয়মে মে মাসেই হাসিমুখে মাথা তোলে এই ফুল।
বিদেশি ফুল হলেও অনেক আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মে বলের দেখা মেলে। তেমনই ঠাকুরগাঁওয়ের নারগুন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুল জলিলের বাড়িতে দেখা দিয়েছে মে বল।
আব্দুল জলিল জানান, গত ১৬ বছর ধরে গ্রীষ্মে প্রথম বৃষ্টির পরই মাটি ভেদ করে বের হয় মে বলের কাণ্ড। এর কিছুদিন পর দেখা যায় ফুল। একে প্রতিটি কন্দ থেকে গাছ বেরিয়ে গোলাপি রঙের ফুলে ছেয়ে যায় বাগান।
আরও পড়ুন: ঝিনাইদহে যে গ্রামে ৬ দশক ধরে তৈরি হয়ে আসছে আখের গুড়
২৩৭ দিন আগে
ঝিনাইদহে যে গ্রামে ৬ দশক ধরে তৈরি হয়ে আসছে আখের গুড়
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার খন্দকবাড়িয়া গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে বিরাট কর্মযজ্ঞের। চলছে গুড় তৈরি।
গুড় তৈরির জন্য সড়কের পাশেই স্তুপ করে রাখা হয়েছে আখ। পাশেই যন্ত্রের সাহায্যে আখ থেকে বের করা হচ্ছে রস। এরপর সেই রস চুলার পাশে কাপড়ের মাধ্যমে ছেঁকে চাড়িতে রাখা হচ্ছে।
একদিকে পাশাপাশি জ্বলছে ছয়টি চুলা। চুলার ওপর টগবগ করে ফুটছে আখের রস। রস লাল হয়ে এলে এক চুলা থেকে চলে যাচ্ছে আরেক চুলায়। জ্বালানো শেষে তা টিনের পাত্রে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নির্দিষ্ট স্থানে। এরপর সেখানে রাখা মাটির পাত্রে ঢেলে তা ঠান্ডা করা হচ্ছে। ঠান্ডা হয়ে গেলেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে সুস্বাদু আখের গুড়।
এ চিত্র শৈলকুপার অজপাড়াগাঁয়ের এক কারখানার। প্রায় ৬০ বছর ধরে এই আখের গুড় তৈরির কারাখানায় তৈরি হয়ে আসছে ভেজালমুক্ত গুড়। খন্দকবাড়িয়া গ্রামের দুই ভাই রেজাউল ইসলাম ও মিজানুর রহমান কারখানাটির বর্তমান মালিক। তারা নিজেরাই গুড় তৈরি করেন।
আগে জেলার অনেক বাড়িতে দেখা মিলত এই গুড় তৈরির কারখানার। কিন্তু এখন তা বিলুপ্তির পথে। তবে বাবার হাতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় স্মৃতি হিসেবে এই কারখানাটি আকড়ে ধরে রেখেছেন দুই সহোদর।
আরও পড়ুন: চুয়াডাঙ্গায় এতিম শিশুদের নিয়ে পিঠা উৎসব
এই কারখানাটির গুড় পিঠা-পায়েস, সেমাই-সুজিসহ স্থানীয়দের মিষ্টিজাত খাদ্যদ্রব্য তৈরির চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্যান্য জেলাতেও যায়।
আখচাষিরা বলছেন, আখের দাম কম হওয়ায় তা বাইরে বিক্রি না করে এই কারখানায় এনে গুড় তৈরি করেন তারা। তাতে নিজেদের চাহিদা মিটিয়েও কিছুটা বিক্রিও করতে পারেন।
কারখানার মালিক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমার বাবা আখের চাষ করতেন। সে সময় অনেকে নিজ নিজ বাড়িতে রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করে বিক্রি করতেন। ১৯৬৫ সালে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে মোবারকগঞ্জ চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের বাড়ি থেকে ওই চিনিকলের দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার। তার দু-তিন বছর আগেই কারখানা তৈরি করে আমার বাবা বাড়িতে গুড় তৈরি শুরু করেন।’
২৩৮ দিন আগে
দুর্নীতির অভিযোগ: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ব্যবস্থা নিতে পারে ইউজিসি
দেশের ২০ থেকে ৩০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টির (বিওটি) বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও তহবিল তছরুপের মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটি ভেঙে প্রশাসক বসানো হতে পারে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে থাকা ইউজিসি সদস্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ইউএনবিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটির বিরুদ্ধে যদি গুরুতর অভিযোগ থাকলে তাদের সঙ্গে কথা বলে সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজনে প্রশাসক বসানো হবে। প্রশাসক বসানো ছাড়াও যদি আরও বেশি কিছু করা যায় বা সরকারের আরও বেটার বা ইনোভেটিভ আইডিয়া থাকে, প্রয়োজনে সেটিও করা হবে।’
তবে যায় করা হোক না কেন, তা নিয়মতান্ত্রিকভাবেই করা হবে বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুন: সাত কলেজ নিয়ে যৌক্তিক সমাধান আসবে: ইউজিসি চেয়ারম্যান
এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে কী ধরনের অভিযোগ রয়েছে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিওটির বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ অর্থ পাচার। এছাড়া তহবিল তছরুপসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে।’
বিওটির এসব অনিয়ম নিয়ে কীভাবে তথ্য পেলেন?—উত্তরে এই ইউজিসি সদস্য বলেন, ‘দুদক, আমাদের নিজস্ব তদন্ত, সংবাদপত্রসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্নভাবে তথ্য এসেছে আমাদের কাছে। এসব বিষয়গুলো আমলে নিয়ে (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে) একটি সুশৃঙ্খল প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেওয়ার বিষয়ে কাজ হচ্ছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়মের মধ্যে আনার জন্য যা যা করা দরকার, তা-ই করা হবে।’
কতগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টির (বিওটি) বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২০ থেকে ৩০টির মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটির বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম তদন্তে কমিটিও করে দিয়েছি; সেটি সাধীন ভাবে কাজ করছে। কাজ শেষ করে রিপোর্ট দিলে সিদ্ধান্তের জন্য তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অভিযুক্ত প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্ট চলেও এসেছে। যেমন: সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি; তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখানে প্রশাসক নিয়োগের জন্য আমার সুপারিশ করে প্রতিবেদনটি সরকারকে পাঠিয়েছি, সরকার সিদ্ধান্ত দিলেই প্রশাসক বসানো হবে।’
তদন্ত কমিটিতে কারা কারা আছে, এ ব্যাপারে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অধিকাংশ কমিটির কনভেনার (আহ্বায়ক) বাইরে থেকে নেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইউজিসি থেকে সদস্য নেওয়া হয়েছে আবার বাইরে থেকেও নেওয়া হয়েছে। তবে প্রতিটি কমিটিতে আমাদের সংশ্লিষ্ট শাখার ডিলিং অফিসারকে (দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) রাখা হয়েছে, যিনি সেই ভার্সিটির দায়িত্ব পালন করছেন।’
তদন্ত কমিটির কনভেনার হিসেবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাবেক বিচারকদের রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুন: ঢাকায় কেন এত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
ইউজিসি সুত্রে জানা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। প্রতি বছর শিক্ষার্থী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের সঙ্গে দুর্নীতিও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও হিসাব-নিকাশ ঠিকঠাক নেই। আইনের তোয়াক্কা না করে নানা কৌশলে বিপুল অর্থ লুটছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের (বিওটি) সদস্যরা।
নাম না প্রকাশের শর্তে ইউজিসির এক কর্মকর্তা ইউএনবিকে বলেন, ‘গত সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিওটি গঠন করা হয়। তারা ব্যবসা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিক। তবে তারা আমাদের দায়িত্ব দিয়েছে। কমিশনের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে পূর্ণ কমিশনের সভায় অভিযোগ ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
২৩৮ দিন আগে
মেধা পাচার: তরুণদের জীবনের লক্ষ্যই যখন দেশত্যাগ
জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেস্কো) সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, উন্নত জীবন ও উচ্চশিক্ষার আশায় গত দেড় দশকে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের দেশত্যাগের পরিমাণ বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে সিংহভাগ শিক্ষার্থীর জীবনের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে দেশত্যাগ।
বিশ্বব্যাংকের জরিপ অনুযায়ী, বিগত এক দশকে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে চাকরির বাজারে প্রবেশে হিমশিম খান স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করা শিক্ষার্থীরা। এতে করে তাদের মধ্যে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর প্রবণতা আরও উর্ধ্বমুখী হয়েছে।
রাজধানীর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আয়াজ বিন ফারুক। স্নাতক শেষ করতে আয়াজের বাকি দুই সেমিস্টার। কিন্তু স্নাতক শেষ করে কোন চাকরি করবেন—এ ব্যাপারে এখনও কোনোকিছু ঠিক করতে পারছেন না তিনি।
নিজের হতাশার কথা জানিয়ে আয়াজ বলেন, ‘বাংলাদেশের ছাত্রদের হাতে মূলত তিনটি অপশন। পাস করে হয় বিসিএসের জন্য পড়াশোনা, না হলে ব্যাংক পরীক্ষার জন্য জোরেশোরে প্রস্তুতি নেওয়া; আর এসব কিছু না হলে আইএলটিএস দিয়ে বিদেশ যাওয়া।’
আরও পড়ুন: জাপানের এনইএফ বৃত্তি পেলেন বাকৃবির ১০ মেধাবী শিক্ষার্থী
বাংলাদেশে নবম গ্রেডের প্রথম শ্রেণির চাকরি হিসেবে বিসিএস বিবেচ্য। চাকরির নিশ্চয়তা ও সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় অনেক শিক্ষার্থী বিসিএসকে রাখেন পছন্দের তালিকার শীর্ষে। কিন্তু পদের হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতিবছর যতজন এই পরীক্ষার জন্য আবেদন করেন, তার তুলনায় মোট পদের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য।
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ ৪৬তম বিসিএসে মোট ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০৮ জন আবেদন করেছেন, যেখানে শূন্য পদের সংখ্যা মাত্র ৩ হাজার ১৪০।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী সফিউর রহমান বলেন, ‘সকাল থেকে সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে সবাই লাইন ধরে বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে যায়। প্রথম বর্ষ থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে, এমনও অনেকে আছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিসিএস সোনার হরিণ, যার পেছনে না দৌড়ে বিদেশে পাড়ি জমানোই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত বড়সংখ্যক শিক্ষার্থীর কাছে।’
শুধু বিসিএস নয়, সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেও অনেক শিক্ষার্থী বেছে নিয়েছেন বিদেশকে। সম্প্রতি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্রেডিট ট্রান্সফার করে পড়াশোনার জন্য যুক্তরাজ্যের লন্ডন পাড়ি জমিয়েছেন ফাতেহা জাহান ইকু।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখনও দেশের নারীরা কর্মক্ষেত্রে সমানাধিকার পায় না। দেশের সামাজিক অবস্থাও নারীদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে প্রস্তুত না। এক্ষেত্রে উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত মেয়েদের বেশিরভাগরই পছন্দ বিদেশ পাড়ি জমানো।’
আরও পড়ুন: মেধাভিত্তিক ভর্তির দাবিতে মিরপুর সড়ক অবরোধ
মূলত বিদেশে নারীর নিরাপত্তা এবং সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্যই দেশের নারী শিক্ষার্থীদের কাছে মুখ্য বলে জানান ইকু।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) হিসাবে, প্রতিবছর ১০ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক পাস করে। এ বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের জন্য নেই কোনো চাকরির বাজার কিংবা সুষ্ঠু পরিকল্পনা।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টনের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম। রিভার্স ব্রেইন বিডি এবং মেধা পাচার রোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিদ্যমান চাকরির সঙ্গে প্রতি বছর পাস করে বের হওয়া শিক্ষার্থীর অনুপাত বিবেচনা করলেই বোঝা যায়, কেন বড় সংখ্যক শিক্ষার্থী দেশ ছাড়তে চায়।’
তার মতে, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী দেশের ভেতরে চাকরি পাচ্ছে না। যারা বিদেশে পড়াশোনা করতে গেছেন তারা দেখছেন, ফিরে এলে ভালো চাকরি পাওয়া যাবে—এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। যারা দেশে আছেন, তাদের অবস্থা দেখে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠু পরিকল্পনার বড় অভাবের কারণে চাইলেই রিভার্স ব্রেইন বিডি ক্যাম্পেইন বাস্তবায়ন সম্ভব না বলে মনে করেন এ শিক্ষক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট বেকারের ১২ শতাংশ স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর পাস। যাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তাদের মধ্যে বরং বেকারত্বের হার কম। অর্থাৎ যারা উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন তাদের জন্য দেশে সন্তোষজনক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না বলেই স্পষ্ট করছে পরিসংখ্যান।
অন্যদিকে দেশে যারা চাকরি করছেন তারা নিজেদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে খুশি নন। এছাড়া দেশের অফিস সংস্কৃতি নিয়েও মনঃক্ষুণ্ন তরুণরা। এমনই এক করপোরেট প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী ফয়সাল রিমন বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশে যখন নতুন নতুন ওয়ার্ক কালচার প্রবর্তন হচ্ছে, সেখানে এখনও মান্ধাতার আমলের নিয়মে চলছে বাংলাদেশ। দেশের বেশিরভাগ অফিসে শ্রম আইনের ধার ধারা হয় না। নিজেদের কাঠামো অনুযায়ী বেতন ও সুযোগ-সুবিধা ঠিক করে কোম্পানিগুলো।’
‘একটা সময় ছিল তরুণরা চাকরিক্ষেত্রে তাদের অধিকার নিয়ে সচেতন ছিল না। বেতন-ভাতার ব্যাপারে ছিল না সম্যক ধারণা। কিন্তু বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে তরুণ চাকরিজীবীরা নিজেদের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করার সুযোগ পাচ্ছে, পারছে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে। সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকায় তারা দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে,’ অভিমত রিমনের।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলের ছাত্র শাফায়াত আল রাজি বলেন, ‘বাংলাদেশে একজন শিক্ষার্থীর চাকরি জীবন শুরু হতে হতে বয়স ২৫ পেরিয়ে যায়। এরপর অনেকের ২-৫ বছর শুধু চাকরির জন্য প্রস্তুতিই নিতে হয়। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে ১৬-১৮ বছরের মধ্যে একটি ছেলে চাকরিতে প্রবেশ করে এবং আয় করতে শুরু করে।’
নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে শাফায়াত বলেন, ‘বাংলাদেশে থাকতে আমার পড়াশোনার খরচ আমার মা-বাবাকে দিতে হতো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর পড়াশোনার পাশাপাশি আমি পার্ট টাইম চাকরি করতে পারছি। আমার বার্ষিক বেতন গড়ে ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার ডলার। নিজের খরচ চালিয়ে দেশেও টাকা পাঠাতে পারছি। এটি বাংলাদেশে থাকলে সম্ভব হতো না।’
ইউনেস্কোর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ৫২ হাজার ৮০০ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছে। দেড় দশক আগে ২০০৮ সালে এই সংখ্যা ছিল মোটে ১৬ হাজার ৮০৯।
ইন্ট্যারন্যাশনাল এডুকেশনাল এক্সচেঞ্জের ওপেন ডোর রিপোর্ট-২০২৪ অনুযায়ী, গত বছর শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ১৭ হাজার শিক্ষার্থী পাড়ি জমিয়েছে, যা যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ। গত অর্থবছরের তুলনায় এ সংখ্যা ২৬ শতাংশ পর্যন্ত বেশি।
আরও পড়ুন: বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার কাজ চলছে: গভর্নর
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের ফেলো গবেষক নুসরাত জাহান চৌধুরী বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে প্রচুর বাংলাদেশি শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে আসছে, যাদের বড় সংখ্যকই আর দেশে ফিরবেন না। অনেকগুলো কারণের মধ্যে জীবনযাত্রার মান বা সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তার বাইরেও একটি বড় কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে বিদেশের উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান আর দক্ষতার মূল্যায়নের অভাব আছে, পাশাপাশি নেই পর্যাপ্ত কাজের সুযোগ।’
তিনি বলেন, ‘অনেকের ক্ষেত্রে এমন হয়েছে, উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরত গেলেও তাকে প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয় না, যার জন্য তার নতুন দক্ষতা কাজে লাগানোর সুযোগ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। উচ্চশিক্ষা অর্জনের পরে দেশে ফিরে পূর্বের প্রতিষ্ঠানে যোগদান করলে নতুন দক্ষতা অনুযায়ী তাকে উপযুক্ত পারিতোষিক না দেওয়ার নজিরও বহু আছে।’
‘এ ছাড়া বাংলাদেশের ওয়ার্ক কালচার অনুযায়ী, একই প্রতিষ্ঠানে বেশিদিন ধরে কর্মরত ব্যক্তিরা তুলনামুলকভাবে প্রমোশন বা আপগ্রেডেশনে এগিয়ে থাকেন। সেখানে দক্ষতা বা অভিজ্ঞতার থেকেও মুখ্য হয়ে ওঠে কর্মরত ব্যক্তির বয়স। কখনও কখনও প্রতিষ্ঠান বা দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে হয় চাকরিজীবীদের, যেটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে হরহামেশা দেখা যায়। এছাড়া স্বাধীনভাবে গবেষণা বা মত প্রকাশ করার ফলে নানারকম হয়রানিতেও পড়তে হয়, যদি তা ক্ষমতাসীন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়।’
এসব বিবেচনায় বিদেশে পড়াশোনা শেষ করে অনেক শিক্ষার্থী দেশে ফেরা সমীচীন মনে করেন না বলে জানান এই গবেষক।
জার্মানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড করপোরেশনের (ডি+সি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বহু বছর ধরে অর্থনৈতিক উন্নয়নে রেমিট্যান্সের ওপর ভরসা করে আসছে। এতে করে ১৯৮০ সালের দিক থেকে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোয় বাংলাদেশের সরকারের আগ্রহ ছিল সর্বাগ্রে। কিন্তু বর্তমান অভিবাসন প্রক্রিয়া আলাদা। এখন যারা দেশ ছাড়ছেন তাদের গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং পশ্চিমে। যারা মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক হিসেবে গিয়েছেন তারা একসময় দেশে ফিরে এসেছেন। এখন যারা উন্নত জীবনের আশায় পশ্চিমা দেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছেন, তাদের ফিরে আসার মনোভাব নেই।
যারা ফিরে না আসার সংকল্প নিয়েই দেশ ছাড়ছেন তাদের ব্যাপারে ভাবতে হবে, তাদের দেশে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। রেমিট্যান্সকে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড না বানিয়ে মেধার ওপর গুরুত্বারোপ এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে মেধার সর্বোচ্চ উপযোগিতা আদায়ের প্রস্তাব দেওয়া হয় প্রতিবেদনে।
২৪০ দিন আগে
মে দিবসের ১৩৫ বছর পরও আট শ্রমঘণ্টা কতটা যৌক্তিক?
শ্রমঘণ্টা কমানোর দাবিতে ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে হাজারো শ্রমিক রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। তাদের ‘আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম ও আট ঘণ্টা নিজের জন্য’—দাবিতে করা রক্তক্ষয়ী আন্দোলন পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে ওঠে। সেই আন্দোলনের স্বীকৃতি দিয়েই ১৯৯০ সাল থেকে প্রতি বছর ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
শুধু তা-ই নয়, বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের সময়ের মর্যাদা দিতে আট কর্মঘণ্টাকেই আদর্শ হিসেবে ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে তাবৎ কর্মযজ্ঞ। তবে অতীতের তুলনায় প্রযুক্তি, উৎপাদনশীলতা ও কাজের ধরনে অভাবনীয় পরিবর্তন এলেও আজও বহু দেশে এই আট কর্মঘণ্টা সময়-কাঠামো অপরিবর্তিত থেকে গেছে। বর্তমান বিশ্বে যেখানে দূরবর্তী কাজ (রিমোট ওয়ার্ক), হাইব্রিড ওয়ার্ড মডেল, অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তির প্রভাব ক্রমবর্ধমান, সেখানে প্রশ্ন ওঠে— আট ঘণ্টার শ্রমঘণ্টা এখন কতটা যৌক্তিক?
ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট
১৮ শ’ শতকের শেষের দিকে শিল্প বিপ্লবের যুগে নতুন সৃষ্টিশীলতায় মেতে ওঠেন উৎপাদকরা। তাদের চিন্তা-চেতনায় তখন শুধু কাজ আর কাজ। ফলে দিনরাত এক করে পণ্য উৎপাদন ও হিসাবের খাতায় অঙ্কের সংখ্যা বাড়ানোয় বিভোর হয়ে যান শিল্পপতিরা। আলোস্বরূপ লাভের সবটুকু তারা পকেটে পুরে নিজেদের জীবন প্রাচুর্যে ভরিয়ে তুললেও পাদপ্রদীপের অন্ধকারের মতোই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে শিল্প-কারখানাগুলোর চালিকাশক্তি—শ্রমিকদের জীবন।
সেই সময় শ্রমিকদের জীবনের মূ্ল্যায়ন হতো না বললেই চলে। অনেক সময় দিনে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টাও কাজ করতে হতো তাদের। ফলে একপর্যায়ে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমঘণ্টা সীমিত করার দাবি ওঠে।
ব্রিটেনে ১৮১৭ সালে সমাজ সংস্কারক রবার্ট ওয়েন প্রথম ‘আট ঘণ্টা শ্রম, আট ঘণ্টা বিনোদন ও আট ঘণ্টা বিশ্রাম’ স্লোগানটি দেন। তার দীর্ঘ সময় পর ১৮৮৬ সালে শিকাগোর হে মার্কেটের ঘটনার মধ্য দিয়ে এই দাবিটি সর্বজনীন রূপ নেয়।
এরপর ১৮৮৯ সালে প্যারিসে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেস নামে সমাজতান্ত্রিক ও শ্রমিক সংগঠনের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে হে মার্কেট কাণ্ডে নিহতদের স্মরণে এবং আট ঘণ্টার কর্মদিবসের দাবিকে এগিয়ে নিতে প্রতি বছরের ১ মে-কে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১৮৯০ সালের ১ মে প্রথমবার ইউরোপ, আমেরিকা ও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের শ্রমিকরা এই দিনটি পালন করেন। এরপর থেকে মে দিবস শ্রমিকদের ঐক্য, সংগ্রাম ও অধিকারের প্রতীক হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে ১৯১৯ সালে গঠিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) তাদের প্রথম কনভেনশনেই আট ঘণ্টা কর্মদিবসের পক্ষে সিলমোহর দেয়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গি
আইএলওর মতে, ৮ ঘণ্টার কর্মদিবস মানে একজন শ্রমিকের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা এবং কাজ ও জীবনের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য (ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স) বজায় রাখা। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংস্থাটি স্বীকার করেছে যে, প্রযুক্তির প্রভাবে কাজের ধরনে পরিবর্তন এসেছে এবং সেই অনুযায়ী কাজের সময় নিয়েও পুনর্বিবেচনার জায়গা তৈরি হয়েছে।
সংস্থাটি ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ভবিষ্যতের কর্মপরিবেশ কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে একটি রূপরেখা তুলে ধরে। ওয়ার্ক ফর অ্যা ব্রাইট ফিউচার শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে যে কর্মপরিকল্পনা দেখানো হয়, তাতে তিনটি মূল বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়—মানবিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেওয়া, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যত কর্মের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জনসংখ্যা, প্রযুক্তি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে কাজের ধরন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে কর্মক্ষেত্রে সময় ব্যবস্থাপনাকে আরও নমনীয় করতে হবে।
সংস্থাটি তাই কর্মঘণ্টার পুনর্বিন্যাস, সপ্তাহে আরও কম দিন কাজের সুবিধা ও রিমোট ওয়ার্কের মতো নমনীয় কর্মব্যবস্থার পরামর্শ দেয়। উদাহরণ হিসেবে তারা নমনীয় কর্মঘণ্টা (ফ্লেক্সিবল ওয়ার্কিং আওয়ারস), সঙ্কুচিত কর্মসপ্তাহ (কম্প্রেসড ওয়ার্কউইক) ও দূরবর্তী কর্মপদ্ধতির (টেলিওয়ার্ক) মতো কার্যকর মডেলের কথা তুলে ধরে, যা কাজ ও জীবনের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হতে পারে।
কর্মঘণ্টা নিয়ে গবেষণা ও কর্মীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা
কর্মঘণ্টা কমানো হলে উৎপাদশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে কিনা, তা নিয়ে গবেষণা চলছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। তবে এসব গবেষণা চমকপ্রদভাবে কর্মীবান্ধব ফল উপস্থাপন করেছে।
একাধিক গবেষণায় আইএলও দেখিয়েছে যে, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা কর্মীর শুধু শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিই করে না, বরং এটি অর্থনৈতিকভাবেও খুব বেশি কার্যকর মডেল নয়।
সংস্থাটির ২০২২ সালে করা এক গবেষণায় বলা হয়েছে, কর্মঘণ্টা কমালে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়ে। সেইসঙ্গে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যেরও উন্নতি ঘটে। ফলে এটি তাদের ব্যক্তিজীবনকে আরও সমৃদ্ধ করে।
২০২৩ সালে কর্মঘণ্টা ও ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স নিয়ে আরও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আইএলও। তাতে বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারি-পরবর্তী বাস্তবতায় ‘ফ্লেক্সিবল ওয়ার্ক’ কর্মীদের মানসিক সুস্থতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, যা সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানের জন্য লাভজনক ফল বয়ে আনে।
সারা বিশ্বের শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত এই সংস্থাটি এমন একটি কর্মপরিবেশ চায়, যেখানে কাজ ও ব্যক্তিজীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকবে এবং কর্মীর স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও দক্ষতার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হবে।
আইএলওর এই দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ওইসিডির বেটার লাইফ ইনডেক্স ও জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনেও প্রতিফলিত হয়।
ওইসিডির সূচকে ‘ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স’ একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড, যেখানে কম কর্মঘণ্টা, পরিবারকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া ও জীবনের সন্তুষ্টির মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়। অপরদিকে, ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন সূচকে কেবল আয় নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনমানের সঙ্গে কাজের পরিবেশকেও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ফলে শ্রমঘণ্টা ও কাজের ধরন নিয়ে নতুন ভাবনার প্রয়োজনীয়তা এই উন্নয়ন সূচকগুলোতেও স্পষ্টভাবে উঠে আসে।
আইএলও ২০২২ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে যে নীতিমালা প্রকাশ করে, তাতেও এসব গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল প্রতিফলিত হয়। এতে নেতিবাচক কর্মসংস্কৃতি, অতিরিক্ত সময় কাজ করা এবং কাজের চাপে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির দিকগুলো তুলে ধরা হয়। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যবান্ধব কর্মপরিবেশ গড়ে তুলতে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণ ও সহায়তামূলক নীতি প্রণয়ন করা জরুরি বলেও সুপারিশ করা হয়।
আট ঘণ্টার কর্মদিবসের যৌক্তিকতা
বিশ্ব অর্থনীতির জটিলসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানব সভ্যতা একবিংশ শতকের দুই যুগ অতিক্রান্ত করে বর্তমান সময়ে উপনীত হয়েছে। ফলে দিনে আট ঘণ্টা কাজ করা একসময় প্রগতিশীল ধারণা থাকলেও এখন প্রগতি পেয়েছে নতুন ধারণা। নতুন অর্থনীতির এই প্রেক্ষাপটে এখন কর্মীদের মূল্যায়ন হয় কাজের মান, দক্ষতা ও ফলাফলের ভিত্তিতে। তাই কর্মঘণ্টার সংজ্ঞাকেও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজনীয়তা এসেছে।
২০২২ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও বোস্টন কলেজ চার দিনের কর্মসপ্তাহের ওপর বিশ্বের বৃহত্তম গবেষণা পরিচালনা করে। ওই যৌথ গবেষণায় ৬১টি প্রতিষ্ঠানের অন্তত ২ হাজার ৯০০ কর্মী অংশ নেন। তাতে দেখা যায়, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা মানেই বেশি আউটপুট—এই ধারণা একেবারেই বুজরুকি।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ওই গবেষণায় দেখা যায়, এতে অংশ নেওয়া কর্মীরা সপ্তাহে ৩২ থেকে ৩৫ ঘণ্টা কাজ করেও সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা দেখিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, সপ্তাহে ৩২-৩৫ ঘণ্টাই শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল থাকেন বলে গবেষণায় উঠে আসে।
চলুন, গবেষণার ফলাফলের সংক্ষিপ্তসারের ওপর চোখ বোলানো যাক:
মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা: ৭১ শতাংশ কর্মীর বার্নআউটের মাত্রা কমেছে এবং ৩৯ শতাংশ কর্মী কম চাপ অনুভব করেছেন। সামগ্রিকভাবে, তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে।
ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স: ৬০ শতাংশ কর্মীর জন্য পারিবারিক কাজের সমন্বয় সহজ হয়েছে এবং কর্মীদের ৬২ শতাংশ সামাজিক জীবনের সঙ্গে কাজের ভারসাম্য বজায় রাখতে পেরেছেন।
উৎপাদনশীলতা ও আয়: প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় গড়ে ১.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের আয়ে আগের বছরের তুলনায় ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে দেখা যায়।
কর্মী ধরে রাখা: কর্মীদের প্রতিষ্ঠান ছাড়ার হার ৫৭ শতাংশ কমেছে। এছাড়া অসুস্থতার কারণে অনুপস্থিতির হারও কমেছে ৬৫ শতাংশ।
কর্মসংস্কৃতির পরিবর্তন: প্রতিষ্ঠানগুলোতে দীর্ঘ ও অপ্রয়োজনীয় মিটিং কমানো সত্ত্বেও কর্মীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর উপায় খুঁজে নিয়েছেন।
গবেষণার শেষে, ৯২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান চার দিনের কর্মসপ্তাহের মডেলটি চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে ১৮টি প্রতিষ্ঠান এটিকে স্থায়ী নীতি হিসেবে গ্রহণ করে।
বিশ্বজুড়ে কর্মঘণ্টা কমানোর উদাহরণ ও ফলাফল
গত কয়েক দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরীক্ষামূলকভাবে কর্মঘণ্টা কমিয়েছে এবং তাতে নানা ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে:
আইসল্যান্ড: ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দুটি বৃহৎ পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালায় আইসল্যান্ড, যেখানে প্রায় আড়াই হাজার সরকারি কর্মচারী সপ্তাহে চার দিন কাজ করেন। এতে দেখা যায়, কর্মীদের উৎপাদনশীলতা তো কমে না-ই, বরং কিছু ক্ষেত্রে বেড়ে যায়। এর পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় এবং ওয়ার্ক-লাইফ ভারসাম্য উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এই প্রকল্পের সফলতার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে দেশটির প্রায় ৮৬ শতাংশ কর্মক্ষেত্রেই সংক্ষিপ্ত কর্মঘণ্টা চালু হয়েছে।
জাপান: ২০১৯ সালে জাপানে কর্মীদের ওপর একটি পরীক্ষামূলক কর্মসূচি চালায় মাইক্রোসফট। এই কর্মসূচির আওতায় কর্মীদের সপ্তাহে চার দিন কাজ করতে দেওয়া হয়। ফলাফলে দেখা যায়, তাদের কর্মক্ষমতা প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে।
স্পেন: স্পেন ২০২১ সালে পরীক্ষামূলকভাবে সপ্তাহে চার দিন কাজের প্রকল্প চালু করে, যেখানে কিছু ক্ষেত্রে দৈনিক কর্মঘণ্টা কমানো হয়। প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, কর্মীদের মধ্যে চাপ কমে, স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং উদ্ভাবনী শক্তি বাড়ে।
দক্ষিণ কোরিয়া: অতিরিক্ত ওভারটাইম ও কর্মজীবনের ভারসাম্যহীনতার মতো সংকট মোকাবিলায় ২০১৮ সালে প্রথমবার কর্মঘণ্টা সীমিত করার পদক্ষেপ নেয় দক্ষিণ কোরিয়া। ৪০ ঘণ্টা নিয়মিত কাজ এবং অতিরিক্ত ১২ ঘণ্টা ওভারটাইমের সুযোগ রেখে সাপ্তাহিক সর্বোচ্চ কর্মঘণ্টা ৬৮ থেকে কমিয়ে ৫২ ঘণ্টা করে দেশটি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উদ্যোগটি দেশটির জনশক্তির কাছে সমাদৃত হয়। পরবর্তীতে ২০২৩ সালে তা ৫২ থেকে বাড়িয়ে ৬৯ ঘণ্টা করার প্রস্তাব দেওয়া হলেও ব্যাপক সমালোচনা ও গণআন্দোলনের মুখে প্রস্তাবটি স্থগিত করতে বাধ্য হয় সরকার।
এআইয়ের যুগে শ্রমঘণ্টা নিয়ে নতুন ভাবনা
প্রযুক্তি ও অটোমেশনের এই যুগে কাজের ধরনও অভূতপূর্ব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই রূপান্তরকে আরও নাটকীয় গতি দিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে এখন অনেক পুনরাবৃত্তিমূলক, সময়সাপেক্ষ ও নিয়মিত কাজ নিমেষেই করে ফেলা যাচ্ছে, আগে যা ছিল শ্রম ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। শ্রমিকের কর্মপন্থায়ও তাই এসেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। কায়িক শ্রমের বদলে সৃজনশীল চিন্তা, জটিল সমস্যার সমাধান ও মানসম্পন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো বিষয়ই হয়ে উঠছে কর্মীর মূল দায়িত্ব।
এমন বাস্তবতায় ‘ঘণ্টাভিত্তিক কাজ’ নয় বরং ‘ফলাফলভিত্তিক কাজ’ই আরও বেশি যৌক্তিক হয়ে উঠছে। আগে যেখানে নির্দিষ্ট সময় অফিসে উপস্থিত থাকাটা জরুরি ছিল, এখন সেখানে ক্লাউড প্রযুক্তি, রিমোট টুলস ও এআইয়ের সহযোগিতায় কর্মীরা যেকোনো স্থান থেকেই অপেক্ষাকৃত কম সময়ে অধিকতর কার্যকর ফল দিতে পারছেন।
এই প্রেক্ষাপটে ‘ফিক্সড টাইম’ ধারণার পরিবর্তে ‘ফ্লেক্সিবল টাইম’ ও ‘আউটপুট-ভিত্তিক মূল্যায়ন’ ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এর পাশাপাশি কর্মীদের মানসিক প্রশান্তি ও সৃজনশীলতা নিশ্চিত করার মতো নীতিমালা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গুরুত্ব পাচ্ছে।
গবেষণা বলছে, প্রযুক্তি ব্যবহারে শ্রমঘণ্টা ২০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করেও উৎপাদনশীলতা একই রাখা অথবা বাড়ানো সম্ভব।
২০২২ সালে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা সংস্থা ডেলয়েটের ‘গ্লোবাল হিউম্যান ক্যাপিটাল ট্রেন্ডস’ শীর্ষক প্রতিবদেন বলা হয়, ‘ফ্লেক্সিবিলিটি ইজ দ্য নিউ ইনসেনটিভ’, অর্থাৎ সময়ের স্বাধীনতা কর্মীদের কাছে বেতন বা এ ধরনের সুবিধার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ
ওয়াশিংটন কনভেনশনে আইএলও দৈনিক সর্বোচ্চ কাজের সময় ৮ ঘণ্টা এবং সাপ্তাহিক ৪৮ ঘণ্টা নির্ধারণ করে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ এই কনভেনশনে সই করলেও দেশের বহু খাতে এখনও এই নিয়ম মানা হয় না।
দেশের সরকারি চাকরিতে দৈনিক সর্বোচ্চ আট কর্মঘণ্টা এবং সপ্তাহে দুদিন ছুটির ব্যবস্থা থাকলেও বেসরকারিখাতের বেশিরভাগ জায়গায় এই নিয়ম যেন সোনার হরিণ।
এ ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক, নির্মাণ ও পরিবহন খাতের শ্রমিকদের দৈনিক কর্মঘণ্টার পরিসর আরও বেশি। বিশেষ করে বেতন, বোনাস, ওভারটাইমের দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ তুলে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে পোশাকশ্রমিকদের অবরোধ-বিক্ষোভ প্রদর্শন এ দেশে নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ শ্রম গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইএলএস) ২০১৭ সালে পরিচালিত এক গবেষণা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে অনেক কারখানাই আইএলও নির্ধারিত কর্মঘণ্টা ও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত মান মেনে চলে না। দেশের শ্রমিকরা প্রতিদিন গড়ে ১২ ঘণ্টা কাজ করেন, যেখানে পরিবহন খাতে কর্মরত শ্রমিকদের অনেকেই ১৯ শতকের মতো দিনে ১৫ ঘণ্টারও বেশি সময় কাজ করে থাকেন।
২০২৩ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক জরিপে দেখা যায়, দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ পোশাককর্মী দিনে গড়ে ১০ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় কাজ করেন।
এ দেশে এখনও সপ্তাহে ৫ দিন কর্মদিবস পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। সরকারি খাতে এই ব্যবস্থা থাকলেও বেসরকারি খাতের অনেক ক্ষেত্রেই সপ্তাহে ৬ দিন কাজ চলে। ফলে, বিশ্বব্যাপী কর্মঘণ্টা হ্রাসের যে ধারা তা থেকে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ।
অবশ্য প্রযুক্তি খাতের কিছু প্রতিষ্ঠানকে সম্প্রতি ‘ফ্লেক্সিবল ওয়ার্ক আওয়ার’-এর মতো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে, যা দেশের কর্ম পরিমণ্ডলে আশার সঞ্চার করেছে।
তবে দেশের শিল্পকারখানাগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি স্থাপনের অপ্রতুলতা, প্রযুক্তি পরিচালনায় দক্ষ জনগোষ্ঠীর অভাবের মতো চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যা বিজ্ঞানের এই আশীর্বাদকে কাজে লাগিয়ে শ্রমঘণ্টা কমিয়ে আনার পথে বড় বাধা।
করণীয় ও সুপারিশ
বৈশ্বিক শ্রম-অঙ্গন ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে দেশের শ্রমবাজারের ইতিবাচক সংস্কারের জন্য কয়েকটি সুপারিশ দেওয়া যেতে পারে:
নীতি ও আইনগত সংস্কার: শ্রম আইনে নির্ধারিত কর্মঘণ্টার বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময় কাজ করানোর ক্ষেত্রে কর্মীদের সম্মতি ও উপযুক্ত পারিশ্রমিক পরিশোধের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
ফলাফল-ভিত্তিক মূল্যায়ন: সময়ের বদলে কাজের গুণমান ও ফলাফলের ভিত্তিতে কর্মীদের মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা সময়ের দাবি। বিশেষ করে প্রযুক্তিনির্ভর ও সৃজনশীল পেশাগুলোতে যেকোনো মুহূর্তেই এটি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
নমনীয় কর্মপরিবেশ: কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও কাজের প্রতি আগ্রহ বজায় রাখতে ফ্লেক্সিবল ওয়ার্কিং আওয়ার, হাইব্রিড ওয়ার্ক মডেল ও রিমোট ওয়ার্কের মতো সুযোগের সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।
কর্মদিবস পুনর্বিন্যাস: সপ্তাহে পাঁচদিন অফিস চালু করতে সকল বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। একই সঙ্গে কর্মদিবস কমিয়ে দৈনিক কর্মঘণ্টা পুনর্বিন্যাস করে পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া যায়।
প্রযুক্তি ব্যবহার ও দক্ষতা উন্নয়ন: এআই ও অটোমেশনের যুগে শ্রমিকদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ ও একাধিক বিষয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এতে করে তারা পরিবর্তিত কর্মপরিবেশে টিকে থাকার পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক কাজগুলোও এগিয়ে নিতে পারবেন।
নারী কর্মীদের জন্য সহায়ক নীতি: নারী কর্মীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি, ডে-কেয়ার সুবিধা, নমনীয় কর্মঘণ্টা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এর ফলে কর্মক্ষেত্রে তাদের দীর্ঘমেয়াদি অংশগ্রহণ বাড়বে।
গবেষণায় জোর: জাতীয় পর্যায়ে কর্মঘণ্টা, ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স ও উৎপাদনশীলতা নিয়ে বেশি বেশি গবেষণা হওয়া জরুরি। এর ফলে সামগ্রিকভাবে উৎপাদনশীলতা বাড়বে, সমস্যার জায়গাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানও করা যাবে। এতে কর্মীর ব্যক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের আয় বাড়বে, যা মোটের ওপর দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে।
বহু বছর আগে শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের অন্যতম সাফল্য ছিল আট ঘণ্টার কর্মদিবস। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এই সময়-কাঠামো নতুন করে বিন্যাসের বিষয়ে ভাবার সময় এসেছে। এটি শুধু সময় কমানোর প্রশ্ন নয়, বরং কাজের মান, কর্মীর সুস্থতা ও জীবনমান উন্নয়নের প্রশ্ন। আর নীতিনির্ধারক, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের সম্মিলিত উদ্যোগেই এর যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব।
২৪২ দিন আগে
ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমের মূল্য
পৃথিবীর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিটি মানুষকে কোনো না কোনো কর্মে আত্মনিয়োগ করতে হয়। আর এসবের মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টিও অর্জনের বিষয়টি নির্ভর করে। যুগে যুগে কল্যাণের বার্তা দিতে নবী ও রাসূলদের বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ও গোটা মানবজাতির কাছে পাঠানো হয়েছে। দুনিয়াতে পাঠানো প্রত্যেক নবী রাসূলও কর্মে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, প্রতিটি মানুষকে শ্রমনির্ভর করে সৃষ্টি করা হয়েছে। এর মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়েছে মর্যাদা।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা বালাদের ৪ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি মানুষকে কষ্ট ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করেছি।’ প্রত্যেক নবী ও রাসূল (সা.) জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে শ্রম দিতেন। তারা এসব করতে কোনো প্রকার কুণ্ঠাবোধ করেননি— যা অসংখ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
নবী ও রাসূলগণের জীবনী থেকে এরকম তথ্যই পাওয়া যায়। হজরত আদম (আ.) কৃষিকাজ করেছেন। হজরত নূহ (আ.) কাঠমিস্ত্রি বা সুতারের কাজ করেছেন। হজরত ইদ্রিস (আ.) সেলাইয়ের কাজ করতেন। হজরত সুলাইমান (আ.)-এর পিতা নবী ও সম্রাট হজরত দাউদ (আ.) লৌহশিল্প বা কামারের কাজ করতেন। হজরত শুআইব (আ.)-এর খামারে হজরত মূসা (আ.) ৮-১০ বছর চাকরি করেছেন। এমনকি আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও মা খাদিজা (রা.)-এর ব্যাবসা দেখাশুনা করেছেন দীর্ঘকাল। তিনি বলেছেন, ‘নিজ হাতে কাজ করার মাধ্যমে উপার্জিত খাদ্যের থেকে পবিত্র কোনো খাদ্য নেই।’ (বুখারি)
আরও পড়ুন: ঐতিহাসিক মে দিবস আজ
হালাল উপার্জন করার তাগিদ সর্বদা দিয়েছেন রাসূল (সা.)। ইবাদত কবুলের শর্তই হলো হালাল আয় বা রুজি। সুতরাং হালাল আয়ের একমাত্র পন্থাই হলো কায়িক বা দৈহিক শ্রম। উপার্জন করার নির্দেশনা দিয়ে মূলত রাসূল (সা.) শ্রমের মর্যাদাকেই অতি উচ্চে তুলে ধরেছেন।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা জুমা’র ১০ নম্বর আয়াতে স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘অতঃপর যখন নামাজ শেষ হবে, তখন তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং রিযিক অন্বেষণ কর। রাসূল (সা.) ও কুরআনের নির্দেশনা বাস্তবায়নের প্রতিই উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ফরজ ইবাদতগুলোর পরই হালাল উপার্জন ফরজ দায়িত্ব (তিরমিজি)। আরেক হাদীসে এসেছে ‘হালাল উপার্জনগুলোর মধ্যে সেটিই সর্বোত্তম, যা কায়িক শ্রম দিয়ে অর্জন করা হয় (মুসলিম)। আর ভিক্ষাবৃত্তিকে নিকৃষ্ট হালাল বলা হয়েছে।
সূরা কাসাসের ২৬ নম্বর আয়াতে স্পষ্ট করে আল্লাহ বলেছেন, ‘সর্বোত্তম শ্রমিক সেই, যে দৈহিক দিক দিয়ে শক্ত-সামর্থ্যবান ও আমানতদার।’ এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, পৃথিবীতে মানুষ যেহেতু দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাই সে আমানতদার। তাই কোনো শ্রমিক যখন হালাল কর্মে চুক্তিবদ্ধ হবে, তা করে দেওয়া তার কাছে আমানত রক্ষার স্বরুপ—এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
হাদিসে এসেছে, আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, কিয়ামতের দিন আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো। আর আমি যার বিরুদ্ধে বাদি হবো, তার বিরুদ্ধে জয়ী হবো। এক ব্যক্তি, যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করল। আরেক ব্যক্তি হলো- যে কোনো আজাদ মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল। আর তৃতীয় ব্যক্তি হলো, যিনি শ্রমিক নিয়োগ করে তার থেকে পূর্ণরূপে কাজ আদায় করে নেয়, কিন্তু তার পূর্ণ মজুরি দেয় না (বুখারি- ২২২৭)। শ্রমের গুরুত্ব দিয়ে নবীজি (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিককে কাজে লাগাবে, সে যেন তার পারিশ্রমিক নির্ধারণ করে কাজে লাগায়। (বুলুগুল মারাম- ৯১৪)
এখানে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হলো মালিকপক্ষও শ্রমিকের অধিকার হরণ করতে পারবে না। তা করলে স্বয়ং আল্লাহ শ্রমিকের পক্ষে দাঁড়াবেন। বেতন ও পারিশ্রমিক কর্মজীবীর ন্যায্য অধিকার। ইসলাম দ্রুততম সময়ে তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিয়ে দাও (ইবনে মাজাহ-২৪৪৩০)। অন্য হাদিসে পারিশ্রমিক ও প্রাপ্য অধিকার নিয়ে টালবাহানাকে অবিচার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা সর্বাধিক। কোনো অবস্থাতেই শ্রমিকদের খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। শ্রমের মর্যাদাই সর্বোচ্চ।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা সুরা মুমিনুনের ৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘আর তারাই প্রকৃত মুমিন; যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।’ হজরত আবু বকর (রা.) বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন- ‘অধীনস্থদের সাথে দুর্ব্যবহারকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (ইবনে মাজাহ)
ইসলামে শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ককে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একটু চিন্তা করলে দেখা যায়, পৃথিবীতে মানুষের আগমন হয়েছে হযরত আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.) এর মাধ্যমে। এর পর বংশ বিস্তার করে জাতিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন: মে দিবসে বেনাপোলে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ
রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমিকরা তোমাদেরই ভাই, আল্লাহ তাদের তোমাদের দায়িত্বে অর্পণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা যার ভাইকে তার দায়িত্বে রেখেছেন, সে যা খাবে তাকেও তা খাওয়াবে, সে যা পরিধান করবে তাকেও তা পরিধান করাবে; তাকে এমন কষ্টের কাজ দেবে না—যা তার সাধ্যের বাইরে। কোনো কাজ কঠিন হলে সে কাজে তাকে সাহায্য করবে’ (মুসলিম, মিশকাত)।
মুমিন মুসলমান হিসেবে আমাদের মনে রাখা জরুরি যে, শ্রমিক এবং মালিক দুজনই মানুষ। আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ১ নম্বর আয়াতে সতর্ক করে বলেছেন, হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এক আত্মা থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। এখানেই স্পষ্ট, সূচনার দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখি সব মানুষ একই মা-বাবার সন্তান। সেই দিক দিয়ে সব মানুষ পরস্পর ভাই ভাই।
সূরা বাকারার ২৮৬ নম্বর আয়াতে মহান রব মানুষের বিবেককে কাজে লাগাতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, শ্রমিকদেরও ভালোভাবে নিজের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। মালিকরাও শ্রমিকদের সামর্থ্যের বাইরে কোনো কাজ চাপিয়ে দিতে পারবেন না। আল্লাহ তায়ালা নিজেই কোনো ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না।
শৃঙ্খলিত জীবনের জন্য হালাল উপার্জনের বিকল্প নেই। অবৈধপন্থায় যেকোনো আয় সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে, অশান্তির কারণ হয় এবং বিপর্যয় ঘটায়। রাসূল সা. এর হাদীস থেকেও তা প্রমাণিত।
আবু মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী (সা.) কুকুরের বিক্রয়মূল্য, যেনাকারিনীর আয় ও গণকের পরামর্শ বা মতামত নিতে নিষেধ করেছেন (সহিহ ইবনু মাজাহ (২১৫৯)। সমাজের বাস্তব চিত্র দেখলে এসবের নেতিবাচক প্রভাবই আমাদের চোখের সামনে উঠে আসে। হাদীসে উল্লেখিত প্রতিটি বিষয়ই বর্তমান সমাজকে কলুষিত করছে।
সমাজে শ্রমের মূল্য প্রতিষ্ঠিত করতে সাড়ে ১৪০০ বছর আগেই রাসূল সা. গোটা উম্মাহকে নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। যার মাধ্যমে তিনি সামাজিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সামাজিক ন্যায়বিচার জারি করে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতিটি মানুষ পেয়েছিল তার আত্মমর্যাদা।
আজ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। পৃথিবীর দেশগুলোর সরকার, শ্রমিক সংগঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন দিবসটি পালন করছে। আয়োজন করা হয়েছে বর্ণাঢ্য নানা কর্মসূচির। কিন্ত, দুঃখের বিষয়, এসব আয়োজনেই সীমাবদ্ধ থাকে অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা। বাস্তবে রূপ দেওয়ার মতো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়—অনেক রাষ্ট্রীয় কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ে। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের মর্যাদা, শ্রমের মূল্য এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে শ্রমিকরা যে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তাদের সে আত্মত্যাগের সম্মানে দিবসটি পালন করা হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়েছে, কিন্তু আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা। প্রতিটি মানুষ যদি বিবেক জাগ্রত করে নিজ বলয় ও দায়িত্বাধীন প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে সকলের মর্যাদা ও মূল্য নিশ্চিত করে তাহলেই শ্রমিক দিবসের সার্থকতা ফুটে উঠবে।
২৪২ দিন আগে
ঢাকার সড়কে নিহতদের বেশিরভাগ পথচারী: গবেষণা
রবিবার, ভরদুপুর। রাজধানীর ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার্স থেকে রমজান পরিবহনের একটি বাস বেপরোয়া গতিতে এসে থামে মৌচাক মার্কেটের বিপরীত পাশে। পেছনে এসে থামে একই কোম্পানির আরও একটি বাস। কে বেশি যাত্রী তুলতে পারে, সেই প্রতিযোগিতায় সারা পথ পারাপারি করে এসেছে বাহনদুটি।
এ সময়ে মূল সড়কের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা সিনথিয়া ইসলাম (৪৫) নামের এক নারী ভয়ে ছিটকে পড়েন পাশের ফুটপাতের ওপর। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন তিনি, অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন চাপাপড়া থেকে। আতঙ্কে কথা বলতে পারছিলেন না ওই নারী।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলছিলেন, ‘ঢাকার বেশিরভাগ ফুটপাতই বেহাল, পথচারীদের চলাচলের জন্য সুগম নয়। এরপর রাস্তায় গাড়ি চলে বেপরোয়া গতিতে। এতে সব ঝক্কি যায় পথচারীদের ওপর দিয়ে।’
এই ঘটনার সময় শাহবাগ যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষায়ই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। সিনথিয়া বলেন, ‘বাসচালকেরা পারাপারি করে গাড়ি চালান। এতে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন পথচারীরা। কেউ প্রাণ হারাচ্ছেন, কেউ-বা চিরকালের জন্য পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে পরিবারগুলো।’
কোনো নিয়মনীতি না থাকার কারণে তারা এই প্রাণঘাতী প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বলে মন্তব্য করেন এই গৃহিণী। তার ভাষ্য, ‘রাস্তায় নেমে বেশি করে ট্রিপ ও যাত্রী তুলতে গিয়ে অসম প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন চালকেরা। যে কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।’
সিনথিয়া ইসলামের কথারই প্রতিফলন ঘটেছে সম্প্রতি হওয়া একটি গবেষণায়। এতে দেখা যায়, ২০২৩ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ১২৩ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৮৭ শতাংশই ছিল গাড়িচাপা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা। নিহতদের মধ্যে ৬১ শতাংশ ছিলেন পথচারী।
এরপরই রয়েছেন মোটরসাইকেলের আরোহীরা, নিহতদের ২৪ শতাংশ মোটরসাইলের যাত্রী ছিলেন। নিহতদের ৮৩ শতাংশই পুরুষ। নিহত নারীদের মধ্যে সবাই ছিলেন পথচারী।
গবেষণাটি করেছে মার্কিন দাতব্য সংস্থা দ্য ব্লুমবার্গ ফিল্যানথ্রপিস ইনিশিয়েটিভ ফর গ্লোবাল রোড সেফটি (বিআইজিআরএস)। ঢাকায় সড়কে প্রাণহানি কমাতে ডিএনসিসির সঙ্গে যৌথভাবে তারা এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তর থেকে সড়ক দুর্ঘটনার উপাত্ত সংগ্রহ করে ডিএনসিসি। এরপর ২০২৩ সালে ডিএনসিসির ২৫টি থানার সড়কে হতাহতের মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণী (এফআইআর) ও লিখিত অভিযোগ (এজাহার) নিয়ে তা বিশ্লেষণ করেছে বিআইজিআরএস।
গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন সংস্থাটির ঢাকা উত্তরের নজরদারি সমন্বয়ক (সার্ভিলেন্স কো-অর্ডিনেটর) ডা. তানভীর ইবনে আলী। তিনি বলেন, ‘প্রাণঘাতি সড়ক দুর্ঘটনায় মামলার আইনি প্রক্রিয়ার জন্য অনুসন্ধানের সময় পুলিশ দুর্ঘটনা সম্পর্কিত তথ্যাদি নথিভুক্ত করে থাকে। ঢাকা উত্তরে সড়ক দুর্ঘটনার সামগ্রিক অবস্থা নিরূপণের জন্য ডিএনসিসি এই তথ্য চেয়ে ডিএমপির কাছে ডেটা রিকোয়েস্ট পাঠায়। প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন শেষে সেই ডেটাগুলো আমরা নিয়েছি।’
দুর্ঘটনা বেশি বিমানবন্দর থানায়
২০২৩ সালে ডিএনসিসির ২৫টি থানা থেকে ১১৭টি প্রাণঘাতী সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন পেয়েছেন গবেষকরা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে বিমানবন্দর থানায়, ১৩টি।
আরও পড়ুন: তথ্যনির্ভর পদক্ষেপের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হবে: সেমিনারে বক্তারা
এরপর খিলখেতে ১১টি, উত্তরা পশ্চিম থানায় ১০টি, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর থানায় ৯টি করে, তুরাগ ও বনানীতে আটটি করে, হাতিরঝিল ও দারুস সালাম থানায় সাতটি করে, রূপনগর ও ভাটারা থানায় পাঁচটি করে, শাহ আলী, পল্লবী, ক্যান্টনমেন্ট ও বাড্ডা থানায় চারটি করে, উত্তরা পূর্ব, কাফরুল ও আদাবরে তিনটি করে এবং তেজগাঁও শিল্প এলাকা ও তেজগাঁওয়ে দুটি করে দুর্ঘটনা ঘটেছে।
তবে ভাষানটেক, দক্ষিণখান, গুলশান ও উত্তরখানা থানা থেকে কোনো প্রাণঘাতী সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। প্রাণহানির ৫৫ শতাংশ হয়েছে মাত্র সাতটি থানায়। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বিমানবন্দর ফ্লাইওভারের পূর্ব পাশে ও মিরপুর ১ মোড়ে।
চাপা দিয়ে পালিয়ে যায় বাস-ট্রাক
গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরের বেশিরভাগ পথচারীই নিহত হচ্ছেন বাস ও ট্রাকচাপায়। দিনের চেয়ে রাতের বেলায় সড়কে নিহতের সংখ্যা বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে ২৫টি থানায় যে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে, তার মধ্যে ৮৭ শতাংশই গাড়ি চাপা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা।
ঢাকা শহরে প্রধানত তিন ধরনের সংঘর্ষের ফলে প্রাণঘাতী সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে: পথচারীদের চাপা দেওয়া (৬৫ শতাংশ), সামনের দিকে ছুটে চলা গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা (৩৭ শতাংশ) এবং মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা (৬ শতাংশ)। এ ছাড়াও রাস্তার পাশের বস্তুতে ধাক্কা, পারাপারি ও দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িকে ধাক্কা দেওয়ার ঘটনায়ও এক শতাংশ করে প্রাণহানি ঘটছে।
যানবাহনের এসব সংঘর্ষে ৫৮ শতাংশ আঘাত করা হয় পথচারীদের। আর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি ঘটছে, তার ৬৫ শতাংশই ছিল পেছন থেকে ধাক্কায়।
ঢাকার সড়কে পথচারীদের প্রাণহানি বেশি
ঢাকা উত্তরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৬১ শতাংশই পথচারী বলে জানানো হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ২০২৩ সালে ১১৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১২৩টি প্রাণহানি ঘটেছে, যাদের মধ্যে পথচারী ৭৫ জন, মোটরসাইকেলচালক ২৯ জন, রিকশাচালক ৮ জন, সিএনজিচালিত অটোরিকশাযাত্রী ৬ জন, গাড়ির যাত্রী ৩ জন এবং বাইসাইকেলচালক ছিলেন দুজন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঢাকায় সড়কে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন পথচারীরা। সড়কে নিহত প্রতি পাঁচজনের মধ্যে তিনজনই পথচারী, আর প্রতি চার প্রাণহানির মধ্যে একজন মোটরসাইকেল-আরোহী।
ডিএনসিসিতে ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৮৩ শতাংশই পুরুষ। নিহত ১১৮ জনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে পুরুষ ৯৮ জন, নারী ২০ জন। আর নিহতদের মধ্যে পুরুষ পথচারী ছিলেন ৫০ জন এবং নিহত নারীদের সবাই পথচারী।
ঢাকার সড়কে প্রতি পাঁচ প্রাণহানির মধ্যে চারজন পুরুষ। আর নিহত প্রতি পাঁচজন পথচারীর মধ্যে নারী দুজন।
২০২৩ সালের ঢাকা উত্তরে সড়কে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে ২০ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের। ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৬ জন, ৪০ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৪ জন, ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সী ২১ জন, ৫০ থেকে ৫৯ বছর বয়সী ১৪ জন নিহত হয়েছেন। তবে এ সময়ে সাতটি শিশুরও প্রাণহানি ঘটেছে।
এ ছাড়াও একজন ৭০ থেকে ৭৯ বছর বয়সী ও একজন অশীতিপর রয়েছেন এই পরিসংখ্যানে। সব বয়সীদের মধ্যেই পথচারী নিহতের সংখ্যাটি বেশি। এ ছাড়া ৪০ থেকে ৪৯ বছর বয়সীরাই ঢাকা শহরের সড়কে বেশি নিহত হয়েছেন।
২৪৩ দিন আগে
মাগুরায় নিম্নমানের সরকারি পাটবীজ বিতরণ, অনাগ্রহ কৃষকদের
পাটের জীবনকাল বেশি, লম্বা, পেঁচিয়ে যাওয়া ও ফলন কম হওয়ার কারণে মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার পাট চাষিরা সরকারি বিএডিসির দেওয়া পাট বীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। জমিতে চাষ করছেন না সরকারের দেওয়া বিএডিসির বীজ। বিকল্প হিসেবে চাষিরা ঝুঁকে পড়েছেন এলসির মাধ্যমে আসা ভারতীয় সেবায়ন জে আর ও ৫২৪, চক্র মার্কা জে আর ও ৫২৪, ও শঙ্খ মার্কা পাটের বীজের দিকে।
এ মৌসুমে উপজেলায সর্বমোট ৯ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করা হয়েছে।
উপজেলার পাট চাষিরা সরকারিভাবে উপজেলা থেকে দুইটি মাধ্যমে পাটের বীজ ও রাসায়নিক সার পেয়ে থাকেন। প্রথমত উপজেলা কৃষি অফিস, দ্বিতীয় উপজেলা পাট অধিদপ্তরের অধীনে পাট অফিস থেকে।
তথ্যমতে, এই মৌসুমে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে এক কেজির ১ হাজার ৫৩০ প্যাকেট ও পাট অফিস থেকে ২ হাজার ৪০০ প্যাকেট বীজ চাষিদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় সুনামগঞ্জের কৃষকরা
এ ব্যাপারে উপজেলার কমলাপুর গ্রামের কৃষক জামাল মোল্লা ও ঘাসিয়ারা গ্রামের বক্কার মোল্লার সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, সরকারি বিএডিসির পাট বীজ জমিতে বপন করলে পাট দ্রুত বেড়ে অনেক লম্বা হয়ে যায় এবং লাল হয়ে যায়, যা অত্যন্ত নরম এবং পাটের সঙ্গে পাট পেঁচিয়ে যায়। আমরা সাধারণত যে সময় পাট কাটি সে সময় পাট কাটলে এর ফলন কম হয়। পাট কাটতে অনেক ঝামেলা হয়, যেকারণে আমরা জমিতে এ পাট বীজ বপণ করি না। যারা উপজেলা থেকে এ বীজ আনে তারা শুধুমাত্র রাসায়নিক সার পাওয়ার জন্য।
এ ব্যাপারে উপজেলার একজন সচেতন কৃষক গোলাম আলীর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, প্রতিবছর বিএডিসির কৃষি মন্ত্রণালয় ও পাট অধিদপ্তর থেকে চাষিদের জন্য কোটি কোটি টাকার যে পাটবীজ বিতরণ করা হয়, তা চাষিদের কোনো কাজেই আসছে না। ব্যাপারটি ভেবে দেখার সময় এসেছে।
এ ব্যাপারে কাদিরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন খান জানান, সরকারি বিএডিসি থেকে যে পাট দেওয়া হয় সেটার প্রতি কৃষকদের অনীহা রয়েছে। এ মৌসুমে সরকারি বীজ নেওয়ার জন্য মাইকিং করা হলেও কিছু কৃষক এসেছে। বাকি বীজের প্যাকেট গোডাউনে পড়ে আছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সালমা জাহান নিপা জানান, বিএডিসির দেওয়া এ পাট বীজের জীবনকাল বেশি। অন্যান্য পাটের জীবনকাল সাধারণত ৯০ থেকে ৯৫ দিন হয়ে থাকে। আমরা বিএডিসি থেকে সরকারি যে বীজ দিয়ে থাকি সেটি জীবনকাল ১২০ থেকে ১২৫ দিন হয়ে থাকে। যে কারণে হয়তোবা চাষিরা এ বীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
উপজেলা পাট কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন জানান, এ বীজের প্রতি চাষিদের অনীহার কারণ যে এটি বপণ করলে অন্যান্য পাটের তুলনায় আশ শক্ত হতে বেশি দিন সময় লাগে। চাষিরা তাদের জমিতে অন্য ফসল ফলানোর জন্য তাড়াতাড়ি পাট কেটে ফেলে। যে কারণে এ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। যদি সময় মতো পাট কাটা যায়, তাহলে অন্য পাটের তুলনায় এর ফলন বেশি হবে। এ ব্যাপারে চাষিদের নিয়ে আমারা কর্মশালা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা চাষিদের বোঝানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন: চাঁপাইনবাবগঞ্জে বেগুনে রঙের ধান চাষে সাড়া ফেলেন কৃষক রবিউল
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি বিএডিসি থেকে যে পাটবীজ পাট চাষিদের মাঝে বিতরণ করা হয়—তা চাষিরা বপণ করে না। ঘরেই রেখে দেন। আর প্রণোদনা হিসেবে যে সার পাওয়া যায়—তা অন্য জমিতে ব্যবহার করা হয়।
২৪৪ দিন আগে